সর্বশেষ সংবাদ :

বাঘা ও নওগাঁয় নবান্ন উৎসব

স্টাফ রিপোর্টার, বাঘা ও নওগাঁ প্রতিনিধি: বাংলা বছরের অগ্রাহায়ন মাসে নতুন ধান কেটে কৃষকরা যে পিঠা-পুলির উৎসব করেন তাকেই নবান্ন উৎসব বলা হয়। নবান্ন উৎসবের সাথে মিশে আছে বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাস, ঐহিত্য ও সংস্কৃতি। প্রাচীনকাল থেকেই বাঙালিদের পরিচয় পাওয়া যায় এই নবান্ন উৎসবকে কেন্দ্র করে। অগ্রাহায়ণের শুরু থেকেই আমাদের গ্রাম বাংলায় চলে নানা উৎসব-আয়োজন।
নতুন ধান কাটা আর সেই সাথে প্রথম ধানের অন্ন ও হরেক রকম পিঠা-পুলি খাওয়াকে কেন্দ্র করে পালিত হয় এই নবান্ন উৎসব। বর্তমানে এটি জাতীয় উৎসবে পরিনত হয়েছে। সেই ধারাবাহিকতায় বাঘা কৃষি অধিদপ্তরের আয়োজনে বৃহস্পতিবার উপজেলার হাবাসপুর মাঠে কৃষকের সাথে সরকারি কর্মকর্তাদের ধান কাটা ও নানা রকম পিঠা খাওয়ার মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠিত হয়েছে নবান্ন উৎসব।
সকাল ১১ বর্ণাঢ্য আয়োজনের মধ্যদিয়ে বাঘার মনিগ্রাম ইউনিয়নের হাবাসপুর মাঠে এই নবান্ন উৎসব পালিত হয়। সেখানে অত্র এলাকার কৃষকদের সাথে ধান কাটায় অংশ গ্রহন করেন বাঘা উপজেলা নির্বাহী অফিসার শারমিন আখতার, বাঘা কৃষি অফিসার শফিউল্লা সুলতান, উপজেলা সহকারী কমিশনার ভূমি জুয়েল আহাম্মেদ, স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা অফিসার আসাদুজ্জামান, শিক্ষা অফিসার আ.ফ.ম হাসান ও প্রানী সম্পাদ কর্মকর্তা আমিনুল ইসলাম সহ উপজেলার সকল দপ্তরের প্রধান কর্মকর্তা এবং মনিগ্রাম ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সাইফুল ইসলাম।
ধান কাটা শেষে হরেক রকম পিঠা খাওয়া সহ এক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় নির্বাহী অফিসার শারমিন আখতার বলেন, আমাদের দেশের অতিথী ঋতু শীতকাল। এই সময়ে প্রকৃতি আমাদের জীবন ধারার মাঝে ব্যাপক পরিবর্তন এনে দেয়। শীতে শহরের লোকজনের কাছে পরিচিত-কাকের ডাক, গাড়ির হর্ণ আর চায়ের কাপ।
প্রক্ষন্তরে গ্রামের শীত মানে-কুয়াশার জালে ছিন্ন ভিন্ন করে রোদের স্পর্শ পা ভিজিয়ে দেয় দুবলা ঘাস।এ দিক থেকে গ্রামে যে নবান্ন উৎসব করা হয়, সেটাই মূলত প্রধান এবং আসল নবান্ন উৎসব। এখানে আমরা নতুন ধানকে স্পর্শ করতে পারি। খেতে পারি নানা রকম মুখরোচক পিঠা। সেই হিসেবে শহুরে জীবনে যে নবান্ন উৎসব করা হয়, সেটা একটা প্রতিকী মাত্র। আমরা যাতে আমাদের উৎসকে ভুলে না যাই এবং এটি সারা জীবন ধরে রাকতে পারি সে জন্য তিনি সকলের প্রতি আহবান জানান।
এর আগে বক্তব্য রাখেন উপজেলা সহকারী কমিশনার ভুমি জুয়ের আহাম্মেদ। তিনি কৃষি খাতে সরকারের নান রকম সহায়তা প্রদানের কথা তুলে ধরে উন্নত চাষাবাদে কৃষকদের উৎসাহিত করেন।
অপর দিকে উপজেলা কৃষি অফিসার শফিউল্লা সুলতান বলেন, গ্রাম বাংলা থেকে হারিয়ে যাচ্ছে বাঙালির হাজার বছরের প্রাচীনতম উৎসব নবান্ন। নবান্ন উৎসব হলো অসাম্প্রদায়িক উৎসব। অগ্রহায়ণ মাসে কৃষকের নতুন বার্তা নিয়ে আমন ধানের আগমন ঘটে।
