গাইবান্ধার রিটার্নিং অফিসারসহ শতাধিক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে ইসি

সানশাইন ডেস্ক: গাইবান্ধা উপ নির্বাচনে দায়িত্বে অবহেলা ও অনিয়মে সম্পৃক্ততার কারণে রিটার্নিং অফিসার, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক, প্রিজাইডিং অফিসার, পুলিশের উপ-পরিদর্শক, নির্বাহী হাকিমসহ শতাধিক ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা ও নির্বাচনী এজেন্টের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে নির্বাচন কমিশন।
তবে কোনো ধরনের অনিয়মে সম্পৃক্ততার প্রমাণ না পাওয়ায় প্রার্থী, জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হয়নি। প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল বৃহস্পতিবার আগারগাঁওয়ের নির্বাচন ভবনে সাংবাদিকদের কাছে ইসির সিদ্ধান্ত তুলে ধরেন। অপর নির্বাচন কমিশনাররা এবং ইসি সচিব এ সময় উপস্থিত ছিলেন।
সিইসি বলেন, দায়িত্বে অবহেলার জন্য গাইবান্ধা উপ নির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তা ইসির আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা সাইফুল ইসলামের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। একজন প্রিজাইডিং অফিসারকে দুই মাসের জন্য সাময়িক বরখাস্ত করার পাশাপাশি পুলিশের পাঁচজন এসআইয়ের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দেওয়া হবে। ১২৫ জন প্রিজাইডিং কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে স্ব স্ব মন্ত্রণালয়ে, এডিসি ও একজন নির্বাহী হাকিমের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে সুপারিশ করবে ইসি।
আর ১৪৫ কেন্দ্রের নির্বাচনী এজেন্টদের আর কখনও ভোটের দায়িত্ব না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে জানান সিইসি। তিনি বলেন, সুপারিশ অনুযায়ী সবার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হল কি না, এক মাসের মধ্যে তা কমিশনকে জানাতে বলা হয়েছে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোকে। গত ১২ অক্টোবর গাইবান্ধা-৫ আসনের উপ-নির্বাচনে ইভিএমে ভোটগ্রহণের মধ্যে সিসি ক্যামেরায় পুরো আসনের এক-তৃতীয়াংশ কেন্দ্রে অনিয়মের দৃশ্য দেখে মাঝপথে ঢাকা থেকে নির্বাচন বন্ধের নির্দেশ দেয় ইসি।
বাংলাদেশে নির্বাচন কমিশনের ইতিহাসে অনিয়মের কারণে কোনো সংসদীয় আসনের নির্বাচন বন্ধ করার ঘটনা এটাই প্রথম। এরপর প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল অনিয়মে সম্পৃক্তদের চিহ্নিত করতে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে দেন। ইসির অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমারকে আহ্বায়ক করে গঠিত ওই কমিটিতে ইসির যুগ্ম সচিব (প্রশাসন ও অর্থ) মো. কামাল উদ্দিন বিশ্বাসকে সদস্য এবং যুগ্ম সচিব (চলতি দায়িত্ব) মো. শাহেদুন্নবী চৌধুরীকে সদস্য সচিব করা হয়।
সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল সে সময় বলেছিলেন, “অপেক্ষা করেন। আমরা তদন্ত কমিটি করেছি; রিপোর্টটা আসুক। তারপরে আপনারা দেখেন আমরা কোনো পদক্ষেপ নিই কিনা। ওয়েট অ্যান্ড সি।” তদন্ত কমিটিকে মোট চারটি বিষয়ে কাজ করতে বলা হয়েছিল। গাইবান্ধায় নিয়ে ছয় শতাধিক ব্যক্তির সাক্ষ্য নিয়ে তারা প্রতিবেদন দেয়, যার ভিত্তিতে এ ব্যবস্থা নেওয়া হল।
