সর্বশেষ সংবাদ :

প্রত্যন্ত অঞ্চলে সাকিব-তামিম-জামাল তৈরির লক্ষ্যে ছুটছে শাপলা ক্রীড়া ইন্সটিটিউট

আব্দুল্লাহ আল মাারুফ:

বর্তমান বাংলাদেশে খেলাধুলার জনপ্রিয়তা যে সর্বাগ্রে, এ বিষয়টিতে মতপার্থক্য আজ শূন্যের কোঠায়! একটা সময় ছিলো, যখন এদেশের প্রায় সকল বাবা মা তাদের সন্তানদের কেবলই ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার কিংবা পাইলট বানানোর স্বপ্নে বিভোর থাকতেন! কিন্তু আজ সে স্বপ্নের তালিকায় যোগ হয়েছে নতুন একটি শব্দ, খেলোয়ার।

 

 

 

শহর পেড়িয়ে গ্রাম, সর্বত্রই আজ কেবলই ক্রিকেট এবং ফুটবলের জয়জয়কার! শিশু, কিশোর বা তরুণ থেকে শুরু করে অভিভাবক, এই দুইয়ের প্রতি আজ আগ্রহের কমতি নেই কারোরই! তবে শহরে খেলাধুলা চর্চা যতটা, ঠিক তার বিপরীত চিত্রের দেখা মেলে গ্রামাঞ্চলে! আর তাই খেলাধুলাকেই ধ্যানজ্ঞান ভেবে শৈশব হতে কৈশোর হয়ে যৌবনে পা রাখা মানুষটির খেলোয়ার হয়ে উঠবার স্বপ্ন এখানে বন্দী কেবলই মনের ক্যানভাস থেকে টিভি পর্দা হয়ে শেষ বিকেলের অপেশাদার ক্রিকেট-ফুটবলে!

 

 

 

 

বহু দুর্দান্ত প্রতিভা রয়েছে এখানে, কিন্তু সেই প্রতিভার বিকাশ ঘটাতে যা কিছুর প্রয়োজন, তার অভাব এখানে প্রকট! আবার শহরে গিয়ে প্রতিভার বিকাশ ঘটানোর সামর্থ্য এখানে একরকম বিলাসিতা! তাই বহু প্রতিভার বসবাস এখানে হলেও, উপযুক্ত খেলার মাঠ, খেলার উপকরণ, সর্বোপরি প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা না থাকায় অনেক সম্ভাবনাময় প্রতিভা এখানে সম্ভাবনার মহাকাব্যেই বন্দী থেকে যায়, সত্যি হয়ে ওঠেনা। একজন ক্রীড়া অন্তপ্রাণ মানুষের কাছে যে মহাকাব্য বড্ড কষ্টের, বড্ড বেদনার! এ মহাকাব্য যে হৃদয়ে রক্তক্ষরণ ঘটায় প্রতি ক্ষণে ক্ষণে!

 

 

নিজ এলাকার এমন শতসহস্র ক্রীড়া প্রতিভাকে কেবল সম্ভাবনার মহাকাব্যে বন্দী থাকতে দেখে হয়তো হৃদয়ে নিরব রক্তক্ষরণ ঘটেছিলো শাপলা গ্রাম উন্নয়ন সংস্থার পরিচালক, মোঃ মোহসিন আলীর! হয়তো তাই তিনি চেয়েছিলেন, নিজ এলাকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা এসব ক্রীড়া প্রতিভাকে সম্ভাবনার মহাকাব্য হতে মুক্ত করতে। একজন ক্রীড়া অন্তপ্রাণ মানুষ হিসাবে তিনি খুব ভালো করেই জানতেন, উন্নততর প্রশিক্ষণ ছাড়া কোন ভাবেই তাদের ভেতর থাকা প্রতিভার পূর্ণ বিকাশ ঘটানো সম্ভব নয়। আর এজন্য, তিনি একটি উন্নত ক্রীড়া ইন্সটিটিউট এর প্রয়োজনীয়তা বোধ করেন।

 

 

 

অবশেষে, গ্রামগঞ্জে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সকল ক্রীড়া প্রতিভাকে রক্ষা ও যথাযথ প্রশিক্ষণ এর মাধ্যমে তাদের প্রতিভার পূর্ণ বিকাশ ঘটিয়ে দেশের ক্রীড়াঙ্গনে সর্বোচ্চ পর্যায় পৌছে দেওয়ার লক্ষ্যে তিনি ২০১৯ সালের ২২শে ফেব্রুয়ারি, রাজশাহী সদর থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার উত্তরে, কেশরহাট ডিগ্রি কলেজ প্রাঙ্গণে, নিজ প্রতিষ্ঠান শাপলা গ্রাম উন্নয়ন সংস্থার সহযোগিতায় গড়ে তোলেন অত্যাধুনিক ক্রীড়া ইন্সটিটিউট! নাম দেন শাপলা ক্রীড়া ইন্সটিটিউট!

