সর্বশেষ সংবাদ :

শেষ বলের রোমাঞ্চে সাকিবদের জয়রথ থামালেন মাশরাফিরা

স্পোর্টস ডেস্ক: লেগ স্টাম্পের বাইরে লেংথ বল। ব্যাটসম্যান বল পাঠিয়ে দিলেন বাউন্ডারিতে। তার পরও তিনি হতাশায় ব্যাট দিয়ে মেরে বসলেন মাটিতে। বোলার আর কিপার তখন শুরু করেছেন উদযাপন! ম্যাচটি যে পৌঁছে গিয়েছিল তেমনই এক সমীকরণে। ‘টাই’ করার জন্য শেষ বলে বরিশালের প্রয়োজন পড়ে ৬ রানের। রেজাউর রহমান রাজার আলগা বল পেয়েও মোহাম্মদ ওয়াসিম নিতে পারেন চার রান। অন্য কোনো সময় হয়তো যথেষ্টই ভালো, কিন্তু এ দিন যথেষ্ট নয়!
ছুটির দিন না হলেও গ্যালারিতে ছিল হাজার ১৫ দর্শকের ভীড়। দেশের ক্রিকেটের দুই জনপ্রিয় তারকা মাশরাফি বিন মুর্তজা ও সাকিব আল হাসানের দলের লড়াই বলে কথা! ম্যাচটিও হলো দারুণ উপভোগ্য। সম্ভবত এবারের বিপিএলের সবচেয়ে রোমাঞ্চ জাগানিয়া ম্যাচ। উত্তেজনায় টইটম্বুর সেই ম্যাচে সাকিবের ফরচুন বরিশালের জয়রথ থামিয়ে ২ রানের জয় পেল মাশরাফির সিলেট স্ট্রাইকার্স।
অথচ ম্যাচের দ্বিতীয় ওভারেই তিন উইকেট হারিয়ে কাঁপছিল সিলেট। সেখান থেকে তাদেরকে উদ্ধার করেন নাজমুল হোসেন শান্ত। প্রথম ওভারে জীবন পাওয়া ব্যাটসম্যান শেষ ওভার পর্যন্ত উইকেটে কাটিয়ে খেলেন ৬৬ বলে ৮৯ রানের ইনিংস। সিলেট ২০ ওভারে তোলে ১৭৩ রান। রান তাড়ায় উত্তেজনার নানা মোড় পেরিয়ে শেষ বলে পৌঁছে যায় কঠিন সমীকরণ। সেখানে শেষ পর্যন্ত বরিশাল পেরে ওঠেনি অল্পের জন্য।
প্রথম ম্যাচে যে সিলেটের কাছে হেরে টুর্নামেন্ট শুরু করেছিল বরিশাল, টানা পাঁচ ম্যাচ জয়ের পর তারা আবার হারল সেই সিলেটের কাছেই। সাত ম্যাচে ছয় জয়ে সিলেট ধরে রাখল শীর্ষস্থান। সিলেটের ইনিংসে ছক্কা ছিল ২টি, বরিশারের ইনিংসে ১৪টি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত জয় সিলেটেরই। টি-টোয়েন্টি মানেই যে শুধু ছক্কার ঝড় নয়, সেটি ফুটে উঠল আরেকবার।
দুই দলের ক্যাচ হাতছাড়ার গল্প হয়েও থাকবে ম্যাচটি। শূন্য রানে জীবন পেয়ে সিলেটের ত্রাতা হয়ে ওঠেন শান্ত। বরিশালের তিন ব্যাটসম্যান জীবন পান। কিন্তু তারা কেউই পারেননি বড় ইনিংস খেলে দলকে টানতে। ম্যাচের শুরুটাই ক্যাচ মিস দিয়ে। প্রথম ওভারে সৈয়দ খালেদ আহমেদের অফ স্টাম্পের বাইরের শর্ট বলে ব্যাট চালিয়ে দেন শান্ত। থার্ড ম্যানে করিম জানাতের হাতের ফাঁক গলে বল পেরিয়ে যায় সীমানা। আউট হওয়ার বদলে ছক্কা! পরের বলটি ফুল টস পেয়ে ফ্লিক করে বাউন্ডারিতে পাঠান শান্ত।