এই প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে সাবেক সিইসি ও নির্বাচন কমিশনারদের সঙ্গেও বৈঠক করে পরামর্শ নেয় হাবিবুল আউয়ালের কমিশন। আগামীর জন্যে অনিয়মের বিরুদ্ধে কঠোর বার্তা দিতে কমিশনের অবস্থানকে সাধুবাদ জানান সাবেকরা।
ইসির ১০ সিদ্ধান্ত: তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, ১২৫টি কেন্দ্রের প্রিজাইডিং কর্মকর্তা দায়িত্ব পালনে অবহেলা করেছেন। তাদের নামের তালিকা স্ব-স্ব নিয়ন্ত্রণকারী/নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো হবে। নিয়ন্ত্রণকারী/নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ দায়িত্ব পালনে অবহেলা তথা অসদাচারণের কারণে তাদের বিরুদ্ধে চাকরি বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নিয়ে কমিশনকে এক মাসের মধ্যে অবহিত করবে।
এই উপ নির্বাচনে ৯৪ নম্বর কেন্দ্রের প্রিজাইডিং কর্মকর্তা উদয়ন ডিগ্রি কলেজের প্রভাষক মো. সাইফুল ইসলামকে ১৯৯১ সালের নির্বাচন কর্মকর্তা (বিশেষ বিধান) আইনের ৫(৩) ধারা অনুযায়ী চাকরি থেকে ২ মাসের জন্য সাময়িক বরখাস্ত করা হবে। যথাযথ কর্তৃপক্ষ এ সিদ্ধান্ত কার্যকর করবে এবং এক মাসের মধ্যে কমিশনকে অবহিত করবে।
দায়িত্বপালনে অবহেলা ও অসদাচারণের কারণে পাঁচ পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে চাকরি বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নিয়ে কমিশনকে এক মাসের মধ্যে অবহিত করতে হবে। তারা হলেন-২ নম্বর কেন্দ্রে দায়িত্বে থাকা গোবিন্দগঞ্জ থানার এসআই তরুণ কুমার, ৫৪ নম্বর কেন্দ্রে দায়িত্বে থাকা গোবিন্দগঞ্জ থানার এসআই আবদুল্লাহ আল মামুন, ৫৯ নম্বর কেন্দ্রে দায়িত্বে থাকা গোবিন্দগঞ্জ থানার এসআই আনিছুর রহমান, ৬২ নম্বর কেন্দ্রে দায়িত্বে থাকা সাদুল্যাপুর থানার এসআই কনক রঞ্জন বর্মন এবং ১০৫ নম্বর কেন্দ্রে দায়িত্বে থাকা পঞ্চগড়ের আটোয়ারী থানার এএসআই দুলাল হোসেন।
অসাদাচরণের কারণে অতিরিক্ত জেলা প্রশাশক (সার্বিক) সুশান্ত কুমার সাহার বিরুদ্ধে নির্বাচন কর্মকর্তা (বিশেষ বিধান) আইনের ৫ ধারা অনুসারে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে। এক্ষেত্রেও এক মাসের মধ্যে ইসিকে অবহিত করতে হবে।
ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের ‘অবৈধ আদেশ’ পালন করায় নির্বাচন কমিশন সচিবালয় একজন সহকারী কমিশনারকে (নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট, তদন্ত প্রতিবেদনে নাম উল্লেখ করা হয়নি) ভবিষ্যতের জন্য সতর্ক করে চিঠি দেওয়া হবে। রিটার্নিং কর্মকর্তা সাইফুল ইসলামের (আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা, রাজশাহী) বিরুদ্ধে নির্বাচন কর্মকর্তা (বিশেষ বিধান) আইন, ১৯৯১ এর ধারা ৫ অনুযায়ী দায়িত্ব পালনে অবহেলার জন্য বিভাগীয় ব্যবস্থা নেবে নির্বাচন কমিশন সচিবালয়। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিয়ে এক মাসের মধ্যে কমিশনকে অবহিত না করলে কমিশন কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে নির্বাচন কর্মকর্তা আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবে।