 

 

 

বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটির সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন, প্রতিষ্ঠাতা মোঃ মোহসিন আলী! তিনি জানান, আমাদের দেশ প্রতিভায় ভরপুর। তবে এদেশে এমন বহু প্রতিভা রয়েছে, যাদের বাস প্রত্যন্ত অঞ্চলে। কেবলমাত্র প্রত্যন্ত অঞ্চলে বসবাসই তাদের প্রতিভা বিকাশে পর্বত সম বাধা হয়ে দাঁড়ায়! অথচ, সামান্যতম সুযোগ সুবিধা পেলেই, প্রত্যন্ত অঞ্চলে বাস করেই, পর্বতসম সব বাধা বিঘ্ন পেরিয়ে, তাঁদের পক্ষে সাফল্যের শিখরে পৌছানো সম্ভব!

 

 

 

আর্থিক টানাপোড়েন বা পর্যাপ্ত সুযোগ সুবিধার অভাবে কোন মেধাবী যেন ঝরে না পড়ে, কোন প্রতিভার বিকাশ যেন বাধাগ্রস্ত না হয়, সমাজের কোন শিশু কিশোর যেন অধিকার বঞ্চিত না হয়, কেবলমাত্র এসব ভাবনা হতেই শাপলা ক্রীড়া ইন্সটিটিউটের জন্ম।

 

 

 

প্রতিষ্ঠানটির অবকাঠামোগত দিক সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি জানান, ‘আপতত কেশরহাট ডিগ্রি কলেজ মাঠে আমরা অস্থায়ী ভাবে প্রশিক্ষণ দিচ্ছি। পাশেই প্রায় ৩০০ শতাংশ জমি ক্রয় করা হয়েছে এবং সেখানে অতি দ্রুতই স্থায়ী প্রশিক্ষণ কেন্দ্রটি গড়ে তোলা হবে। তাছাড়া ইতোমধ্যেই আমরা আধুনিক জিম এবং সুইমিং পুলের পাশাপাশি আবাসন ব্যবস্থাও গড়ে তুলেছি।’

 

 

 

দারিদ্রতা প্রশিক্ষণার্থীদের জন্য বাধা হবে কিনা, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, ‘দারিদ্রতা কোন বাধা হবে না কারোর জন্যই। এখানে নাম মাত্র বেতন নেওয়া হয়। সবাই যদি শতভাগ বেতন দেয়, তবে এ থেকে প্রাপ্ত অর্থ হবে প্রতিষ্ঠানের সামগ্রিক ব্যয়ের এক পঞ্চমাংশ! মূলত বেতন হচ্ছে এইখানে ডিসিপ্লিন মাত্র। এখানে বেতন এর জন্য কোন রকম কোন চাপও প্রয়োগ করা হয়না, আমি নিষেধ করেছি। সকলে তাদের নিজেদের সামর্থ্যানুযায়ী বেতন পরিশোধ করে এখানে। সবসময়ই বেতনের চেয়ে আমরা প্রতিভার প্রতি বেশি গুরুত্ব আরোপ করে থাকি। প্রয়োজনে আমরাই সকল বিপদে আপদে তাদের পাশে দাঁড়ায়, যাতে করে তাঁদের সামনে এগিয়ে যাওয়ার পথে কোন রকম প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি না হয়।’

 

 

 

প্রতিষ্ঠানটিকে নিয়ে নিজের স্বপ্নের কথা জানতে চাইলে তিনি জানান, ‘একে আমরা বিকেএসপি’র আদলে গড়ে তুলতে চাই। একদিন সাকিব তামিম জামালের মত বিশ্ব সেরারা আমাদের এখান থেকে বের হয়ে বিশ্ব ক্রীড়াঙ্গন শাসন করবে, এটাই স্বপ্ন, এটাই চাওয়া।’

