১০ জানুয়ারি বাঙ্গালি জাতির স্বাধীনতা ও বিজয়ের পূর্ণতা প্রাপ্তি দিবস 

এম. আবদুস সোবহানঃ

এই উপমহাদেশে ইংরেজ বিতারণের আন্দোলন থেকে শুরু করে ১৯৪৭ সালে দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত ও পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রদ্বয়ের অভ্যুদয়ে তরুণ শেখ মুজিব সক্রিয়ভাবে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। তাঁর স্বপ্ন ও আশা পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রে বাঙ্গালির অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক মুক্তি ঘটবে। কিন্তু তাঁর সে স্বপ্ন ও আশা পাকিস্তান সৃষ্টির কিছুদিনের মধ্যেই হোঁচট খেলো। স্বপ্ন ভঙ্গে আশাহত শেখ মুজিব উপলব্ধি করলেন পাকিস্তানী উপনিবেশিক শাসনের অধীনে বাঙ্গালির মুক্তি কখনই সম্ভব নয়। তিনি নতুন করে স্বপ্ন দেখলেন- একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রই কেবল বাঙ্গালি জাতির সার্বিক মুক্তি ও কল্যাণ আনতে পারে। তখন থেকেই এই স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য শুরু হলো তাঁর অদম্য সংগ্রাম।

 

 

পাকিস্তানের স্বৈরশাসকদের অধীন ২৩ বছরে পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি নিদারুণ বৈষম্য, শত অত্যাচার, নিপীড়ন, জেল-জুলুম কোনো কিছুই তাঁকে তাঁর স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথ থেকে বিচ্যুৎ করতে পারেনি। নির্ভীক শেখ মুজিব ১৯৬৬ সালে অত্যন্ত কৌশলে স্বৈরশাসক জেনারেল আইয়ূব খাঁর সরকারের নিকট ঐতিহাসিক ৬ দফা পেশ করলেন। আর এই ৬ দফাই যে প্রকৃতপক্ষে ১ দফা অর্থাৎ স্বাধীনতা এটা জেনারেল আইয়ূব সহজেই বুঝতে পেরেছিলো। একারণে সে শেখ মুজিবের প্রতি হুমকি প্রদান করে বলে যে, যদি তিনি ৬ দফার আন্দোলন থেকে সরে না আসেন তবে অস্ত্রের ভাষায় জবাব দেওয়া হবে। ফলে রক্তচক্ষু স্বৈরশাসক আইয়ূব খাঁ শেখ মুজিবকে চিরতরে সরিয়ে দেয়ার জন্য গভীর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয় এবং তাঁকে তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় ১নং আসামি করে কারাগারে পাঠায়।

 

 

 

কিন্তু শেখ মুজিব তাঁর স্বপ্নকে বাঙ্গালি জাতির অন্তরে সঞ্চারিত করতে পেরেছিলেন। সুতরাং তাঁর মুক্তির জন্য বাঙ্গালি জাতি আক্রোশে ফেঁটে পড়ে, সৃষ্টি হয় ১৯৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান। এই গণঅভ্যূত্থান সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে এবং গণঅভ্যূত্থানের প্রথম শহীদ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের রিডার (বর্তমানে সহযোগী অধ্যাপক পদমর্যাদা) তৎকালীন প্রক্টর ড. সৈয়দ শামসুজ্জোহা। পাকিস্তানি জান্তা কর্তৃক ড. জোহার হত্যাকাণ্ড গণঅভ্যূত্থানকে আরো বেগবান করে। ফলে ১৯৬৯ এর ২২ ফেব্রুয়ারি আগরতলা মামলা থেকে তাঁকে নিঃশর্ত মুক্তি দিতে বাধ্য হয় পাকিস্তানি স্বৈরশাসক। ২৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯ সালে তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) লক্ষ লক্ষ জনতার সম্মতিতে তৎকালীন ডাকসু ভিপি তোফায়েল আহমেদ কর্তৃক তাঁকে বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত করা হয়। তিনি বাংলা ও বাঙ্গালির বন্ধু তথা বাঙ্গালির একান্ত আপনজনে অভিসিক্ত হন। ২৪ মার্চ ১৯৬৯ সালে কথিত লৌহ মানব জেনারেল আইয়ূব খাঁর পতন ঘটে। পাকিস্তানের শাসন ক্ষমতায় আবির্ভূত হয় আরেক স্বৈরশাসক জেনারেল ইয়াহিয়া খাঁ।

 

 