সকল কেন্দ্রে দায়িত্বপালনকারী নির্বাচনী এজেন্টদের তালিকা প্রিসাইডিং কর্মকর্তার সীল করা ব্যাগে রয়েছে। যেহেতু নির্বাচন বন্ধ করা হয়েছে এবং এ আদালতের কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই, তাই যেসব কেন্দ্রে অভিযোগ প্রমানিত হয়েছে সেসব কেন্দ্রের ব্যাগ খুলে দায়ী এজেন্টদের একটি তালিকা তৈরি করতে হবে। জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা, গাইবান্ধা এই তালিকা করবেন। দোষী নির্বাচনী এজেন্টদেরকে পরবর্তী নির্বাচনে এজেন্ট হিসেবে নিয়োগ করা যাবে না। ভবিষ্যতে নির্বাচনে কোনো ধরনের অনিয়ম করা হলে দায়ীদের বিরুদ্ধে আইনের ‘কঠোরতম ধারায়’ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। গাইবান্ধা -৫ আসনের পুনর্র্বিবাচন যথাসময়ে অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করা হবে।
আইন কী বলে: ১৯৯১ সালের নির্বাচন কর্মকর্তা (বিশেষ বিধান) আইনে বলা হয়েছে-৫ (১) কোন নির্বাচন-কর্মকর্তা নির্বাচন সংক্রান্ত কোনো ব্যাপারে কমিশন বা ক্ষেত্রমত রিটার্নিং অফিসারের কোনো আদেশ বা নির্দেশ পালনে ইচ্ছাকৃতভাবে ব্যর্থ হলে বা অস্বীকৃতি প্রকাশ করলে বা নির্বাচন সংক্রান্ত কোনো আইনের বিধান ইচ্ছাকৃতভাবে লঙ্ঘন করলে বা এর অধীন কোনো অপরাধ করলে তিনি অসদাচরণ করেছেন বলে এবং চাকরি বিধি অনুযায়ী তা শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে বিবেচিত হবে।
(২) কোনো নির্বাচন-কর্মকর্তা উপ-ধারা (১) এ উল্লিখিত অসদাচরণ করলে তার নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ তাকে চাকরি থেকে অপসারণ বা বরখাস্ত করতে পারবে বা বাধ্যতামূলক অবসর দিতে পারবে বা তার পদাবনতি করতে পারবে বা তার পদোন্নতি বা বেতন বৃদ্ধি অনধিক দুই বৎসরের জন্য স্থগিত রাখতে পারবে। ওই শাস্তি উপ-ধারা (১) এ উল্লিখিত ব্যর্থতা, অস্বীকৃতি, লঙ্ঘন বা অপরাধের জন্য অন্য কোনো আইনে নির্ধারিত কোনো দণ্ড বা এর জন্য কোনো আইনগত প্রক্রিয়াকে ব্যাহত বা রূদ্ধ করতে পারবে না।
(৩) কোনো নির্বাচন-কর্মকর্তা এ আইনের উপ-ধারা (১) অনুযায়ী ‘অসদাচরণ’ কলে কমিশন বা ক্ষেত্রমত কমিশনের সম্মতিক্রমে রিটার্নিং অফিসার তার বিরুদ্ধে চাকরিবিধি অনুযায়ী শৃঙ্খলামূলক ব্যবস্থা হিসেবে অনধিক দুই মাসের জন্য সাময়িকভাবে চাকরি থেকে বরখাস্তের আদেশ দিতে পারবেন এবং ওই আদেশ তার নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ দিয়েছে বলে গণ্য হবে৷
(৪) উপ-ধারা (১) এ উল্লিখিত অসদাচরণের জন্য কোনো নির্বাচন-কর্মকর্তার বিরুদ্ধে শৃঙ্খলামূলক ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য কোনো কর্তৃপক্ষকে কমিশন বা রিটার্নিং কর্মকর্তা অনুরোধ করলে সেই কর্তৃপক্ষ এ অনুরোধ পাওয়ার এক মাসের মধ্যে তা বাস্তবায়ন করবে এবং সে বিষয়ে কমিশনকে অবহিত করবে৷
পুনঃভোটের তারিখ আগামী সপ্তাহে: সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেন, গাইবান্ধা-৫ আসনে পুনঃভোটের তারিখ আাগামী সপ্তাহে জানানো হবে। ভোটের আগে খুবই সংক্ষিপ্ত সময় দেওয়া হবে। তিনি জানান, কবে ভোট হবে ও কারা দায়িত্বে থাকবেন তা জানানো হবে। ভোটে থাকবেন আগের প্রার্থীরাই।
আওয়ামী লীগের মাহমুদ হাসান নৌকা প্রতীক নিয়ে, জাতীয় পার্টির (জাপা) এএইচএম গোলাম শহীদ লাঙ্গল মার্কা নিয়ে, বিকল্প ধারার জাহাঙ্গীর আলম কুলা প্রতীক নিয়ে এবং স্বতন্ত্র প্রার্থী নাহিদুজ্জামান আপেল, স্বতন্ত্র প্রার্থী সৈয়দ মাহবুবুর রহমান ট্রাক প্রতীক নিয়ে লড়ছেন এ নির্বাচনে।


প্রকাশিত: ডিসেম্বর ২, ২০২২ | সময়: ৬:৩১ পূর্বাহ্ণ | সুমন শেখ