পরের ওভারেই মোহাম্মদ ওয়াসিমের সেই তিন উইকেটের ওভার। একে একে আউট এবারের আসরে প্রথমবার ওপেন করতে নামা জাকির হাসান, আঙুলের চোট কাটিয়ে ফেরা তৌহিদ হৃদয় ও অভিজ্ঞ মুশফিকুর রহিম। রাউন্ড দা উইকেটে করা ডেলিভারিতে পা না নড়িয়ে ব্যাট পেতে দিয়ে লাইন মিস করেন জাকির। ডিগবাজি খেয়ে ছিটকে গিয়ে পড়ে অফ স্টাম্প। হৃদয় ক্রিজে গিয়ে দ্বিতীয় বলে চার মেরে পরের বলটিই ফ্লিক করে ক্যাচ দেন ফাইন লেগে। মুশফিক প্রথম বলেই এলবিডব্লিউ ভেতরে ঢোকা ডেলিভারিতে।
দুই ওভারে তিন উইকেট হারিয়ে তখন দিশাহারা সিলেট। সেই দলকে পথে ফেরান শান্ত ও টম মুরস। পাওয়ার প্লেতে শট খেলে রানের চাকা কিছুটা সচল রাখেন তারা। পাওয়ার প্লে শেষে শান্ত মন দেন উইকেট আঁকড়ে রাখায়। আরেকপ্রান্তে মুরস কিছু শট খেলে বাড়াতে থাকেন রান। ষষ্ঠ ওভারের পর পঞ্চদশ ওভারে গিয়ে আবার বাউন্ডারির দেখা পান শান্ত। তবে এক-দুই নিয়ে প্রান্ত বদল করেন তিনি নিয়মিতই। মুরস বাজে বল পেলেই পাঠান বাউন্ডারিতে।
৭১ বলে ৮১ রানের এই জুটি ভাঙে মুরসের বিদায়ে। বিপিএল অভিষেকে ৩০ বলে ৪০ রান করে এই ইংলিশ ব্যাটসম্যান স্টাম্পড হন সাকিবের বলে। ততক্ষণে শুরুর ধাক্কা সামলে শক্ত ভিত পেয়ে গেছে সিলেট। পরের সময়টায় ঝড় তোলেন শান্ত ও থিসারা পেরেরা। এই জুটিতে ৬৮ রান আসে ৩৪ বলে!
শান্তর রান এক পর্যায়ে ছিল ৪৭ বলে ৪৮। পরের বলে ওয়াসিমের ডেলিভারিতে দুর্দান্ত এক পুল শটে পা রাখেন তিনি এবারের বিপিএলের দ্বিতীয় ফিফটিতে। পরের ১৮ বলে করেন আরও ৩৭ রান। ১৬ বলে ২১ করে আউট হন পেরেরা। শান্ত শেষ পর্যন্ত চালিয়ে যান। ইনিংসের শেষ বলেও বাউন্ডারি মেরে তিনি অপরাজিত থেকে মাঠ ছাড়েন ১১ চার ও ১ ছক্কার ইনিংস খেলে।
শেষ ৬ ওভারে সিলেট তোলে ৭৬ রান। বরিশালের রান তাড়ার শুরুটা ছিল নাটকীয়। দ্বিতীয় ওভারের প্রথম বলে মাশরাফির আচমকা লাফানো ডেলিভারি ইব্রাহিম জাদরানের ব্যাটে ছোবল দিয়ে আলতো ক্যাচ যায় পয়েন্টে। কিন্তু সহজতম সেই ক্যাচ ছেড়ে দেন জাকির। উল্টো আঙুলে আঘাত পেয়ে মাঠ ছাড়েন তিনি।
ইব্রাহিমের উদ্বোধনী জুটির সঙ্গী সাইফ হাসান জ্বলে ওঠেন আরেক প্রান্তে। বিশাল চারটি ছক্কা আসে তার ব্যাট থেকে। মাশরাফির শর্ট বল পুল করে তিনি পাঠান গ্যালারিতে, মোহাম্মদ আমিরের শর্ট বল সীমানা ছাড়া করেন পুল করেই। মাশরাফির পরের ওভারে ক্রিজ ছেড়ে বেরিয়ে মারেন বিশাল এক ছক্কা, এরপর আরেকটি ছক্কা মারেন পুল করে।
