সর্বশেষ সংবাদ :

নাটকীয় বিকেলের রোমাঞ্চ নিয়ে স্মরণীয় সকালের অপেক্ষা

স্পোর্টস ডেস্ক: একেকটি উইকেটের পতনে যেন একেকটি মহোৎসব! বাংলাদেশের বোলার-ফিল্ডারদের দিগ্বিদিক ছুটোছুটি আর বাঁধনহারা উদযাপন। গ্যালারিতে থাকা হাজার পাঁচেক দর্শকের গর্জন। প্রতিটি উইকেটে মিশে আছে যেন সম্ভাবনার সুবাস। অভাবনীয় এক জয় কী তাহলে ধরা দিচ্ছে! এই রোমাঞ্চ নিয়েই শেষ হলো মিরপুর টেস্টের তৃতীয় দিন। এই হাতছানিতে শুরু হবে চতুর্থ সকাল।
জয়ের জন্য ভারতের প্রয়োজন ১০০ রান, বাংলাদেশের প্রয়োজন ৬ উইকেট। এই সমীকরণে সাধারণ দৃষ্টিতে হয়তো এগিয়ে ভারত। কিন্তু এই ম্যাচের যে বাস্তবতা, উইকেটের যে অবস্থা, চতুর্থ ইনিংসের চাপ আর পারিপার্শ্বিকতা, সব মিলিয়ে সম্ভাবনায় সমান কিংবা এগিয়ে হয়তো বাংলাদেশই। দিনের খেলা শেষে সংবাদ সম্মেলনে লিটন দাস তো কণ্ঠে জোর নিয়েই বললেন, এই মুহূর্তে এগিয়ে তারাই।
অথচ এই ম্যাচের শুরু থেকেই বাংলাদেশ পড়ে থেকেছে পেছনে। প্রথম দুই দিন তো বটেই, ভারতের দাপট ছিল তৃতীয় দিনের দুই সেশন, এমনকি তৃতীয় সেশনের শুরুর ভাগেও। কিন্তু সেশনের শেষ ঘণ্টায় মেহেদী হাসান মিরাজ ও সাকিব আল হাসানের দুর্দান্ত বোলিংয়ে ম্যাচ দাঁড়িয়ে এখন এমন মোড়ে, যেখান থেকে বাংলাদেশের জয় খুবই সম্ভব।
প্রথম ইনিংসে ৮৭ রানে পিছিয়ে থাকা বাংলাদেশ দ্বিতীয় ইনিংসে করতে পারে ২৩১ রান। ওপেনিংয়ে জাকির হাসানের ফিফটির পর ছয়ে নেমে লিটন দাস খেলেন ৭৩ রানের গুরুত্বপূর্ণ ইনিংস। প্রবল চাপের মধ্যে পাল্টা আক্রমণে ক্যামিও ইনিংস খেলেন নুরুল হাসান সোহান। লিটনের সঙ্গে ৬০ রানের মহামূল্য জুটি গড়েন তাসকিন আহমেদ।
১৪৫ রানের লক্ষ্য তারপরও খুব বড় হওয়ার কথা ছিল না। কিন্তু সেই পুঁজিতেই ম্যাচ জমিয়ে তোলে বাংলাদেশ। প্রতিপক্ষ অধিনায়ক লোকেশ রাহুলকে ফিরিয়ে শুরুটা করেন বাংলাদেশ অধিনায়ক সাকিব আল হাসান। এরপর অসাধারণ বোলিংয়ে ভারতের টপ অর্ডার ভেঙে দেন মেহেদী হাসান মিরাজ।
শেষ বিকেলের মরে আসা আলোয় এই অফ স্পিনারের বোলিংয়ের কোনো জবাব পাননি ভারতের দুর্দান্ত সব ব্যাটসম্যানও। একে একে তিনি শিকার করেন শুবমান গিল, চেতেশ্বর পুজারা ও বিরাট কোহলিকে। ভারতের রান তাড়ার শুরুটাই হয় নাটকীয়। সাকিবের বল লাগে শুবমান গিলের পায়ে, জোরাল আবেদনে আঙুল তোলেননি আম্পায়ার। প্রচণ্ড ক্ষিপ্ত প্রতিক্রিয়া দেখিয়ে তখনই রিভিউ নেন সাকিব। কিন্তু দেখা যায়, বল চলে যাচ্ছিল লেগ স্টাম্পের বাইরে দিয়ে।
