সর্বশেষ সংবাদ :

হারার আগে লড়ার পালা ব্যাটসম্যানদের

স্পোর্টস ডেস্ক: সেঞ্চুরিটি বহুকাঙ্ক্ষিত ছিল দুজনের জন্যই। টেস্টে ১৮টি সেঞ্চুরি করেও আরেকটির অপেক্ষায় কাতর ছিলেন চেতেশ্বর পুজারা। প্রায় ৪ বছর আর পঞ্চাশের বেশি ইনিংস ধরে ছিল না তার শতরান। শুবমান গিলের অপেক্ষা ছিল সাদা পোশাকের অভিজাত জগতে তিন অঙ্কের জাদুকরি সংখ্যার প্রথম স্পর্শের। ভারতের অভিজ্ঞ ও তরুণ দুই ব্যাটসম্যান মিলে ব্যক্তিগত প্রাপ্তিতে নিজেদের রাঙানোর পাশাপাশি পূরণ করেছেন দলের চাওয়াও। এরকম ব্যক্তিগত নানা সমীকরণ আছে তো বাংলাদেশ দলের অনেকের জন্যও!
খেলাটা যদিও দলের জন্যই। তবে চট্টগ্রাম টেস্টে বাংলাদেশের দলীয় লক্ষ্য আপাতত দৃষ্টিসীমায় নেই। ১৮০ ওভার ব্যাট করা কিংবা আরও ৪৭১ রান, যাবতীয় ক্রিকেটীয় অনিশ্চয়তা মাথায় রেখেও বলা যায় অসম্ভবের কাছাকাছি। তাহলে এই টেস্টে বাংলাদেশের সামনে এখন লক্ষ্যটা কি? উত্তরটা সাধারণ। লড়াই করা। টিকে থাকা। ছোট ছোট পদক্ষেপে এগিয়ে যাওয়া। ব্যক্তিগত মাইলফলকের পথে ছুটে পারিপার্শ্বিকতার সঙ্গে বোঝাপড়া করা। সেই চেষ্টায় যদি ম্যাচটাকে দীর্ঘায়িত করা যায়, পঞ্চম দিনে বয়ে নেওয়া যায়, ভারতীয় অধিনায়কের কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলা যায়, লড়াইয়ের বিজ্ঞাপন মেলে ধরা যায়, কিছু প্রাপ্তি তো তাহলে হলো!
ক্রিকেট খেলাটাই এমন, ২২ গজে নামার পর লড়াইটা অনেকটাই ব্যক্তিগত। প্রতিপক্ষের বোলিং আর কৌশলের সঙ্গে নিজের লড়াই। এই টেস্টের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা এখন ব্যাপারটাকে এভাবেই দেখতে পারেন। তাদের সবারই তো ব্যক্তিগত চাওয়া-পাওয়া কম নেই!