আগরতলা মামলা থেকে মুক্তি পাওয়ার পর বঙ্গবন্ধু ৬ দফার পক্ষে জনতার সমর্থন আদায়ে সমগ্র পূর্ব পাকিস্তান সফরে বের হন। এরই অংশ হিসেবে তিনি যখন উত্তরবঙ্গ সফরে আসেন সেই সময়ের একটি ঘটনার কথা এখানে উল্লেখ করা প্রাসঙ্গিক মনে করছি। নাটোরের বাসুদেবপুর রেলস্টেশনের প্লাটফর্ম লোকে লোকারন্য। খুলনা থেকে পার্বতীপুরগামী ট্রেন বেলা একটায় বাসুদেবপুর স্টেশনে পৌঁছে। বঙ্গবন্ধু ঐ ট্রেনেই আসছেন। তিনি ট্রেনের কামড়া থেকে নামলেন- ধীর গতিতে কাঠের তৈরী ওভারব্রীজে উঠে প্লাটফর্মে উপস্থিত জনতার মুখোমুখি দাঁড়ালেন। তাঁকে ফুলের মালা দিয়ে সম্মাননা জানাতে স্টেশনের অদূরে পশ্চিম দিকে অবস্থিত শ্রীশচন্দ্র বিদ্যানিকেতনের নবম শ্রেণির বালিকা- নাম মনোয়ারা- ওভার ব্রীজে বঙ্গবন্ধুর নিকট পৌঁছালো। বঙ্গবন্ধু বল্লেন “তুই কি হাতে পাবি”- বলেই ঘাড় বাঁকিয়ে মাথা নিচু করলে বালিকা মালাটি গলায় পড়িয়ে দিলো। জনতার উদ্দেশ্যে তিনি বক্তব্য রাখলেন। জনতা মোহিত হলো। ট্রেনে ওঠার সময় একজন বৃদ্ধ বঙ্গবন্ধুর সাথে হ্যান্ডশেক করলে তিনি তাকে চাচা সম্বোধন করে নৌকায় ভোট চাইলেন। জবাবে বৃদ্ধ আবেগ-আপ্লুত হয়ে বল্লো- “তোকেই দিবো বাবা তোকেই দিবো”। বঙ্গবন্ধু তাঁর সম্মোহিনী ক্ষমতা দিয়ে মানুষকে আপন করে নিতে পারতেন। তিনি মানুষকে খুব ভালোবাসতেন। তাঁর রাজনীতি ছিলো মানুষ বিশেষ করে সাধারণ মানুষের জন্য- ব্যক্তিগত স্বার্থের ঊর্ধ্বে। তাই তো তাঁর আহবানে ৬ দফার পক্ষে সমগ্র বাঙ্গালী জাতি অভূতপূর্ব সাড়া দিয়েছিলো।

 

 

 

অনুষ্ঠিত হলো ১৯৭০ সালে সাধারণ নির্বাচন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ জাতীয় পরিষদে ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি এবং প্রাদেশিক পরিষদের ৩০০টি আসনের মধ্যে ২৮৮টিতে জয় লাভ করে নিরঙ্কুশ সংখ্যা গরিষ্ঠতা অর্জন করা সত্ত্বেও স্বৈরশাসক জেনারেল ইয়াহিয়া খাঁ ক্ষমতা হস্তান্তরে নানা রকম টাল- বাহানার মাধ্যমে সময়ক্ষেপন এবং আহুত জাতীয় সংসদের অধিবেশন হঠাৎ স্থগিত ঘোষণা করে। এতে সমগ্র জাতি ক্রোধে ফুঁসে উঠে এবং বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে শুরু হয় শান্তিপূর্ণ অসহযোগ আন্দলোন। বঙ্গবন্ধু বাংলা ও বাঙ্গালির অবিসংবাদিত নেতায় পরিণত হন এবং তাঁর নির্দেশেই ১৯৭১ এর ১ মার্চ থেকে ২৫ মার্চ পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তানে সবকিছু পরিচালিত হয়। ৭ মার্চ ১৯৭১-এ বঙ্গবন্ধু রেসকোর্স ময়দানে ১০ লক্ষ জনতার উপস্থিতিতে ঐতিহাসিক ভাষণ দেন যা ছিলো জাতিকে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণে প্রস্তুতির জন্য কৌশলী অগ্রিম বার্তা। ২৫ মার্চ ১৯৭১ সালে অপারেশন সার্চলাইট নামে নিরস্ত্র বাঙ্গালি জাতির উপর অতর্কিতে বর্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়ে। বঙ্গবন্ধু বাঙ্গালি জাতির একমাত্র লেজিটিমেট নেতা হিসেবে ২৬ মার্চ ১৯৭১ এর প্রথম প্রহরে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন এবং ঘোষণার অব্যবহিত পরে ৩২ নং এর বাসভবন থেকে পাকিস্তানি জান্তা তাঁকে গ্রেফতার করে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে কারাগারে বন্দী রাখে। বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে তাঁকে রাষ্ট্রপতি করে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হিসেবে সৈয়দ নজরুল ইসলামের নেতৃত্বে মুজিবনগর সরকার গঠিত হয় এবং এই সরকার ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করেন। মুজিব নগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন তাজ উদ্দিন আহমেদ। মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় মিত্রবাহিনীর যৌথ আক্রমণে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর রেসকোর্স ময়দানে জেনারেল নিয়াজীসহ ৯৩ হাজার পাকিস্তানী সৈন্য আত্মসমর্পণ করে।