উইকেট আসতে অবশ্য খুব বেশি সময় লাগেনি। তৃতীয় ওভারেই সাকিব ফেরান রাহুলকে, উইকেটের পেছনে দারুণ ক্যাচ নেন সোহান। সাকিব আর তাইজুল ইসলাম নতুন বলে টানা ৭ ওভার করেন দুই পাশ থেকে। উইকেট না পেলেও তাইজুল ৩ ওভারে রান দেন ১। তার প্রান্ত থেকে অষ্টম ওভারে আক্রমণে এসে প্রথম বলেই পুজারাকে বিদায় করেন মিরাজ।
ব্যাটিং অর্ডারে একটু বদল এনে আকসার প্যাটেলকে চারে নামায় ভারত। দলের প্রতিষ্ঠিত ব্যাটসম্যানদের ছাপিয়ে সবচেয়ে সাবলিল ব্যাটিং করেন এই অলরাউন্ডারই। দলের অর্ধেকের বেশি রান এ দিন আসে তার ব্যাট থেকেই। আরেকপাশে বিরাট কোহলিকে প্রবলভাবে চেপে ধরেন বাংলাদেশের বোলাররা। বেশ কয়েকবার অল্পের জন্য রক্ষা পেয়ে শেষ পর্যন্ত ভারতীয় গ্রেট আউট হন ২২ বলে ১ করে। মিরাজের বলে শর্ট লেগে দুর্দান্ত ক্যাচ নেন মুমিনুল হক।
আউট হওয়ার পর ড্রেসিং রুমে ফেরার পথে হঠাৎ খমকে দাঁড়ান কোহলি। উদযাপনরত বাংলাদেশের ফিল্ডারদের দিকে তাকিয়ে ক্ষুব্ধ হয়ে কিছু বলতে দেখা যায় তাকে। দ্রুত এগিয়ে আসেন আম্পায়াররা, এগিয়ে গিয়ে তার সঙ্গে কথা বলেন সাকিবও। মাঠ ছাড়ার সময়ও বেশ ক্ষিপ্ত দেখা যায় তাকে।
আকসার ও নাইটওয়াচম্যান জয়দেব উনাদকাট মিলে বাকি সময়টা কাটিয়ে দেন। শেষের মতো দিনের শুরুটাও ছিল ঘটনাবহুল। দিনের দ্বিতীয় বলে মোহাম্মদ সিরাজকে দারুণ এক স্ট্রেট ড্রাইভে চার মারেন জাকির হাসান। কিন্তু দ্বিতীয় ওভারেই বিদায় নেন নাজমুল হোসেন শান্ত। রবিচন্দ্রন অশ্বিনের স্কিড করা বল পেছনের পায়ে খেলার ভুলের খেসারত দেন তিনি।
পরের উইকেটও ধরা দেয় দ্রুতই। সিরাজকে ফ্লিক করে চার মারার পরের বলে অফ স্টাম্প ঘেঁষা ডেলিভারিতে উইকেটের পেছনে ক্যাচ দেন মুমিনুল হক। প্রথম ইনিংসে ৮৪ রানের দারুণ ইনিংস খেলা ব্যাটসম্যান এবার করতে পারেন স্রেফ ৫ রান।
ম্যাচে দ্বিতীয়বারের মতো চার নম্বরে ব্যাট করতে নেমে দলকে এগিয়ে নিতে পারেননি সাকিব আল হাসানও। সিরাজের বলে দৃষ্টিনন্দন একটি কাভার ড্রাইভে চার মারলেও বাংলাদেশ অধিনায়ক খুব স্বস্তিতে খেলতে পারছিলেন না। তার বিদায়েও মিশে থাকল সেই রেশ। জয়দেব উনাদকাটের প্রথম ওভারেই তিনি বিদায় নেন ঝুঁকিপূর্ণ ড্রাইভের পথ বেছে নিয়ে। পিচ করে থমকে আসা বল সহজ ক্যাচ যায় কাভারে।
শেষ নয় সেখানেই। লাঞ্চের একটু আগে আরও একটি বড় ধাক্কা হজম করে বাংলাদেশ। হতাশায় ভরা সিরিজের শেষ ইনিংসটিতে মুশফিকুর রহিম ফেরেন স্রেফ ৯ রানে। এক প্রান্তে সঙ্গীদের নিয়মিত হারিয়েও আরেক প্রান্তে জাকির রয়ে যান অবিচল। টেম্পারমেন্টের পরীক্ষায় উতরে লাঞ্চে যান তিনি ৯৬ বলে ৩৭ রান নিয়ে।