 

 

 

ইন্সটিটিউটটির ক্রিকেট বিভাগের দেখ-ভালের দ্বায়িত্বে রয়েছেন মোস্তফা আল মারুফ। তার নেতৃত্বে শক্তিশালী কোচিং প্যানেল এগিয়ে নিচ্ছে শাপলার ক্রিকেটারদের! প্রতিষ্ঠানটির শুরু থেকেই সামনে থেকে নেতৃত্ব দেওয়া এই ক্রিকেটার তৈরির কারিগর, প্রতিষ্ঠানটির সমগ্রিক প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইলে জানান, ‘প্রথম দিকে এখানে মাঠটি ছাড়া আর তেমন কিছুই ছিলো না! হাতেগোনা কয়েকজন প্রশিক্ষণার্থীকে নিয়েই যাত্রা শুরু আমাদের। যতই দিন গড়িয়েছে, বেড়েছে প্রশিক্ষণার্থীর সংখ্যা, সেই সাথে বেড়েছে সব ধরণের ফ্যাসিলিটিজও। একটি আধুনিক ক্রীড়া প্রতিষ্ঠানে যা যা থাকা দরকার, তার সব আজ আছে এখানে। যার ফলও আমরা এখন পাচ্ছি। আমাদের ছেলে মেয়েরা এখনই দেশের জাতীয় পর্যায়ে নিজেদেরকে মেলে ধরতে সক্ষম হচ্ছে। জাতীয় পর্যায়ের গন্ডি পেড়িয়ে এরাই যেন আন্তর্জাতিক পর্যায়ে দেশের প্রতিনিধিত্ব করতে পারে, সেভাবেই আমরা গড়ে তুলছি ওদের।’

প্রতিষ্ঠার পর সফলতার সাথে চার বছর পার করে পাঁচ বছরে পদার্পন করেছে ইন্সটিটিউটটি। কেবলই ক্রিকেট দিয়ে যাত্রা শুরু করলেও, ইন্সটিটিউটটিতে বর্তমানে যুক্ত হয়েছে ফুটবল। আধুনিক সকল সুযোগ সুবিধা ও দক্ষ প্রশিক্ষকদের কারনে, ইতোমধ্যেই ইন্সটিটিউটটির প্রশিক্ষণার্থীরা সাফল্যের স্বাক্ষর রাখতে শুরু করেছে জাতীয় পর্যায়ে!

 

 

 

চলতি বছর এই ইন্সটিটিউটের পাঁচজন প্রশিক্ষণার্থী সুযোগ করে নিয়েছে বিকেএসপিতে! নয় জনের সুযোগ হয়েছে পিকেসিএসবিডিতে। ইন্সটিটিউটটির একাধিক খেলোয়াররা বর্তমানে অংশ নিচ্ছেন ঢাকা রাজশাহী সহ দেশের সকল জেলার ফুটবল ও ক্রিকেট লীগগুলোতে! এছাড়া এখানে প্রশিক্ষণ নিয়ে জেলা বয়সভিত্তিক দলে সুযোগ হচ্ছে অনেকেরই।

 

 

পুরুষ প্রশিক্ষণার্থীদের পাশাপাশি, সাফল্যের স্বাক্ষর রাখতে শুরু করেছে এখানকার নারী প্রশিক্ষণার্থীরাও! সদ্য শেষ হওয়া ঢাকা প্রথম বিভাগের উদ্বোধনি ম্যাচেই মাত্র ২১ বলে অর্ধশতক ও ১৪ রান খরচায় ২ উইকেট নিয়ে ম্যাচসেরা হন এখানকার প্রশিক্ষণার্থী রুমানা।

 

 

আবাসিক-অনাবাসিক উভয় সুবিধা সম্বলিত শাপলা ক্রীড়া ইন্সটিটিউটের যাত্রা নাম মাত্র প্রশিক্ষণার্থী নিয়ে শুরু হলেও বর্তমানে ৮০ জনের অধিক প্রশিক্ষণার্থী এখানে নিয়মিত প্রশিক্ষণ গ্রহণ করছেন।

 

 

সানশাইন / শামি


প্রকাশিত: এপ্রিল ১৩, ২০২৩ | সময়: ৯:৫৪ অপরাহ্ণ | Daily Sunshine