কুয়াশাচ্ছন্ন উত্তরে শীতের কাঁপন

স্টাফ রিপোর্টার : ঘন কুয়াশায় আচ্ছন্ন হয়ে রয়েছে পদ্মা পাড়ের রাজশাহী। রাতের আড়মোড়া ভেঙ্গে সবাই যখন চোখ মেলেছে- ভোরের আলো তখনও ফোটেনি। মঙ্গলবার ভোর ৬টা ৪৯ মিনিটে রাজশাহীতে সূর্যোদয় হয়েছে। তবে দিনভর সূর্যের দেখা মেলেনি। ঘন কুয়াশার চাদরে মুড়ি দিয়ে আছে পুরো ‘রাজশাহী’। ফলে দিনের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা এবং সর্বনিম্ন তাপমাত্রার ব্যবধান কমে এসেছে। আর এই কারণেই বেড়েছে শীতের দাপট।
গত সোমবার সন্ধ্যার পর থেকেই কুয়াশাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে রাজশাহী। রাতে কেবল সড়কের লাইটপোস্টের বাতিগুলো দেখা যায়। কুয়াশার কারণে লাইটপোস্টের আলো সড়কে ছড়াতে পারেনি। যেন ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টির মত নীহার ঝরেছে পুরো শহরে। লোকচলাচল কমে আসায় রাত ৮টার মধ্যেই তাই ফাঁকা হয়ে যায় প্রধান প্রধান সড়ক। রাত যত গভীর হয় কুয়াশা ততই বাড়তে থাকে। এভাবে বিশালাকার এক কুয়াশার কুণ্ড যেন ধীরে ধীরে পুরো প্রকৃতিতে নিজের কোলে টেনে নেয়। ভোরে ঘন কুয়াশার সেই আস্তরণ যেন আবারও গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির মতো পড়তে থাকে। এর সঙ্গে বয়ে চলা উত্তরের হিমেল হাওয়া শরীরে কাঁটা দিচ্ছিল। যতই দিন যাচ্ছে তাপমাত্রার পারদের ওঠানামা ততই যেন বেসামাল হয়ে পড়ছে। হঠাৎ ওপরে উঠছে, হঠাৎ নামছে। তবে এই ঘন কুয়াশা কেটে গেলে কামড় বসাবে শীত। বাড়বে জনদুর্ভোগ। এমনটাই পূর্বাভাস দিচ্ছে আবহাওয়া অফিস।
এদিকে, ঘন কুয়াশার চাদরে প্রকৃতি ঢাকা পড়লেও জীবিকার তাগিদে সেই সাত সকালেই বের হয়েছেন শ্রমজীবী মানুষ। তবে ঘন কুয়াশায় সড়ক-মহাসড়কে যানবাহন চলাচল বিঘ্নিত হচ্ছে। তাই মহাসড়কের দূরপাল্লার যানবাহন চলছে ধীরগতিতে। সকালে দৃষ্টিসীমা ১০০ মিটারের নিচে নেমে আসায় সকালে যানবাহনগুলোকে হেডলাইট জ্বালিয়ে চলাচল করতে দেখা গেছে।
ঘন কুয়াশার কারণে দুর্ঘটনা এড়াতে গতি কমেছে ট্রেনেরও। ফলে পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের আন্তঃনগরসহ বিভিন্ন রুটের ট্রেনের শিডিউল ভেঙে পড়েছে এরই মধ্যে। বিলম্বে চলার কারণে সময় অপচয় হচ্ছে রেলপথ যাত্রীদের। ক’দিন থেকে রাজশাহী-ঢাকা, ঢাকা-রাজশাহী, খুলনা-রাজশাহীসহ বিভিন্ন রুটের আন্তঃনগর ট্রেনগুলোর নির্ধারিত সময় ঠিক রাখা যাচ্ছে না। বিশেষ করে বৈরী আবহাওয়ায় রাজশাহী-ঢাকা ও ঢাকা-রাজশাহী রুটের আন্তঃনগর ট্রেনগুলোর সিডিউল নড়বড়ে হয়ে পড়েছে। আগের মত এখন আর সিডিউলে চলছে না পশ্চিমাঞ্চলের ট্রেন।
আর রাজশাহীসহ গোটা উত্তরের সড়ক পথেও একই অবস্থা। দুর্ঘটনা এড়াতে ভোরে সড়ক-মহাসড়কগুলোতে ছোট-বড় যানবাহনগুলোকে চলাচল করতে হচ্ছে ধীর গতিতে। ফগ লাইট ব্যবহার করেও চালকরা বাসের গতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে হিমশিম খাচ্ছেন। কুয়াশার কারণে অনেক সড়কের বাঁক চোখে পড়ছে না চালকদের। ফলে মাঝে-মধ্যেই আচমকা ব্রেক কষছেন। এতে যাত্রীরা হুমড়ি খেয়ে পড়ছেন সামনের চেয়ারে।
