টেক্সাসের স্কুলে ঢুকে গুলি, ১৯ শিশুসহ নিহত ২১

সানশাইন ডেস্ক: যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাস অঙ্গরাজ্যের একটি প্রাথমিক স্কুলে নির্বিচারে গুলির ঘটনায় ২১ জনের প্রাণ গেছে, যাদের মধ্যে ১৯ জন ওই স্কুলের শিক্ষার্থী। বিবিসি লিখেছে, মঙ্গলবার সাউথ টেক্সাসের ইউভালডে শহরের রব এলিমেন্টারি স্কুলে ঢুকে ১৮ বছরের এক তরুণ নির্বিচারে গুলি চালানো শুরু করে, পরে সেই হামলাকারী আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর গুলিতে নিহত হয়।
টেক্সাসের গভর্নর গ্রেগ অ্যাবোট জানিয়েছেন, সন্দেহভাজন ১৮ বছর বয়সী ওই তরুণের নাম সালভাদর রামোস। তিনি একাই ওই হামলা চালান বলে কর্তৃপক্ষ নিশ্চিত হয়েছে। টেক্সাস রেঞ্জের পুলিশের বরাত দিয়ে রাজ্যের সেনেটর রোল্যান্ড গুতিয়েরেজ সিএনএনকে বলেছেন, এ হামলায় ১৯ শিশু এবং প্রাপ্তবয়স্ক দুইজন নিহত হয়েছেন।
গোলাগুলিতে ইউএস বর্ডার পেট্রলের দুই কর্মকর্তাও আহত হয়েছেন; তবে তারা আশঙ্কামুক্ত বলে জানিয়েছেন গভর্নর গ্রেগ অ্যাবোট। গুলিতে নিহত প্রাপ্তবয়স্কদের একজন ওই বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা। যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদমাধ্যমের বরাতে বিবিসি জানিয়েছে, নিহতের নাম ইভা মিরেলেস। বিদ্যালয়ের ওয়েবসাইট থেকে জানা গেছে, কলেজ পড়ুয়া এক মেয়ে রয়েছে তার।
টেক্সাসের স্যান অ্যান্টোনিও শহর থেকে প্রায় ৮৫ কিলোমিটার পশ্চিমে ওই স্কুলের ৫০০ শিক্ষার্থীর বেশিরভাগই হিসপানিক ভাষাগোষ্ঠীর। সেখানে মূলত দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ গ্রেডের শিক্ষার্থীদের পড়ানো হয়, যাদের বয়স ৭ থেকে ১০ বছরের মধ্যে। বিবিসি জানিয়েছে, ইউএস বর্ডার পেট্রলের কর্মকর্তারা গুলি শুরুর পরপরই ঘটনাস্থলে ছুটে আসেন। তাদের গুলিতে বন্দুকধারীর মৃত্যু হয়।
বর্ডার পেট্রল হল যুক্তরাষ্ট্রের সীমান্ত বন্দরগুলোর নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত কেন্দ্রীয় সংস্থা। ঘটনাস্থল ইউভালডে শহরটি মেক্সিকো সীমান্ত থেকে ৮০ মাইলেরও কম দূরত্বে অবস্থিত, সেখানে একটি বর্ডার পেট্রল স্টেশন রয়েছে। কর্মকর্তারা জানান, গুলিতে আহত দুই বর্ডার পেট্রল সদস্যের একজনে মাথায় গুলি লেগেছে, তারা দুজনই হাসপাতালে ভর্তি। তবে তাদের অবস্থা স্থিতিশীল।
সিএনএন জানিয়েছে, হামলাকারী সালভাদর রামোস ওয়েনডি’স ফাস্ট ফুড চেইনের একটি শাখায় কাজ করতেন। ওই শাখার সান্ধ্যকালীন ব্যবস্থাপক অ্যাদ্রিয়ান মেনদেজ বলেছেন, রামোস মূলত কাজ করতেন দিনের পালায়, বেশিরভাগ সময় তাকে আত্মমগ্ন থাকতে দেখা যেত। তদন্তকারীরা জানিয়েছেন, হামলার সময় রামোস বডি আর্মার পরে ছিলেন। তিনি গড়ি নিয়ে ওই স্কুলে ঢোকেন। তার হাতে ছিল একটি হ্যান্ডগান এবং একটি এআর- ফিফটিন সেমি অটোমেটিক রাইফেল। স্কুলে ঢুকে নিজের দাদির ওপর গুলি চালিয়ে তিনি হত্যাকাণ্ডের সূচনা করেন।
মাত্র দশ দিন আগে নিউ ইয়র্কের বাফলোতে একটি সুপার শপে ঢুকে নির্বিচারে গুলি চালিয়ে ১০ জনকে হত্যা করে ১৮ বছরের এক তরুণ। তার পরনেও ছিল বডি আর্মার, সে হামলা করেছিল সেমি অটোমেটিক রাইফেল নিয়ে। যুক্তরাষ্ট্রে এসব রাইফেল কেনা কঠিন কিছু নয়। হামলার পরপরই ইউভালডে মেমোরিয়াল হাসপাতাল তাদের ফেইসবুক পেইজে জানিয়েছিল, অ্যাম্বুলেন্স ও বাসে করে ১৩ শিশুকে সেখানে নেওয়া হয়েছে।
স্যান অ্যান্টোনিও ইউনিভার্সিটি হেলথ হাসপাতালের কর্মকর্তারা জানান, ৬৬ বছরের এক নারী ও ১০ বছর বয়সী একটি মেয়েকে সেখানে ভর্তি করা হয়েছে, তাদের অবস্থা আশঙ্কাজনক। রব এলিমেন্টারি স্কুলের কয়েক ব্লক দূরে ওই স্কুলে হামলায় নিহত ও বেঁচে যাওয়াদের জন্য একটি ছোট প্রার্থনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। কার্লা বোম্যান নামে এক নারী কান্না ভেজা কণ্ঠে তার এক পারিবারিক বন্ধুর কথা বলেন, যার ছোট্ট মেয়েটি হামলার সময় স্কুলে ছিল। সে বেঁচে আছে না মারা গেছে তা তারা জানতে পারেননি।