 

 

 

ত্রিশ লক্ষ মানুষের হত্যা ও দুই লক্ষ মতান্তরে ছয় লক্ষ নারীর সম্ভ্রণের বিনিময়ে অর্জিত হলো কাঙ্খিত স্বাধীনতা ও বিজয়। বিজয়ের আনন্দে সমগ্র বাঙ্গলি জাতি উদ্বেলিত ও অশ্রুসিক্ত হোলো কিš‘ মূহুর্তেই জাতি উপলব্ধি কোরলো অর্জিত স্বাধীনতা ও বিজয়ের এই আনন্দ যেন তাদের অন্তরে পরিপূর্ণ তৃপ্তি দিতে পারছেনা। কেননা তখনো বাবা-মা-র আদরের সেই খোকা, বাংলা ও বাঙ্গালির বন্ধু, বাঙ্গালির একান্ত আপনজন, স্বাধীনতা ও বিজয়ের মহানায়ক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানী কারাগারে বন্দী। স্বাধীনতার সেই প্রাণপুরুষ জাতির মাঝে ফিরে না আসা পর্যন্ত এই স্বাধীনতা, এই বিজয়তো অর্থহীন। শুরু হোলো উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠার সাথে অপেক্ষার পালা- কখন আসবে মহানায়ক! অবশেষে সেই প্রতীক্ষিত মাহেন্দ্রক্ষণটি জাতির সম্মুখে উপস্থিত হোলো। বিশ্ব নেতৃবৃন্দের বিশেষ কোরে ভারতের তৎকালীণ প্রধান মন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধীর অনন্য ভূমিকায় ৮ জানুয়ারী ১৯৭২ সালে পাকিস্তানী স্বৈরশাসক বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয় এবং মুক্তি পেয়ে তিনি লন্ডন যান, ব্রিটিশ প্রধান মন্ত্রী এডওয়ার্ড হীথ বঙ্গবন্ধুকে ঊষ্ণ অভ্যর্থনা জানান এবং ব্রিটিশ রাজকীয় বিমানে তাঁকে বাংলাদেশে পাঠানোর ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। বঙ্গবন্ধু পথে দিল্লিতে যাত্রাবিরতি করেন।

 

 

পালাম বিমান বন্দরে প্রধান মন্ত্রী মিসেস গান্ধী এবং ভারতের রাষ্ট্রপতি ভি ভি গিরি তাঁকে সাদর অভ্যর্থনা জানান। ১০ জানুয়ারী ১৯৭২ এ স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশে একান্ত আপন জনতার মাঝে তিনি ফিরে এলেন। তাই আনুষ্ঠানিকভাবে ১০ জানুয়ারী বাঙ্গালি জাতির নিকট জাতির পিতার “স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস”- একথা যেমন ধ্রুব সত্য তেমনি এই প্রত্যাবর্তন যে “স্বাধীনতা ও বিজয়ের পরিপূর্ণতা প্রাপ্তি দিবস” সে কথাও অনস্বীকার্য। ১০ জানুয়ারী বাঙ্গালি জাতির জীবনে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ একটি দিন। সুতরাং বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে গোটা বাঙ্গালি জাতি যেমন মুক্তিযুদ্ধে একতাবদ্ধ হোয়েছিলো- ঠিক একইভাবে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা বিনির্মাণে বাংলাদেশের বর্তমান উন্নয়নের অগ্রযাত্রা যেন কোনোভাবেই ব্যহত না হয় সেজন্য বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার পক্ষে সমগ্র জাতি আবারও একাট্টা হবে ১০ জানুয়ারীতে এটাই হোক জাতির দৃঢ় অঙ্গীকার। ১০ জানুয়ারি বাঙ্গালির হৃদয়ে চির অম্লাণ থাকুক। জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু।

 

 

 

 

 

 

সানশাইন/টিএ


প্রকাশিত: জানুয়ারি ৯, ২০২৩ | সময়: ৯:৩৪ অপরাহ্ণ | Daily Sunshine