জানতে চাইলে রাজশাহী আবহাওয়া পর্যবেক্ষণগারের জ্যেষ্ঠ পর্যবেক্ষক আবদুস সালাম বলেন, মঙ্গলবার ভোর ৬টায় রাজশাহীতে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ১৩ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আর দুপুর ২টা পর্যন্ত সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ১৬ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এর আগের দিন সোমবার (২ জানুয়ারি) সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল ১১ দশমিক ০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আর রোববার (১ জানুয়ারি) ছিল ১৩ দশমিক ০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আর চলতি মৌসুমের প্রথম দফার মৃদু শৈত্যপ্রবাহ কেটেছে ডিসেম্বরেই। গত ২৯ ডিসেম্বর রাজশাহীর সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিলো ৯ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। যা রাজশাহীতে চলতি মৌসুমের এখন পর্যন্ত সর্বনিম্ন তাপমাত্রা। এরপর তাপমাত্রা অস্বাভাবিকভাবে ওঠানামা করলেও আর এত নিচে নামেনি।
রাজশাহী আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগারের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কামাল হোসেন বলেন, মূলত ঘন কুয়াশা এবং ঠান্ডা বাতাসের কারণেই রাজশাহীতে তীব্র শীতে অনুভূত হচ্ছে। কিন্তু রাজশাহীর ওপর দিয়ে কোনো শৈত্যপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে না। আর কোনো কোনো সময় দিনের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা এবং সর্বোচ্চ তাপমাত্রার ব্যবধান কমে যাচ্ছে। তখন শীত আরও বেশি অনুভূত হচ্ছে। যে কারণে অনেকেই ভাবছেন রাজশাহীতে হয়তো শৈত্যপ্রবাহ বইছে। মূলত এই কুয়াশা কেটে গেলেই শৈত্যপ্রবাহ শুরু হবে। তখন রাজশাহীতে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা আবারও এক অংকে নেমে আসার আশঙ্কা রয়েছে বলেও উল্লেখ করেন-আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগারের এই কর্মকর্তা।
এদিকে, আবহাওয়া অধিদপ্তরের এক পূর্বাভাসে বলা হয়েছে- চলতি জানুয়ারি মাসে দুই থেকে তিনটি শৈত্যপ্রবাহ বয়ে যেতে পারে। তবে এ মাসে শৈত্যপ্রবাহ তীব্র আকার ধারণ করে তাপমাত্রা এক অঙ্কে নেমে আসলেও ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে নামার আশঙ্কা নেই। এ মাসে দেশে দুই থেকে তিনটি শৈত্যপ্রবাহ বয়ে যেতে পারে। এর মধ্যে একটি মাঝারি (৬ থেকে ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস) ধরনের শৈত্য প্রবাহ বয়ে যেতে পারে। আর জানুয়ারি মাসে সামগ্রিকভাবে দেশে স্বাভাবিকের চেয়ে কম বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা আছে।
এছাড়া জানুয়ারি মাসে দেশের উত্তর, উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল, উত্তর-পূর্বাঞ্চল ও মধ্যাঞ্চলে এবং নদ-নদী অববাহিকায় মাঝারি বা ঘন কুয়াশা এবং অন্যত্র হালকা বা মাঝারি কুয়াশা পড়তে পারে। ঘন কুয়াশা পরিস্থিতি কখনো কখনো দুপুর পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে বলেও উল্লেখ করা হয়েছে আবহাওয়ার পক্ষকাল পূর্বাভাসে।
এদিকে ঘন কুয়াশার সঙ্গে কনকনে শীত ও হিমেল বাতাসে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে উত্তরের জনজীবন। গত এক সপ্তাহ থেকে শীতের হানায় কাবু হয়ে পড়েছে এ অঞ্চলের দরিদ্র ও ছিন্নমূল জনগোষ্ঠী। আকাশ ভেঙে ঝরা হিম-ঠাণ্ডা ঘনকুয়াশা অচল করে দিয়েছে জীবনযাত্রা।
নতুন বছরের চলতি সপ্তাহজুড়েই উত্তরাঞ্চলে মৃদু ও মাঝারি শৈত্যপ্রবাহের পূর্বাভাস দিয়েছে আবহাওয়া অফিস।