অভিষিক্ত জাকির হাসানের কথাই ধরা যাক। এই টেস্টে ভালো কিছু করতে না পারলেও কাঠগড়ায় তাকে তোলা হবে না। তবে অভিষেকে রান পেলে তার নিজের সামনে চলার পথ সুগম হবে অবশ্যই। বিশেষ করে, চোট কাটিয়ে যখন ফিরবেন নিয়মিত ওপেনার তামিম ইকবাল, আরেকটি জায়গার লড়াই তখন জমে উঠবে আরও। জাকির যদি সেই লড়াইয়ে নিজেকে রাখতে চান, প্রতিটি সুযোগই গুরুত্বপূর্ণ।
প্রথম ইনিংসে থিতু হয়েও ইনিংস বড় করতে পারেননি মুশফিকুর রহিম। নাজমুল হোসেন শান্তর জন্য হয়তো আপাতত এটিই শেষ সুযোগ। গত বছর শ্রীলঙ্কায় ও জিম্বাবুয়েতে দুটি সেঞ্চুরির পর মনে হচ্ছিল, তার টেস্ট ক্যারিয়ার গতি পেয়ে গেছে। কিন্তু এরপর থেকেই শুরু উল্টো যাত্রা! সবশেষ সেঞ্চুরির পর এই ইনিংসের আগ পর্যন্ত ২০ ইনিংসে তার ফিফটি স্রেফ একটি। টানা ১৫ ইনিংস ধরে ফিফটিই নেই।
তার পরও যে এই টেস্টে তাকে নামানো হয়েছে এবং ওপেন করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, অনেক প্রশ্নের অবকাশ আছে সেটি নিয়েই। প্রথম ইনিংসে প্রথম বলে আউট হয়ে প্রশ্নগুলিকে আরও উচ্চকিত করার সুযোগ করে দিয়েছেন তিনিই। দ্বিতীয় ইনিংসে ভালো কিছু করতে পারলে হয়তো প্রশ্নগুলি স্তিমিত হবে।
সবচেয়ে কঠিন কাজটা এর মধ্যেই করে ফেলেছেন জাকির ও শান্ত। তৃতীয় দিন শেষ বিকেলে ১২ ওভারের বিপজ্জনক সময়টা উতরে গেছেন দুজনই। চ্যালেঞ্জ কিছু থাকবে চতুর্থ দিন সকালেও। তবে আগের দিনের আত্মবিশ্বাস তো সঙ্গী, নতুন দিনের চ্যালেঞ্জেও জয়ী না হওয়ার কারণ নেই।
হাতছানি আছে ইয়াসির আলি চৌধুরির জন্যও। চোট-আঘাতের ধাক্কা সামলে এটি তার ফেরার টেস্ট। সেখানেই পেয়েছেন তিন নম্বরে ব্যাট করার গুরু ভার। সেটিও নিজ শহরের মাঠে নিজেদের দর্শকের সামনে। প্রথম ইনিংসে সুযোগটি তিনি হেলায় হারিয়েছেন আলগা শট খেলে। সুযোগ আরেকটি আছে এই ইনিংসে।
এমনিতে প্রক্রিয়া অনুসরণ করলে তাকে তিন নম্বরে খেলার সুযোগ আরও দেওয়ার কথা। কিন্তু বাংলাদেশ ক্রিকেট আর প্রক্রিয়া, এই দুটি পাশাপাশি থাকে কম সময়ই। ইয়াসির তাই এই সুযোগ সহসাই আর পাবেন কিনা, কে জানে! ঘরোয়া ক্রিকেটের অনেক অভিজ্ঞ তিনি, প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে রেকর্ড বেশ সমৃদ্ধ। রান করেছেন বাংলাদেশ ‘এ’ দলেও। এবার ছাপ রাখার সুযোগ তার টেস্ট ক্রিকেটেও।
জাকির-শান্ত-ইয়াসির, তিনজনের কেউ এখনও আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে প্রতিষ্ঠিত নন। ভারতের মতো বড় প্রতিপক্ষের সঙ্গে চতুর্থ ইনিংসের প্রবল চাপে ভালো কিছু করতে, দল যেমন তাদের ওপর আস্থা পাবে, তারা নিজেও পাবেন সামনে চলার পাথেয়।
