মানবসেবার ফেরিওয়ালা একজন রাহী

স্টাফ রিপোর্টার: হাসপাতালের বিছানায় মুমূর্ষু রোগী। জরুরিভাবে তার জন্য রক্তের প্রয়োজন। কোনোভাবে শুধু সেই খবর কানে আসতে দেরি, ছুঁটে যেতে দেরি নেই তার। জরুরি ওষুধ লিখে দিয়েছেন চিকিৎসক। কিন্তু টাকাও নেই, লোকও নেই। খবর পেতেই তিনি সেই ওষুধ হাতে হাজির। কারও বাবা-মা বৃদ্ধ, অসুস্থ বা পক্ষাঘাতগ্রস্ত। বিছানা থেকে উঠে চলাফেরা করতে পারেন না। একটি হুইলচেয়ার হলে অন্ততঃ ঘরের মধ্যে চলতে-ফিরতে পারবেন। কিন্তু কেনার সামর্থ্য নেই! তা জানতেই হুইলচেয়ার নিয়ে তার বাড়িতে হাজির। কেউ মারা গেছেন। কিন্তু দাফন-কাফনের কেউ নেই? খবর পেলেই দল বেঁধে সেখানে হাজির।
হ্যাঁ, এমনই এক তরুণের নাম আল-রশিদ রাহী। মাত্র ৩০ বছর বয়স। রাজশাহী শহরে থাকেন, কোনো না কোনোভাবে জনসেবার সাথে জড়িত- এমন কেউ নেই যে, তার নাম জানেন না। অথচ নিরবে, নিভৃতে কোনো আদিখ্যেতা ছাড়াই না পাওয়া, না খাওয়া, বঞ্চিত, শোষিত, স্বজনহারা মানুষের সেবা করে চলছেন এই যুবক। ছিন্নমূল মানুষদের নিজের পরিবার-পরিজন করে তুলেছেন। খুব বেশি যে, সামর্থ্য আছে তা কিন্তু না। এরপরও যেটুকু আছে তা দিয়েই ঝাঁপিয়ে পড়েন অন্যের বিপদে। মানুষের জন্য, মানবতার জন্য নিজের তারুণ্যকে বিলিয়ে দিতে চান এই যুবক।
কেবল ডাক দিয়ে পাওয়া জরুরি সেবা-ই নয়, সব ধরনের মানবিক সেবায় জড়িয়ে আছে তার নাম। করোনাকালে রোগীদের অক্সিজেন সিলিন্ডার ও ওষুধ সরবরাহ করতে গিয়ে নিজেই তিনবার পজিটিভ হন। এরপরও দমে যাননি। করোনার থাবায় মৃত্যুমুখ থেকে ফিরে আবারও নেমে পড়েন মানুষের সেবায়। এরই মধ্যে পথচারী ও ছিন্নমূল-বাস্তুহারা মানুষের জন্য করেছেন- ‘২ টাকার হোটেল’। কাজ জানেন কিন্তু অসহায় এমন মানুষদের জন্য করেছেন ‘সাবলম্বী প্রকল্প’। নিরক্ষর ভাসমান পথশিশুদের সাক্ষরজ্ঞান দিতে পরিচালনা করছেন করেছেন- ‘২ ঘণ্টার স্কুল’। অসহায় মানুষদের সেবার জন্য নিজেরাই গড়েছেন ‘মাটির ব্যাংক’। মানুষের জন্য কিছু করার দীক্ষা পেয়েছেন বাবা-মায়ের কাছ থেকেই। আর কাজটি শুরু করেছিলেন একা। এরপর ধীরে ধীরে গড়েছেন বিশাল এক স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী। তাদের বেশিরভাগই ছাত্র এবং অল্পসংখ্যক চাকুরে। রাজশাহীতে ২০০ এবং গোটা দেশে তারা এখন ৫০০ জনের একটি তরুণ স্বেচ্ছাসেবক দল।
আল-রশিদ রাহী রাজশাহী শহরের ১৯ নম্বর ওয়ার্ডের আসাম কলোনি এলাকার অধিবাসী। সেখানেই কথা হয় তার সাথে। জানাতে চাইলে দীর্ঘ আলাপচারিতায় শোনান- এই অল্প বয়সে একজন অদম্য স্বেচ্ছাসেবক হয়ে ওঠার মর্মস্পর্শী গল্প। বলেন- অনেক কান্না, আহাজারি আর সীমাহীন কষ্টে থাকা মানুষের সাক্ষ্য হওয়ার কথা। বেশি না হলেও কম দিয়ে পাশে দাঁড়িয়েছেন বা থাকছেন এমন সব অসম লড়াইয়ে টিকে থাকার কথা।
