সর্বশেষ সংবাদ :

রাজশাহীতে নিপা ভাইরাসে নারীর মৃত্যু

স্টাফ রিপোর্টার: দেশে নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে সম্প্রতি এক নারীর মৃত্যু হয়েছে। রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) আয়োজিত শীতের সংক্রামক রোগ এবং নিপাহ ভাইরাস সংক্রমণ শীর্ষক সম্মেলনে এ তথ্য জানানো হয়। ৩৫ বছর বয়সী ওই নারীর বাড়ি রাজশাহীতে। তবে তার নাম ও ঠিকানা জানানো হয়নি।
আইইডিসিআর জানায়, রাজশাহীর ওই নারীর কাঁচা খেজুরের রস পানের ইতিহাস ছিল। ২০২২ সালে নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার তিনটি ঘটনা রিপোর্ট করা হয়েছিল, যার মধ্যে দুজন মারা গেছে।
আইইডিসিআরের পরিচালক অধ্যাপক ডা. তাহমিনা শিরিন বলেন, এ দেশে বাদুড়ের লালা বা প্রস্রাবের মাধ্যমে নিপাহ ভাইরাস ছড়ায়। মানুষ যখন দূষিত কাঁচা খেজুরের রস পান করে তখন ভাইরাসে আক্রান্ত হয়। সেই ব্যক্তি তখন তাদের পরিবারের সদস্য বা স্বাস্থ্যকর্মীদের মধ্যে সংক্রমণ ছড়িয়ে দেয়।
আইইডিসিআর জানায়, নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্তদের ৭১ শতাংশ মানুষ মারা যায়। তাই কাঁচা খেজুরের রস খাওয়া এড়িয়ে চলুন।
সম্মেলনে বক্তারা আরও বলেন, নিপাহ ভাইরাস সংক্রমণের লক্ষণ দেখা যেতে রস খাওয়ার আট থেকে নয়দিন সময় লাগে। মানুষ থেকে মানুষে সংক্রমণের ক্ষেত্রে লক্ষণগুলো ৬ থেকে ১১ দিন পরে প্রদর্শিত হয়।
আইইডিসিআর-এর গবেষকদের মতে, খেজুরের রস গরম করার পর পান করা নিরাপদ এবং গুড়ও নিরাপদ। প্রতিষ্ঠানটি খেজুরের রস সংগ্রহকারীদের রস সংগ্রহের পর সাবান দিয়ে হাত ধোয়ার পরামর্শও দিয়েছে।
আইইডিসিআর তথ্য অনুযায়ী, দেশে ২০০১ সালে মেহেরপুরে প্রথম নিপাহ ভাইরাস শনাক্ত হয়। এরপর ২০০৩ সালে হয় নওগাঁয়। তবে সবচেয়ে বড় আকারের প্রাদুর্ভাব হয় ফরিদপুর জেলায়, ২০০৪ সালে। সে বছর ফরিদপুরে নিপাহ ভাইরাসে ৩৫ জন আক্রান্ত হয়, তার মধ্যে ২৭ জনের মৃত্যু হয়। দেশে গত ২০ বছরে নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তিদের ৭১ শতাংশেরই মৃত্যু হয়েছে। ২০০১ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত সময়ে দেশে ৩২২ জনের দেহে নিপাহ ভাইরাস শনাক্ত হয়েছে। তাদের মধ্যে ২২৯ জন মারা গেছেন।
লক্ষণ ও উপসর্গ: রোগের উপসর্গ সংক্রমণের ৩ থেকে ১৪ দিনের মধ্যে হয়ে থাকে। প্রাথমিকভাবে জ্বর, মাথাব্যথা, পেশীতে ব্যথা, বমি, গলা ব্যথা বা ইনফ্লুয়েঞ্জার মতো উপসর্গ দেখা যায়। মাথা ঘোরা, তৃষ্ণা, বেঁহুশ হয়ে যাওয়া, অসংলগ্ন প্রলাপ এবং মস্তিষ্কের তীব্র সংক্রামণ জনিত স্নায়বিক লক্ষণ লক্ষ্য করা যেতে পারে। কিছু লোক নিউমোনিয়া, তীব্র বুক যন্ত্রণা সহ তীব্র শ্বাসকষ্টের সম্মুখীন হতে পারেন। শ্বাসকষ্টবিহীন রোগি অপেক্ষা যে সমস্ত রোগি শ্বাসকষ্ট উপস্থিত হয়, তাদের দ্বারা বেশিমাত্রায় এই রোগ ছড়িয়ে পরার সম্ভাবনা থাকে। ২৪ থেকে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে রোগি অচেতনাবস্থায় চলে যেতে পারেন। অল্পসংখ্যক মানুষ যারা প্রাথমিকভাবে ভালো হয়ে উঠলেও পরবর্তীকালে মস্তিষ্কের সংক্রমণে ভুগতে পারেন। মৃত্যুর হার ৪০ থেকে ৭১ শতাংশ পর্যন্ত হতে পারে।
