রাজশাহী ডিসির পরামর্শে বদলে গেলো রুপান্তরিত নারী বৃষ্টির জীবন

স্টাফ রিপোর্টার :

পড়ন্ত বিকেলে পদ্মাপাড়ে লাল শাড়ি পরে ছিলেন রূপান্তরিত নারী বৃষ্টি হানি। প্রতিদিনই বিক্রি করেন লাল গোলাপ। পায়ে হেঁটে পদ্মাপাড়ে আসা দর্শনার্থীদের ফুল বিক্রি করেন তিনি। এর আগে মানুষের কাছে জোরজবরদস্তি ও চেয়েচিন্তে টাকা নিতেন। তবে জীবন-জীবিকার এমন পরিবর্তনের কারণ জানতে চাইলে রাজশাহী জেলা প্রশাসকের (ডিসি) পরামর্শের কথা জানান রুপান্তরিত এই নারী।
রাজশাহী নগরীর শ্রীরামপুর টি-বাঁধ এলাকার মৃত জব্বার শেখের সন্তান বৃষ্টি হানি। চার ভাই বোনের মধ্যে বৃষ্টি মেজো। রাজশাহী পুলিশ লাইনস স্কুলে পঞ্চম শ্রেনী পর্যন্ত চুকিয়েছেন শিক্ষার পাঠ। পড়াশোনার ই”েছ থাকলেও সহপাঠীদের বিরূপ আচরণে শিক্ষার আলো থেকে ছিটকে পরেন বৃষ্টি।

রুপান্তরিত নারী বৃষ্টি জানান, ১০ বছর বয়সে তিনি বুঝতে পারেন নিজের মধ্যে লুকিয়ে থাকা মেয়েলি আচরণের কথা। এনিয়ে স্কুলে ছেলেদের বেঞ্চে বসতে গিয়ে কটু কথা শুনতে হতো তাকে। ছেলেরা পাশে বসতে দিতো না। করতো উতক্ত আর বসতে বলতো মেয়ের সাথে। এসব ঘটনা শিক্ষকদের জানালেও লাভ হয়নি। উল্টো লাঞ্ছনা-বঞ্জনার শিকার হতে হয়েছে তাদের কাছেও। তাই কটু কথার তিক্ততায় বিদ্যাপিঠ ছাড়তে হয় তাকে। নিজের নারীসুলভ আচরণের কথা জানার পর জড়িয়ে পড়েন হিজড়া গোষ্ঠীর সাথে। তারপর তাদের সাথেই ভালো-মন্দ কাজে জড়িয়ে পড়েন।

তবে দিনের আলো হিজড়া সংঘের সাথে যুক্ত হওয়ার পর বদলে যেতে থাকে বৃষ্টি হানির জীবন। সরকার কর্তৃক রুপান্তরিত নারীদের নিয়ে জেলা প্রশাসন, আর্ন্তজাতিক সংগঠন ও দেশী-বিদেশী বিভিন্ন সংগঠনের সাথে সভা-সমিতিতে অংশগ্রহণ করেন তিনি। এভাবে রূপান্তরিত নারীদের অপরাধমূলক কাজ ও সমাজে হাত পেতে কিংবা জোরপূর্বক অর্থ দাবি করার মতো গর্হিত কাজ থেকে সরে আসেন তিনি।
করোনাকালীন সময়ের একটি সেমিনারে রাজশাহী জেলা প্রশাসক আব্দুল জলিল নিগৃত কাজ থেকে সরে আসতে আহব্বান জানান তাদের। এতে সাড়া দেন বৃষ্টি হানি। বদলে ফেলেন জীবন ও জীবিকা।

ফুল বিক্রির বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, দিনের আলো হিজরা সংঘের সদস্য হওয়ায় আমি জেলা প্রশাসনের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যাই। সেখানে জেলা প্রশাসক আব্দুল জলিল স্যার আমিসহ সকলকে হাত পেতে কিংবা জোরপূর্বক নেওয়ার চেয়ে কর্ম করে খাওয়ার পরামর্শ দেন। সকল ধরনের খারাপ কাজ থেকে দূরে থাকার কথা বলেন। তিনি সব সময় আমাদের ভালো পরামর্শ দেন। উনার পরামর্শ আমার ভালো লাগায় আমি আর মানুষের কাছে হাত পাতি না। চেয়ে চিন্তে টাকা নেওয়ার বদলে এখন আমি ফুল বিক্রি করে আমার জীবন চালায়।
বৃষ্টি বলেন, রুপান্তরিত নারীদের ব্যাপারে জেলা প্রশাসক মহোদয় অনেক সহযোগিতা করেন। আমাদের সরকারিভাবে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন সাহায্য সহযোগিতা দেন তিনি। আবার করোনার সময় তিনি আমাদের ক্ষুধার্ত রাখেননি। আমাদের চাল, ডাল, তেল, চিনি, সাবান, মাস্ক সহ বিভিন্ন সাহায্য-সহযোগিতা করেছেন। এজন্য আমরা তার কাছে অনেক কৃতজ্ঞ।