এই সাইফও জীবন পান ৩০ রানে। অভিষিক্ত পেসার তানজিম হাসান সাকিবের বলে থার্ডম্যানে সহজ ক্যাচ ছাড়েন তৌহিদ হৃদয়। তবে ওই ওভারেই উইকেটের পেছনে ক্যাচ দিয়ে থামে সাইফের ঝড় (১৯ বলে ৩১)। ফর্মে না থাকা এনামুল হক ওপেনিং থেকে তিনে নেমেও রানে ফিরতে পারেননি। তাকেও (৮ বলে ৩) ফেরান তানজিম। ৭ ওভার শেষে বরিশালের রান তখন ২ উইকেটে ৪৬।
নড়বড়ে সেই অবস্থা থেকে বরিশালকে লড়াইয়ে ফেরান সাকিব ও জাদরান। দুর্দান্ত ফর্মে থাকা সাকিব এ দিনও দারুণ সব শট খেলে ঝড়ের বেগে বাড়াতে থাকেন রান। শুরুতে একটু সময় নেওয়া জাদরানও জেগে ওঠেন। ত্রয়োদশ ওভারে একশ পেরিয়ে যায় বরিশালের রান। চতুদর্শ ওভারে সাকিব জীবন পান রেজাউর রহমান রাজার বলে ফিরতি ক্যাচ দিয়ে। তবে সেই হতাশা দীর্ঘায়িত হয়নি বেশি। রাজা এক ওভারেই বোল্ড করে দেন সাকিব ও জাদরানকে।
৩৭ বলে ৪২ রান করে ফেরেন জাদরান, সাকিব থামেন ১৮ বলে ২৯ রান করে। দুজনের জুটি ৩৯ বলে ৬১ রানের। জোড়া উইকেটে সিলেট ম্যাচে ফিরলেও বরিশাল আবার উত্তেজনা ফেরান করিম জানাতের ব্যাটে। ষোড়শ ওভারে মাশরাফিকে উড়িয়ে দেন তিনি টানা তিন ছক্কায়! ওই ওভার থেকে আসে ২১ রান। ৫ ওভারে ৬৩ রানের সমীকরণ এক ধাক্কায় নেমে আসে ৪ ওভারে ৪২ রানে।
তবে রোমাঞ্চের তখনও অনেক বাকি। সপ্তদশ ওভারে স্রেফ ১ রান দিয়ে জানাতের (১২ বলে ২১) উইকেট নেন আমির। পরের ওভারে তানজিমের বলে ইফতিখার মারেন ছক্কা-চার, মাহমুদউল্লাহ প্রথম বলেই মারেন ছক্কা। ২ ওভারে যখন প্রয়োজন ২৩ রান, আমির আবার বাধা হয়ে দাঁড়ান বরিশালের সামনে। এবার তিনি ফিরিয়ে দেন মাহমুদউল্লাহকে। তবে ওই ওভারে সোজা ব্যাটে দারুণ এক ছক্কা মারেন মেহেদী হাসান মিরাজ।
শেষ ওভারে প্রয়োজন পড়ে ১৫ রানে। রাজা প্রথম বলটি করেন ওয়াইড। তবে পরের বলেই তিনি ফিরিয়ে দেন বরিশালের আশা হয়ে টিকে থাকা ইফতিখার আহমেদকে (১৩ বলে ১৭)। পরের বলে রান আউট হয়ে যান মিরাজ। পরের দুই বলে রাজা দেন মাত্র ১ রান। শেষ দুই বলে যখন প্রয়োজন ১৩ রান, লেংথ বল পেয়ে ছক্কা মেরে দেন মোহাম্মদ ওয়াসিম। খেলা জমে ওঠে আবার। শেষ বলে ছক্কা মারতে পারলেই ম্যাচ সুপার ওভারে! সেই ডেলিভারি খুব ভালো করতে পারেননি রাজা। তবে ওয়াসিমও পারেননি চারের বেশি রান নিতে। আরও একবার জয়ের উচ্ছ্বাসে মেতে ওঠে সিলেট।


প্রকাশিত: জানুয়ারি ২৫, ২০২৩ | সময়: ৫:৩৫ পূর্বাহ্ণ | সুমন শেখ