সর্বশেষ সংবাদ :

দরিদ্র-অসচ্ছল ৩৯.৫ শতাংশ পরিবার টিসিবির কার্ড পায়নি

সানশাইন ডেস্ক: ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) ফ্যামিলি কার্ড যারা পাননি তাদের ৮০.৪ শতাংশই অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে বাদ পড়েছেন। তাদের মধ্যে ৩৪.৪ শতাংশ নারী ও ৩১.৪ শতাংশ পুরুষ। এছাড়া যারা এরই মধ্যে দুই হাজার ৫০০ টাকা নগদ সহায়তা পেয়েছিলেন তাদের ৩৯.৫ শতাংশ ফ্যামিলি কার্ড পাননি।
বৃহস্পতিবার প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষে আয়োজিত ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য তুলে ধরেন সংস্থার গবেষক মোহাম্মদ নূরে আলম মিন্টু। এ সময় টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামানসহ অন্যরা উপস্থিত ছিলেন। প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে ঢাকা ও বরিশালকে বাদ দিয়ে ৩৫টি জেলায় চালানো গবেষণার ভিত্তিতে। পাঁচ সদস্যের গবেষক দলসহ সংগঠনটির অন্য সদস্যরা এ গবেষণায় অংশ নেন।
প্রতিবেদন উপস্থাপনের সময় নূরে আলম মিন্টু বলেন, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয়, করোনাকালে প্রধানমন্ত্রীর ঈদ উপহার হিসেবে নগদ অর্থসহায়তা দেওয়ার জন্য ৫০ লাখ পরিবারের একটি তালিকা করা হয়েছিল। প্রাথমিক তালিকায় পেনশনার, সরকারি চাকরিজীবী, স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের নাম থাকায় তা নিয়ে বিতর্ক দেখা দিলে যাচাই-বাছাই শেষে ৩৫ লাখ পরিবারকে নগদ সহায়তা দেওয়া হয়। পরে সড়ক পরিবহন, নৌ-পরিবহন শ্রমিক, নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আরও সাড়ে তিন লাখ মানুষকে নগদ সহায়তা দেয় সরকার।
রমজানে যে এক কোটি পরিবারকে ফ্যামিলি কার্ডের মাধ্যমে খাদ্যসহায়তা দেওয়ার কথা ছিল, তাদের মধ্যে নতুন সাড়ে ৩৮ লাখ পরিবারকে অন্তর্ভুক্ত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। তবে এ গবেষণার জরিপে প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, জরিপে অংশগ্রহণকারী উত্তরদাতাদের মধ্যে যারা এরই মধ্যে দুই হাজার ৫০০ টাকা নগদ সহায়তা পেয়েছিলেন তাদের ৩৯.৫ শতাংশ ফ্যামিলি কার্ড পাননি।
যারা কার্ড পাননি তাদের ৮০.৪ শতাংশকে অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে বাদ দেওয়া হয়েছে। ৫.৫ শতাংশ স্বেচ্ছায় কার্ড নেননি। জরিপে দেখা যায়, নারী উত্তরদাতাদের ৩৪.৪ শতাংশ ও পুরুষ উত্তরদাতাদের ৩১.৪ শতাংশ অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে ফ্যামিলি কার্ড এর তালিকা থেকে বাদ পড়েছেন।
তিনি বলেন, জরিপে ফ্যামিলি কার্ড না পাওয়া উত্তরদাতাদের মতে কার্ড না পাওয়ার উল্লেখযোগ্য কারণ হচ্ছে তালিকাভুক্তির ক্ষেত্রে স্বচ্ছতার ঘাটতি বা তথ্য প্রচারে ঘাটতি। নগদ সহায়তাপ্রাপ্ত সব উপকারভোগীকে যে এ কার্ড পাওয়ার কথা ছিল, এ বিষয়ে তাদের কোনো ধারণা ছিল না। এমনকি ফ্যামিলি কার্ড কার্যক্রম সম্পর্কেও তাদের কোনো ধারণা ছিল না। এছাড়া তালিকা থেকে বাদ পড়ার অন্যান্য কারণের মধ্যে রয়েছে- কারও সুপারিশ বা তদবির জোগাড় করতে না পারা, রাজনৈতিক বিবেচনায় স্বচ্ছল ব্যক্তিদের তালিকাভুক্তি, একই পরিবারে একাধিক কার্ড দেওয়া, ছবি পরিবর্তন করে তালিকাভুক্ত ব্যক্তিদের কার্ড অন্যদের দিয়ে দেওয়া, ঘুষ দিতে না পারা ইত্যাদি।