বলেন- চহিদার পাল্লা ভারি। কিন্তু সেবার পাল্লা হালকা। আমাদের অগোচরে কষ্টে থাকা মানুষের সংখ্যাই বেশি। কিন্তু সেই তুলনায় সেবা করার সামর্থ্য অনেক কম। এরপরও অসহায় মানুষদের পাশে দাঁড়নোর প্রাণপণ চেষ্টা থাকে তাদের।
বলেন- তাদের সেবা কার্যক্রমের নাম ‘ঐবষঢ় চবড়ঢ়ষব’ অর্থাৎ সাহায্যকারী মানুষ বা মানুষকে সাহায্য করুন। শুধুমাত্র সেবার ব্রত নিয়েই এর কার্যক্রম শুরু। এটি কোনো সংগঠন বা সংস্থা নয়। একটি স্বেচ্ছাসেবক দল। এর শুরুটা হয় ২০১৭ সালে। তবে স্কুল জীবন থেকেই মানুষের উপকারে আসতে পারলে নিজের কাছে ভালো লাগতো রাহীর। স্কুল জীবনে নিজের টিফিনের টাকা বাঁচিয়েও অনেকের সহযোগিতা করেছেন।
যখন কলেজে পা রাখেন তখন একটা চিন্তা তার মাথায় ঘুরপাক খায়। রাহীর মাথায় আসে সামান্য মোবাইল সিমের জন্য ‘কল সেন্টার’ বা ‘গ্রাহক সেবা’ থাকে। সেখানে সব সমস্যার সমাধান মেলে। ইশ্ এমন একটা সেবা সেন্টার যদি করা যেতো যেখানে মানুষ সব সেবা পাবেন। তাহলে কতই না ভালো হতো। এক ফোনেই সব সমাধান! কিন্তু তা ছিল স্বপ্নের মতই। এখনও স্বপ্ন হয়েই আছে। তবে এই চিন্তা থেকেই ‘ঐবষঢ় চবড়ঢ়ষব’ ব্যানার তৈরি করেন। সেই ব্যানারে ধীরে ধীরে তার মত সেবার মানসিকতা থাকা তরুণদের একাট্টা করেন।
ফেসবুকে পেজ খুলে জানান দেন- তারা অসহায়দের সেবা করতে চান। তাদের কাছে এখন- জরুরি ওষুধ, রক্ত, বিশুদ্ধ খাবার পানি, খাবার, হুইলচেয়ার, টিউবওয়েল, অসহায় রোগাক্রান্ত রোগীর সেবা, বন্যা দুর্গত এলাকার জন্য জরুরি ত্রাণসহ হাজারো সেবা প্রদানের জন্য ফোন আসে। যতটুকু সামর্থ্য কুলোয় ততটুকু সেবা নিয়ে তিনি ও তার স্বেচ্ছাসেবক দল ছুঁটে যান বিপদগ্রস্ত এসব মানুষের দুয়ারে। তাই দুর্গতদের জন্য তারা এরই মধ্যে সেবার ফেরিওয়ালা হয়ে উঠেছেন, হয়ে উঠেছেন আস্থার প্রতীক।
কিন্তু সেবা করতে হলেও অর্থ লাগে। সেই অর্থ কোথায় পান? এই প্রশ্নে আল-রশিদ রাহী বলেন, তিনি সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ডিপ্লোমা করার পর বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে শুরু করেন। কিন্তু সেবা কার্যক্রম এবং করোনাকালে তার শিক্ষা কার্যক্রমের গতি মন্থর করে দেয়। তবে বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিং শেষ করবেন। বর্তমানে আউট সোর্সিং করছেন এবং নিজের অর্থলগ্নি করা ছোট একটি ব্যবসা থেকে কিছু টাকা আসে। সব মিলিয়ে যা পান তার একটা বড় অংশ সেবার জন্য দেন। আর বাকি টাকা তার বিদেশে থাকা আত্মীয়-স্বজন, দেশে থাকা চিকিৎসক, ব্যবসায়ী ও শুভাকাঙ্ক্ষীদের ডোনেশনে চলে। তাকে বা তাদের কার্যক্রম সম্পর্কে যারা জানেন তারাই বিভিন্ন সময় অর্থ দিয়ে তাদের সহযোগিতা করেন। এই অর্থ তারা আর্তমানবতার সেবায় খরচ করেন। এছাড়া তারা নিজেদের জন্মদিন ও ঈদসহ বিভিন্ন উৎসব বা উদযাপনের খরচ সংকোচন করেন। সেই টাকা বাঁচিয়ে সেবার জন্য অর্থের যোগান দেন।