প্রার্থনার সময় নিঃশব্দে কাঁদছিলেন শেরিল জুহাজ, যার সারাটা জীবন এই ইউভালডে শহরেই কেটেছে। তিনি বলেন, “এ ধরনের খারাপ কাজ আপনি সহ্য করতে পারবেন না, সেটা যেখানেই ঘটুক। বিশেষ করে সেটা যখন নিজের বাড়িতে ঘটে, মেনে নেওয়া আরও কঠিন হয়ে যায়।” টেক্সাসের ঘটনায় শোক আর হতাশা প্রকাশ করে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন হোয়াইট হাউজে এক বক্তৃতায় বলেন, এভাবে গুলি করে মানুষ হত্যার ঘটনায় প্রক্রিয়া জানাতে জানাতে তিনি ‘অসুস্থ ও ক্লান্ত’ বোধ করছেন।
আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ন্ত্রণের ওপর জোর দিয়ে তিনি বলেন, “কত ছোট ছোট শিশু এই ঘটনা দেখেছে, তারা তাদের বন্ধুদের মরতে দেখেছে, যেন তারা একটি যুদ্ধক্ষেত্রে রয়েছে। খোদার জানে, তাদের বাকি জীবনে ওই দুঃসহ স্মৃতি বয়ে বেড়াতে হবে।” ইউভালডের হতাহতদের স্মরণে হোয়াইট হাউজ ও যুক্তরাষ্ট্রের অন্যান্য ফেডারেল ভবনে পতাকা অর্ধনমিত রাখার নির্দেশ দিয়েছেন বাইডেন।
ওই স্কুল ডিস্ট্রিক্টে এ বছরের শেষ ক্লাস হওয়ার কথা ছিল বৃহস্পতিবার। কিন্তু এ ঘটনার পর সব ক্লাস ও অন্যান্য কার্যক্রম বাতিল করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে আগ্নেয়াস্ত্রের সহজলভ্যতা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মাথাব্যথার বড় কারণ হয়ে উঠেছে। অস্ত্র নিয়ন্ত্রণে আইন কঠোর করার দাবি উঠলেও দেশটির রাজনীতিবিদরা এ প্রশ্নে বিভক্ত। গত কয়েক বছরে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এভাবে নির্বিচারে গুলির ঘটনা বার বার নাড়া দিয়ে গেছে মার্কিন নাগরিকদের। আর অধিকাংশ ক্ষেত্রে হামলাকারীও বয়সে কিশোর বা তরুণ।
শিক্ষা বাণিজ্য বিষয়ক প্রকাশনা এডইউকের হিসাবে, শুধু গত বছরই ২৬ বার এমন ঘটনা ঘটেছে সে দেশে। পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে, স্কুলে হামলা হলে নিরাপত্তার জন্য কী করতে হবে, সেই প্রশিক্ষণও বিদ্যালয়ের নিয়মিত পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এ ধরনের গোলাগুলির মধ্যে এ পর্যন্ত সবচেয়ে মর্মান্তিক ঘটনাটি ছিল ২০১২ সালের। স্যান্ডি হুক এলিমেন্টারি স্কুলে ওই হামলায় নিহত ২৬ জনের ২০ জনই ছিল ৫ থেকে ৬ বছর বয়সী। তার আগে ২০১৮ সালে ফ্লোরিডার একটি স্কুলে হামলার ঘটনায় শিক্ষার্থীসহ ১৭ জনের প্রাণ যায়।
মঙ্গলবার ওয়াশিংটন ডিসিতে যুক্তরাষ্ট্রের সেনেটে বক্তৃতার সময় কানেটিকাটের ডেমোক্রেট দলীয় সেনেটর ক্রিস মারফি তার সহকর্মীদের কাছে আবেদন জানান, যাতে তারা বন্দুক নিয়ন্ত্রণের ওপর আইন পাস করেন। তিনি বলেন, “এই শিশুরা দুর্ভাগা ছিল না। এমন ঘটনা শুধু এ দেশেই ঘটছে। আর কোথাও না, আর কোথাও শিশুরা স্কুলে গিয়ে ভাবে না যে তারা আজ গোলাগুলির মুখে পড়তে পারে।”
তবে টেক্সাসের রিপাবলিকান দলীয় সেনেটর টেড ক্রুজ আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ন্ত্রণের আহ্বান প্রত্যাখ্যান করেছেন। তিনি বলেন, “আইন মেনে চলা নাগরিকদের জন্য তাদের অধিকার খর্ব করা হলে … এটা সুফল দেবে না। এটা অপরাধ দমাতে পারবে না।” যুক্তরাষ্ট্রে ২০২০ সালে শিশু ও কিশোর-কিশোরীর মৃত্যুর মূল কারণ হিসেবে সড়ক দুর্ঘটনাকে ছাপিয়ে শীর্ষে উঠে আগে গুলিতে মৃত্যু- ইউএস সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (সিডিসি) গত মাসের প্রতিবেদনে এমনটাই জানিয়েছে। সোমবার এফবিআইয়ের একটি প্রতিবেদনে জানানো হয়, ২০২০ সালে করোনাভাইরাস মহামারী শুরুর পর এ ধরনের গুলির ঘটনা বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে।


প্রকাশিত: মে ২৬, ২০২২ | সময়: ৩:১০ পূর্বাহ্ণ | সুমন শেখ