মঙ্গলবার রংপুরে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড হয়েছে ১১ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আর গতকাল সোমবার রংপুরে জেলায় তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছিলো ১১ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। যা গতকালের চেয়ে শূন্য দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস কম। এবারের শীতে এরই মধ্যে গত তিনদিন থেকে প্রথম দফায় উত্তরাঞ্চলে শৈত্য প্রবাহ চলছে বলে জানিয়েছেন রংপুর আবহাওয়া অফিস। গত দুইদিন থেকে ঘন কুয়াশার সঙ্গে হিমেল হাওয়ায় তীব্র হয়ে উঠেছে কনকনে শীত। বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে জনজীবন। ব্যাহত হচ্ছে স্বাভাবিক কাজকর্ম। ঠাণ্ডায় নাকাল হয়ে পড়ছে চরাঞ্চলসহ ছিন্নমূলের অসহায় মানুষজন।
আবহাওয়া অফিস বলছে, শীতের এ তীব্রতা দুই এক দিনের মধ্যে আরও বাড়তে পারে। এদিকে ঘন কুয়াশা আর কনকনে শীত চেপে বসেছে তিস্তা, ঘাঘট, দুধকুমার, যমুনেশ্বরী ও করতোয়া নদী বেষ্টিত এলাকাগুলোতে। একদিকে কনকনে শীত আর বেলা গড়িয়ে যাওয়ার সাথে সাথে শুরু হয় ঠাণ্ডা বাতাস। রংপুর অঞ্চলে বেলা দুপুর নাগাদ সূর্যের দেখা মিললেও নেই তেমন উষ্ণতা। এই অঞ্চলে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ওঠানামা করছে ১০ থেকে ১১ ডিগ্রিতে । নদী তীরবর্তী বেশির ভাগ এলাকার মানুষ খড়কুটো জ্বালিয়ে শীত নিবারণের চেষ্টা করছেন। শীতের এই হানায় প্রভাব ফেলেছে কৃষকের ধানের বীজতলাতেও। হিমেল বাতাস শীতের তীব্রতা অনেকাংশে বাড়িয়ে দিয়েছে। ঘন কুয়াশার কারণে হেড লাইট জ্বালিয়ে চলাচল করছে যানবাহন।
রংপুর নগরীর তাজহাট এলাকার সুমন আওলাদ বলেন, গত দুই রাত থেকে এতো পরিমানে কুয়াশা পড়ছে যে হাঁটলেই চোখের পাতা ও মাথার চুল ভিজে যাচ্ছে। চলার সময় সামনের ১০ হাত পরের কিছুই দেখা যায়না। এই কুয়াশার সাথে বাতাসটা একদম আমাদেরকে কাবু করে ফেলেছে।
নগরীর নগরমীরগঞ্জ এলাকার কৃষক মনিরুজ্জামান বলেন, গত দুই দিন থেকে যে পরিমানে শীত পড়ছে তাতে আমাদের কৃষি কাজ অনেকটা ব্যহত হচ্ছে। ধানের বীজতলা ঘনকুয়াশায় হলুদ রঙ ধারণ করে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। আলুর ক্ষেতের কাজে কোনো লোক পাওয়া যাচ্ছে না। তিনি বলেন, শীতে যখন জমিনে খালি পা রাখি মনে হয় মরি গেছি। কিন্তু উপায় নাই কাজ করি খাওয়া লাগবে তাই বের হইছি। এবারের শীতে হাত পা খালি টাটায় মনে হয় অবশ হয়ে গেছে।
রংপুর আবহাওয়া অফিসের ইনচার্জ আবহাওয়াবিদ মোস্তাফিজুর রহমান জানান, ডিসেম্বরের শেষে উত্তরাঞ্চলে শৈত্য প্রবাহ শুরু হয়েছে। এর সাথে শীতের তীব্রতাও খুব বেড়েছে। এই অঞ্চলে গত তিন চার দিন থেকে তাপমাত্রা ১০-১১ ডিগ্রির মধ্যে ওঠানামা করছে। দিনে ও রাতের তাপমাত্রা কাছাকাছি হওয়ায় এ অঞ্চলে ঘনকুয়াশার সাথে হিমেল হাওয়াসহ শৈত্য প্রবাহ আরও তীব্র হতে পারে। তবে এই তাপমাত্রা আগামী দুই তিন দিনের মধ্যে কিছুটা উন্নতি হওয়ার সম্ভাবনা আছে।
সরকারি হিসেবে মোট জনসংখ্যার ৪০ভাগ দরিদ্র। পশ্চাদপদ এই অঞ্চলে দারিদ্র আরও কিছুটা ভয়াবহ। এবারের তীব্র এই শীত গৃহহীন ছিন্নমূল মানুষের জীবনে নেমে নেমেছে দুর্বিসহ কষ্ট হয়ে। হিমালয়ের কাছাকাছি হওয়ায় দেশের শীতপ্রবণ এলাকা হিসাবে পরিচিত এই রংপুর অঞ্চল।


প্রকাশিত: জানুয়ারি ৪, ২০২৩ | সময়: ৫:২২ পূর্বাহ্ণ | সুমন শেখ