যেমন তার নিজের বিয়ের কথাই উল্লেখ করেন রাহী। তিনি বলেন, দেশে দ্বিতীয় লকডাউনের আগে তার বিয়ে ঠিক হয় পারিবারিক ভাবেই। সবাই বিয়েতে অনুষ্ঠান করতে চাইলেও তার চিন্তা ছিলো ভিন্ন। তিনি তার বিয়েতে কোনো অনুষ্ঠান করেন নি। কেননা নিজের বিয়ের অনুষ্ঠানের চেয়ে অভুক্ত মানুষগুলোর মুখে খাবার তুলে দেওয়ার বিষয়টা তার কাছে জরুরি মনে হয়েছিল। তাই পরিবার থেকে তার বিয়েতে খরচে যে অর্থ যোগান রেখেছিলেন সেখান থেকে ১ লাখ টাকা হেল্প পিপল’কে দেন। ওই টাকায় সেই সময় করোনায় কর্ম হারিয়ে ফেলা কিছু পরিবার অন্ততঃ ১ মাস চলতে পারবে এমন খাদ্য পৌঁছে দিয়েছিলেন।
কার্যক্রম সম্পর্কে জানাতে গিয়ে রাহী বলেন, এই কয়েক বছরের মধ্যে হেল্প পিপলে আরও অনেক ভলেন্টিয়ার ও শুভাকাঙ্ক্ষী যুক্ত হয়েছে। যত বেশি মানুষের সাপোর্ট পেয়েছেন ততই এগিয়ে গিয়েছেন, মানুষের জন্য নতুন কিছু করতে পেরেছেন। নিজের ভবিষ্যতের কথা না ভেবে এখনও কাজ করে যাচ্ছেন। এর মধ্যে ২ টাকার হোটেলে প্রতিমাসে ২/৩ বার ১৫০ জন দুঃস্থ মানুষের জন্য খাবার রান্না হয়। যেখানে মাত্র ২ টাকা দিয়ে আত্মসম্মানের সাথে সবাই পেট পুরে বিরিয়ানি খেতে পারেন। সাবলম্বী প্রকল্পের মাধ্যমে অসহায় নারীদের সেলাইমেশিন দেওয়া হয়, কোনো পঙ্গু বা অসহায় মানুষ ছোট ব্যবসা করতে চাইলে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করা হয়।
২ ঘণ্টার স্কুলে সপ্তাহে বস্তি ও রেল স্টেশন এলাকার ছিন্নমূল ও পথশিশু এবং কিশোর-কিশোরীদের সাক্ষরজ্ঞান অর্জনে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। মাটির ব্যাংকের মাধ্যমে বেওয়ারিশ মরদেহ দাফন, ওষুধ ও জরুরি প্রয়োজনে খাবার সরবরাহসহ প্রয়োজনীয় সেবা কার্যক্রম চালানো হয়। সর্বশেষ তারা প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপে সিলেটের বন্যা দুর্গতদের পাশে দাঁড়ান। সিলেটের সুনামগঞ্জ, ভোলাগঞ্জ, বালাগঞ্জ, জাফলং, জকিগঞ্জ, ডাখরা, উপশহর ও দুর্গম বরইকান্দির মানুষের জন্য প্রায় ৩ লাখ টাকার খাবার ও জরুরি ওষুধ পৌঁছে দিতে পেরেছেন বলে জানান আল-রশিদ রাহী।
ভবিষ্যতের ইচ্ছে কী প্রশ্নে আল-রশিদ রাহী বলেন, ‘বাবা-মা-ই আমার অনুপ্রেরণা। মাহীন নামের একটি ছোট ভাই আছে। আর অর্ধাঙ্গিনী হিসেবে যাকে পেয়েছি সেও মানবহিতৈষী। তাই ইচ্ছে আছে এই কার্যক্রম আরও অনেক দূর নিয়ে যাওয়া। সামান্য হলেও কিছু বঞ্চিত মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর চেষ্টা করা। আমি হয়তো একদিন মারা যাবো। কিন্তু এই কার্যক্রম যেনো বন্ধ না হয়। সেই ব্যবস্থা করা। মানুষের মুখে টুকরো হাসি ফোটানোর দায়িত্ব দিয়ে যাবো আমার তৈরী করা সৈনিকদের ওপর। যাতে করে মানুষের জন্য মানুষের ভালোবাসা প্রবাহমান থাকে’।


প্রকাশিত: আগস্ট ২৩, ২০২২ | সময়: ৬:১১ পূর্বাহ্ণ | সুমন শেখ