প্রথম ইনিংসে লিটন দাসকে নামানো হয় চার নম্বরে, টেস্ট ক্যারিয়ারে প্রথমবার। গত বছর থেকে টেস্ট ক্রিকেটে তার যে দুর্দান্ত ধারাবাহিকতা, সেটিরই পুরস্কার বলা চলে। শুরুটা দারুণ করেও তিনি তা ধরে রাখতে পারেননি দ্বিতীয় দিনে। নতুন পজিশনে পুরনো চেহারায় আবির্ভুত হওয়ার সুযোগ আবার পাবেন তিনি দ্বিতীয় ইনিংসে।
চারে সুযোগ হয়তো তার মিলবে সামনেও। তবে এই ম্যাচের প্রেক্ষাপটে বড় কিছু করতে পারলে, এই পজিশনেও তিনি আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠতে পারবেন দ্রুত। মুশফিকুর রহিম ও সাকিব আর হাসানের জন্য এই পরিস্থিতি কিংবা বাস্তবতা, নতুন নয় কিছুই। তবে এমন কঠিন চ্যালেঞ্জে স্মরণীয় কোনো ইনিংস খেলা বা বড় কোনো সেঞ্চুরিতে প্রতিপক্ষের ঘাম ঝরানো, এমন কিছু দুজনের কারও ক্যারিয়ারে নেই খুব একটা।
মুশফিক নিজের সবশেষ দুই টেস্টেই করেছেন সেঞ্চুরি। ক্যারিয়ারে তার ডাবল সেঞ্চুরি আছে তিনটি। কিন্তু সত্যিকারের বিশ্বমানের টেস্ট ইনিংস খুব বেশি নেই। তার ক্যারিয়ারের পরিচায়ক হয়ে ওঠা, বিশ্ব ক্রিকেটকে সত্যিকার অর্থে নাড়া দেওয়া একটি ইনিংস খেলার সুযোগ আবারও আছে তার সামনে এই টেস্টে।
প্রায় সাড়ে ৫ বছর ধরে টেস্ট সেঞ্চুরির স্বাদ পান না সাকিব আল হাসান। সাকিব তো টেস্ট সেঞ্চুরির দেখা পান না সাড়ে ৫ বছর ধরে। এই টেস্টে চোটের কারণে তিনি বোলিং করতে পারেননি প্রথম দিনের পর। ব্যাট হাতে প্রথম ইনিংসে আউট হয়েছেন দৃষ্টিকটূভাবে। অধিনায়কের জন্য এই ম্যাচে ছাপ রাখার শেষ সুযোগ চতুর্থ ইনিংসের ব্যাটিং। নুরুল হাসান সোহান নিজের সবশেষ দুই টেস্টেই ফিফটি করেছেন। তবে দলের বাস্তবতায় প্রতিটি টেস্ট তার জন্য জায়গা ধরে রাখার লড়াই। এই টেস্টে একটি ভালো ইনিংস তার পরের টেস্ট যেমন নিশ্চিত করবে, হয়তো তাকে নিয়ে আরও বেশি বাজি ধরার বিশ্বাসও জোগাবে।
এই মাঠেই গত বছর টেস্ট সেঞ্চুরির স্বাদ পেয়েছেন মেহেদী হাসান মিরাজ। ব্যাটিংয়ে এ বছর যেমন নিজেকে নতুনভাবে চিনিয়েছেন তিনি, সেই পরিচয়কে আরও উজ্জ্বল করার আরেকটি সুযোগ এই ম্যাচে। সব মিলিয়ে কিছু না কিছু সমীকরণ আছে সবার জন্যই। এক ইনিংসে সবার ব্যক্তিগত চাওয়া-পাওয়া এক বিন্দুতে মিলবে না অবশ্যই। তবে দুই-তিনজনও যদিও পারেন, বাকিরা সঙ্গ দেন কিছুটা, তাহলেই তো বাংলাদেশ করে ফেলতে পারে দারুণ কিছু!
সেই ‘দারুণ’ কিছু মানে টেস্ট জয় কিংবা বাঁচিয়ে ফেলাই শুধু নয়। ব্যাপারটি লড়াইয়ের। হাল না ছাড়ার। হার না মানা মানসিকতার। চোয়ালবদ্ধ প্রতিজ্ঞার। ব্যাপারটি দেখিয়ে দেওয়ার যে, লড়াইটি একপেশে নয়। ক্রিকেট মাঠে জয়-পরাজয় থাকেই। কিন্তু লড়াই করতে না পারার কারণ থাকতে পারে না। ব্যাপারটি অহমের। দেশের মাঠে পর্যদুস্ত না হওয়ার, নিজেদের মেলে ধরার তাড়নার।


প্রকাশিত: ডিসেম্বর ১৮, ২০২২ | সময়: ৪:৫৬ পূর্বাহ্ণ | সুমন শেখ