বিরতির পর ফিরে প্রত্যাশার পথ ধরে এগিয়েই পঞ্চাশে পা রাখেন তিনি ১২৯ বলে। আগের টেস্টে সেঞ্চুরির পর এবার ফিফটি, দুটিই দলের দ্বিতীয় ইনিংসে চাপের মধ্যে। বাংলাদেশের হয়ে অভিষেক টেস্টে শতরানের পর দ্বিতীয় টেস্টে ফিফটি আগে ছিল কেবল আমিনুল ইসলামের।
তবে ফিফটির পর আর নিজেকে ধরে রাখতে পারেননি জাকির। গোছানো ইনিংসের শেষটা হয় হতাশাজনক শটে। উমেশ যাদবের বাইরের বল স্ল্যাশ করে ধরা পড়েন তিনি ডিপ থার্ডম্যানে (১৩৫ বলে ৫১)। একটু পর বাজে শটে বিদায় নেন মেহেদী হাসান মিরাজও (০)।
১১৩ রানে তখন ৬ উইকেট নেই বাংলাদেশের, লিড স্রেফ ২৬ রানের। আটে নেমে তখন পাল্টা আক্রমণের পথ বেছে নেন নুরুল হাসান সোহান। উমেশকে স্কয়ার ড্রাইভে চার মারার পর অশ্বিনকে উড়িয়ে মারেন মাথার ওপর দিয়ে। আরেক পাশে লিটনের ব্যাটেও দেখা যায় দ্রুত রানের তাড়া। জীবনও পান দুজনই। ২৭ রানে উইকেটের পেছনে ক্যাচ দিয়ে বেঁচে যান সোহান, লিটন রক্ষা পান ২০ রানে।
জীবন পাওয়ার পর অবশ্য আর বেশিক্ষণ টিকতে পারেননি সোহান। স্টাম্পড হয়ে যান ২৯ বলে ৩১ রান করে। জুটি থামে ৪৬ রানে। বাংলাদেশকে ম্যাচে জিইয়ে রাখে পরের জুটি। তাসকিন উইকেটে গিয়ে খেলতে থাকেন বিশেষজ্ঞ ব্যাটসম্যানের মতো। লিটন তো ততক্ষণে জমে গেছেন। ৪৯ রানে আরও একবার জীবন পান তিনি কোহলির হাতে। সিরিজে প্রথম ফিফটি স্পর্শ করেন তিনি ৭৪ বলে।
চা বিরতির আগে তাসকিনের বাউন্ডারিতে লিড পেরিয়ে যায় শতরান। শেষ সেশন শুরু হয় সিরাজের বলে লিটনের বাউন্ডারিতে। লিড বাড়তে থাকে দ্রুত। জুটি ভাঙতে প্রয়োজন ছিল হয়তো বিশেষ কিছু। সিরাজের হাত থেকে বের হয় তেমনই এক ডেলিভারি। পিচ করে তীক্ষ্ণভাবে ভেতরে ঢোকা বল লিটনকে সম্ভিত করে উড়িয়ে দেয় বেলস।
৯৮ বলে ৭৩ রানে শেষ হয় লিটনের ইনিংস। এই বছর শেষ করলেন তিনি তিন সংস্করণ মিলিয়ে ১ হাজার ৯২১ রান নিয়ে। বাংলাদেশের হয়ে এক পঞ্জিকাবর্ষে ১ হাজার ৭০০ রানও আগে করতে পারেননি কেউ। জুটি থামে ৬০ রানে, ম্যাচে বাংলাদেশের একমাত্র অর্ধশত রানের জুটি।
এরপর আর বেশিদূর এগোয়নি ইনিংস। তাসকিন অপরাজিত থেকে যান ৩১ রানে। লিটন-তাসকিন-সোহানদের সেই ব্যাটিং থেকেই গোটা দল খুঁজে নেয় লড়াইয়ের প্রেরণা। ক্রমে যা রূপ নেয় সত্যিকারের বিশ্বাসে। জয়ের বিশ্বাস! বছরের শুরুতে নিউ জিল্যান্ডের বিপক্ষে স্মরণীয় এক জয় পেয়েছিল বাংলাদেশ। বছরের শেষেও এখন উঁকি দিচ্ছে তেমন এক জয়ের সম্ভাবনা।


প্রকাশিত: ডিসেম্বর ২৫, ২০২২ | সময়: ৫:৫৫ পূর্বাহ্ণ | সুমন শেখ