টিআইবি জানায়, দুই হাজার ৫০০ টাকা নগদ সহায়তাপ্রাপ্ত উপকারভোগীর সব পরিবার এ কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার কথা ছিল। তবে সংশ্লিষ্ট একটি দপ্তর থেকে জানানো হয় যে, নগদ সহায়তা কর্মসূচির তালিকা থেকে বিভিন্ন পেশাজীবী (লকডাউনে কর্মহীন হয়ে পড়া পরিবহন শ্রমিক, পেশাজীবী ইত্যাদি) আট লাখ ৫০ হাজার পরিবারকে বাদ দিয়ে এ তালিকার ৩০ লাখ পরিবারকে ফ্যামিলি কার্ড দেওয়া হয়েছে। কোন বিবেচনায়-প্রক্রিয়ায় এই সাড়ে আট লাখ পরিবারকে বাদ দেওয়া হয়েছে ও বর্তমান অর্থনৈতিক অবস্থা যাচাইপূর্বক তাদের বাদ দেওয়া হয়েছে কিনা তা জানা যায়নি। ফ্যামিলি কার্ড সংশ্লিষ্ট প্রজ্ঞাপন ও পরিপত্রেও এ ধরনের কোনো নির্দেশনা লক্ষ্য করা যায়নি। একদিকে পুরোনো তালিকা থেকে সাময়িকভাবে কর্মহীন হয়ে পড়া বিভিন্ন পেশার দরিদ্র পরিবারকে বাদ দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে নতুন তালিকা প্রণয়নে একই ধরনের পেশাজীবীদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ব্যবস্থাপনায় দুর্নীতি, অনিয়মের কারণে অনেকে বঞ্চিত হয়েছেন। যারা বঞ্চিত হয়েছে তারাও বলেছেন অনিয়ম-দুর্নীতির কারণেই বঞ্চিত হয়েছেন। এক্ষেত্রে নারীরাই বেশি বঞ্চিত হয়েছেন। তালিকা প্রণয়নেই বেশি অনিয়ম হয়েছে। যাদের ফ্যামিলি কার্ড পাওয়ার কথা নয়, তারাও পেয়েছেন। ভবিষ্যতেও দেশের জন্য বিভিন্ন ধরনের উদ্যোগ নিতে হবে। স সময় যাতে আমাদের গবেষণায় পাওয়া বিষয়গুলোর প্রতি নজর দেওয়া হয়।
জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে উপকারভোগীদের প্রাথমিক তালিকা তৈরির পর ওয়ার্ড সভার মাধ্যমে স্থানীয় জনগণের মতামতের ভিত্তিতে তালিকা চূড়ান্ত করতে হবে। এক্ষেত্রে নারী, প্রতিবন্ধী ব্যক্তি, দলিত, আদিবাসী, প্রভৃতি প্রান্তিক ও দুর্গম এলাকার জনগোষ্ঠী অন্তর্ভুক্তির বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে।
উপকারভোগীর চূড়ান্ত তালিকা স্থানীয় পর্যায়ে (ইউনিয়ন, উপজেলা, জেলা ও সিটি করপোরেশন) প্রকাশের ব্যবস্থা করতে হবে। সারাদেশ থেকে সংগৃহীত মোট উপকারভোগীর তালিকা মন্ত্রণালয়/টিসিবির ওয়েবসাইটে প্রকাশ করতে হবে।
শুধু দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের মাধ্যমে ফ্যামিলি কার্ড বিতরণ করতে হবে ও বিতরণের সময়, তারিখ, স্থান ইত্যাদি তথ্য সবপর্যায়ে প্রচারের ব্যবস্থা করতে হবে। বিনামূল্যে তালিকাভুক্তি ও কার্ড বিতরণে অর্থ লেনদেন না করার বিষয়ে উপকারভোগীদের সচেতন করতে মাঠ পর্যায়ে বিভিন্ন ধরনের সচেতনতামূলক কার্যক্রম (এসএমএস পাঠানো, ফ্যামিলি কার্ডে সচেতনতামূলক তথ্য মুদ্রণ করে দেওয়া ইত্যাদি) পরিচালনা করতে হবে। এ ধরনের ঘটনা সংঘটিত হলে কোথায় অভিযোগ জানাতে হবে তা প্রচার করতে হবে।
উপকারভোগীদের চাহিদা-সামর্থ্য যাচাইয়ের মাধ্যমে প্যাকেজে পণ্যের ধরন, পরিমাণ ও মূল্য নির্ধারণ করতে হবে। প্যাকেজভিত্তিক পণ্য বিক্রির পাশাপাশি অতিদরিদ্র ব্যক্তি যাদের প্যাকেজের সব পণ্য একসঙ্গে ক্রয়ের সক্ষমতা নেই তাদের চাহিদা-সামর্থ্য অনুযায়ী স্বল্প পরিমাণে পণ্য বিক্রির ব্যবস্থা রাখতে হবে। পণ্যের গুণগতমান, পরিমাণ, কেন্দ্র কিংবা পয়েন্ট খোলা থাকার সময় ও অবস্থান পরীবিক্ষণে ‘ট্যাগ টিম’-এর কার্যক্রম জোরদার করতে হবে।
বিক্রয় কেন্দ্রের কিংবা পয়েন্টের সংখ্যা বাড়াতে হবে ও এসব কেন্দ্র নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর কাছাকাছি নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। প্যাকেজে পণ্যের ধরন, পরিমাণ, নির্ধারিত মূল্য ইত্যাদি তথ্য বিক্রয়কেন্দ্রে প্রদর্শন করতে হবে। অভিযোগ দায়ের করার সুবিধার্থে টিসিবি ও সংশ্লিষ্ট দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তির হটলাইন নম্বর, নাম, ঠিকানা ও ফোন নম্বর ইত্যাদি প্রদর্শন করতে হবে।
তালিকাভুক্তি ও সাশ্রয়ীমূল্যে পণ্য বিক্রির ক্ষেত্রে অনিয়ম-দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। উপকারভোগীদের প্রণীত তালিকা ও তালিকা প্রস্তুত প্রক্রিয়া নিয়ে একটি স্বাধীন নিরীক্ষার উদ্যোগ নিতে হবে ও দ্রুত সময়ের মধ্যে তালিকায় অন্তর্ভুক্ত স্বচ্ছল পরিবারগুলোকে বাদ দিতে হবে।


প্রকাশিত: আগস্ট ১২, ২০২২ | সময়: ৫:৫৯ পূর্বাহ্ণ | সুমন শেখ