করণীয়: নিপাহ ভাইরাস থেকে বাঁচতে নিম্নোক্ত বিষয়গুলো মেনে চলা উচিত। খেজুরের কাঁচা রস বা তাড়ি না খাওয়। খেজুরের কাঁচা রসে ডুবিয়ে পিঠা বা অন্য খাবার না খাওয়া। রস ভালোভাবে টগবগিয়ে ফুটিয়ে বা গুড় বানিয়ে খাওয়া উচিত। আধা খাওয়া ফল না খাওয়া। বাদুড়ের আধাখাওয়া ফল থেকে নিপাহ ছড়াতে পারে। যে কোনো ফল ধুয়ে খাওয়া। সাবান ব্যবহারে নিপাহ ভাইরাস মারা যায়। তাই সবধরনের ধোয়া-মোছার কাজে সাবান ব্যবহার করা উচিত।
নিপাহ ভাইরাস মানুষ থেকে মানুষে ছড়াতে পারে। তাই আক্রান্ত এলাকায় কারো মধ্যে এর লক্ষণসমূহ দেখা দিলে মানুষের সংস্পর্শ এড়িয়ে চলতে হবে এবং দ্রুত হাসপাতালে যোগাযোগ করে চিকিৎসা নিতে হবে। নিপাহ ভাইরাসের সংক্রমণ সাধারণত শীতকালে গাছ থেকে খেজুরের রস সংগ্রহ ও খাওয়া হয় সেই সময়ে হয়ে থাকে। এজন্য অক্টোবর মাস থেকেই সরকারি ও বেসরকারিভাবে ব্যাপক প্রচারের ব্যবস্থা করে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে পারলে নিপাহ সংক্রমণ করমিয়ে আনা সম্ভব হতে পারে।
যেভাবে ছড়ায়: নিপাহ ভাইরাসের প্রাকৃতিক ধারক এক বিশেষ ধরণের ফলভোজী বাদুড়। নিপাহ ভাইরাস একটি জুনোটিক ভাইরাস যা প্রাণি থেকে মানুষে সংক্রামিত হয়ে থাকে। মালয়েশিয়ায় এবং সিঙ্গাপুরের প্রারম্ভিক প্রাদুর্ভাবের সময়, বেশিরভাগ মানুষের সংক্রমণের কারণ ছিল এই ভাইরাস দ্বারা অসুস্থ শূকর বা তাদের দূষিত অঙ্গ প্রত্যঙ্গের সাথে সরাসরি যোগাযোগ। সংক্রমণ শূকরের গলা বা নিঃশ্বাসের স্রাবের সাথে নিঃসৃত দূষিত ভাইরাস কণার মাধ্যমে ঘটেছে বলে মনে করা হয়। বাংলাদেশ এবং ভারতে এই রোগের প্রাদুর্ভাব সংক্রমিত ফলভোজী বাদুড়ের প্রস্রাব অথবা লালা দ্বারা দূষিত ফল বা ফলের পণ্য যেমন, কাঁচা খেজুর রস খাওয়ার ফলে ঘটে। পরবর্তী প্রাদুর্ভাবের সময় নিপাহ ভাইরাস আক্রান্ত মানুষের শরীর থেকে সরাসরি সুস্থ মানুষের শরীরে এই ভাইরাসের সংক্রামণ হওয়ার প্রমাণ পাওয়া যায়। ভারতের শিলিগুড়িতে, ভাইরাসটির সংক্রমণ স্বাস্থ্যসেবার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের মাধ্যমে এক ব্যক্তি থেকে অন্যের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ার খবর পাওয়া যায়, যেখানে আক্রান্ত মানুষের ৭৫ শতাংশ ছিল হাসপাতালের কর্মচারী বা হাসপাতালে আসা অন্য রোগি বা তাদের পরিজন। ২০০১ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে আক্রান্ত রোগিদের ক্ষেত্রে প্রায় অর্ধেক সংক্রমণ রোগিদের সেবাযত্নকারীদের মাধ্যমেই এক মানুষ থেকে অন্য মানুষে এই ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ে।


প্রকাশিত: জানুয়ারি ১২, ২০২৩ | সময়: ৬:১২ পূর্বাহ্ণ | সুমন শেখ