তবে ভালো পথে আসার জন্য শুধু ডিসি স্যারই নন, আমাদের ‘দিনের আলো হিজরা সংঘ’ নামক প্রতিষ্ঠানটিও অনেক সহযোগিতা করে। আমরা এই সংগঠনের মাধ্যমে ভালো ভালো কাজের সাথে যুক্ত হতে উৎসাহ পায়। আমার মতো অনেকেই খারাপ কাজ ছেড়ে ভালো পথে সম্মানের সাথে জীবন শুরু করার চেষ্টা করছেন বলেও জানান বৃষ্টি হানি।

ফুল বিক্রির বিষয়ে বৃষ্টি জানান, আগে কারো কাছে হাত পেতে চাইলে কিংবা জোরপূর্বক টাকা নিলে তার খুব খারাপ লাগতো। তবে এখন ফুল বিক্রি করে অনেক সম্মানের সাথে জীবন-যাপন করছেন তিনি। তিনি প্রতিদিন ৬০ থেকে ৭০ টা ফুল বাজার থেকে দুপুর বেলা কিনে আনেন। এরপর সেগুলোকে বাড়িতে ঠিকঠাক করে একটি লাল বালতিতে নিয়ে বিকেলে সাজসজ্জা করে বের হন। এক একটা ফুলের দাম নেন ১০ টাকা করে। তবে কেউ তার বেশি দিতে চাইলে আপত্তি করেন না। তবে ছুটি কিংবা উৎসবের দিনগুলো পদ্মাপাড় থাকে আনন্দে উৎসব মুখর। এসব দিনগুলোতে বৃষ্টি শ’খানেক ফুল নিয়ে বের হন। দিন শেষে শ’পাঁচেক টাকার লাভ থাকলে তাতেই খুশি রুপান্তরিত নারী বৃষ্টি হানির।
এব্যাপারে দিনের আলো হিজরা সংঘের সভাপতি মোহনা বলেন, আমরা সমাজের অবহেলিত নারী সমাজ। সমাজে আট-দশটা মানুষের মতো যেনো আমরাও মাথা তুলে দাঁড়াতে পারি সে লক্ষ্যে দিনের আলো হিজরা সংঘ নামে একটি সংঘের প্রতিষ্ঠা করি। এ সংঘের মাধ্যমে রুপান্তরিত নারীদের দেশি-বিদেশী ও সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সভা-সমিতির মাধ্যমে ভালো কাজের জন্য আসার জন্য প্রশিক্ষণ ও অনুপ্রেরণামূলক অনুষ্ঠানে নিয়ে যায়। এক্ষেত্রে সরকারের পক্ষ থেকে জেলা প্রশাসন আমাদের প্রচন্ড সহযোগিতা করেন। বিশেষ করে রাজশাহী জেলা প্রশাসক আব্দুল জলিল মহোদয়।

ভালো পরামর্শের মাধ্যমে রুপান্তরিত নারী বৃষ্টির জীবন বদলে দেবার বিষয়ে রাজশাহী জেলা প্রশাসক মো. আব্দুল জলিল বলেন, ‘তৃতীয় লিঙ্গের যারা জনগণ আছে তারা তো সমাজে বিভিন্নভাবে অবহেলিত। তারা চাকরি, ব্যবসা বা মানুষের সহযোগিতার ক্ষেত্রেই বলেন না কেনো, তারা অনেকটা বাঁধাবিপত্তির সম্মুখীন হচ্ছে। আমি জেলা প্রশাসক হিসেবে যতটুকু করণীয় তা করি, উপরš‘ তাদের কাউন্সিলিং করি। শুধু বৃষ্টি হানিই নয়, তাদের মতো অনেকের জীবন এখন বদলাতে শুরু করেছে।
‘আবার তাদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থাও করে থাকি। ইতিমধ্যে দুজন শিক্ষিত তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ আমাদের এখানে কাজ করছে। তারা প্রতিমাসে ৭ হাজার টাকা করে বেতন পাচ্ছে। এছাড়াও মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর তরফ থেকে যে আর্থিক ও ত্রাণ সহায়তা রয়েছে সেখান থেকেও তাদের অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে’ বলেও জানান তিনি।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমি জেলা প্রশাসক হিসেবে তাদের কয়েক দফায় তাদের সহযোগিতা করেছি এবং আমার যতদূর মনে পড়ে করোনার সময় যখন তাদের জীবন-জীবিকা থমকে গিয়েছিল তখন তাদের আমি খাদ্য সহায়তাসহ কিছু আর্থিক সহায়তাও করেছিলাম। তখন বলেছিলাম- এভাবে জীবনযাপন না করে তোমরা এই সহযোগিতার মাধ্যমে নতুনভাবে জীবন শুরু করো। এরপর থেকে দেখেছি তাদের মধ্যেও একটা অনুকম্পা বা মানসিক পরিবর্তনটা এসেছে যে, মানুষের কাছে থেকে হাত পেতে বা জোর করে টাকা নিয়ে জীবনযাপন করছে তা আসলে প্রকৃত জীবন না। তারাও সম্মানজনকভাবে বাঁচতে চাই। এজন্য সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর যে নির্দেশনা- সমাজের সকলকে নিয়ে একটা অন্তর্ভূক্তীমূলক উন্নয়ন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। সেই লক্ষ্যে আমরা কাজ করে যাচ্ছি ।’

 

সানশাইন/তারেক


প্রকাশিত: ডিসেম্বর ৭, ২০২২ | সময়: ৮:১৭ অপরাহ্ণ | Daily Sunshine