এ উৎসব বাঙালি জাতিকে ঐক্য, ভ্রাতৃত্ব ও আত্মীয়তার বন্ধনে আবদ্ধ করে।তিনি বলেন, বাংলাদেশ পুর্বের যে কোন সময়ের চেয়ে কৃষিতে এগিয়ে গেছে। এখন আমরা বিশ্বে ধান উৎপাদনে ৩য়, সবজি উৎপাদনে ৩য়, আম উৎপাদনে ৭ম, আলু উৎপাদনে ৭ম ,মিঠা পানির মাছ উৎপাদনে ৩য় এবং পেয়ারা উৎপাদনে ৮ম স্থানে থেকে বিশ্বপরিমন্ডলে সমাদৃত। বিশ্বে ধান, পাট, কাঁঠাল, আম, পেয়ারা ও আলু এবং সবজি ও মৎস্য-উৎপাদনে বাংলাদেশ আজ দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। বর্তমানে নতুন-জাতের ধান বিনা ২৫ এর উৎপাদন কৃষকদের মাছে স্বপ্নের বীজ বুনছেন।
এ ছাড়াও যে সকল ফল এক সময় বিদেশ থেকে এনে খাওয়া লাগতো এখন তার অনেক আংশ বাংলাদেশে উৎপাদন হচ্ছে। আর এসব কিছু সবই সম্ভব হয়েছে কেবল জাতির পিতার সুযোগ্য কন্যা ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার কারনে।
মাঠে মাঠে সোনালী ধান দোল খাচ্ছে মৃদুমন্দ বাতাসে। চারদিকে নতুন আমন ধানের মৌ মৌ ঘ্রাণ। চলছে ধান কাটা ও মাড়াইয়ের ধুম। ফলন যেমনই হোক, নওগাঁর কৃষকের মুখে ধানকাটার গানে নবান্নের আমেজ।
কৃষকদের এই আনন্দ উদযাপন করতে প্রতি বছরের মতো এবারও পহেলা অগ্রহায়ণ নানা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে নওগাঁয় দিনব্যাপী হয়ে গেল নবান্ন উৎসব। বৃহস্পতিবার বিকেলে শহরের সমবায় চত্বরে সংস্কৃতিকর্মীদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষ জড়ো হন। নেচেগেয়ে ফসলকেন্দ্রিক জীবনযাত্রা ফুটিয়ে তোলেন শিল্পীরা। স্থানীয় ঐকতান সংগীত সংস্কৃতি সুজন সংগঠন এই উৎসবের আয়োজন করে।
বিশিষ্ট সংগীত শিল্পী মোসাদ্দেক হোসেনের সভাপতিত্বে আয়োজিত আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন নওগাঁ সরকারি কলেজের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ ও শিক্ষাবিদ প্রফেসর শরিফুল ইসলাম খান।
বিশেষ অতিথি থেকে বক্তব্য রাখেন, জেলা এ্যাকউন্টস এন্ড ফিনান্স অফিসার খান মজাহারুল ইসলাম এবং নওগাঁ জেলা প্রেসক্লাবের সভাপতি কায়েস উদ্দিন। এ সময় নওগাঁ থিয়েটারের সাধারণ সম্পাদক খাদেমুল ইসলামসহ শহরের বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যাক্তিরা উপস্থিত ছিলেন। নওগাঁর বিভিন্ন সংগঠনের সাথে সম্পৃক্ত শিল্পী কলা কূশলীদের সমন্বয়ে একটি মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিবেশিত হয়।
এসময় অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি প্রফেসর শরিফুল ইসলাম খান বলেন, ‘নবান্ন উৎসবের সঙ্গে মিশে আছে বাঙালির ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি। প্রাচীনকাল থেকেই বাঙালি জাতি-ধর্ম-বর্ণকে উপেক্ষা করে নবান্নকে কেন্দ্র করে উৎসবে মেতে ওঠে। এ যেন সত্যি হৃদয়ের বন্ধনকে আরও গাঢ় করার উৎসব। আমরা প্রতিবছর পহেলা অগ্রহায়ণে এই নবান্ন উৎসবের আয়োজন করা হয়। আগামীতেও এ ধারা অব্যহত থাকবে।
নওগাঁ জেলা প্রেসক্লাবের সভাপতি কায়েস উদ্দিন বলেন, কৃষিভিত্তিক সভ্যতার পুরো ভাগে থাকা এই নবান্ন উৎসব অনাদিকাল থেকে বাঙালির জীবন অধিকার করে আছে। নতুন ধান থেকে পাওয়া চালে হয় নবান্ন উৎসব। নতুন আমন চালের ভাত বিবিধ ব্যঞ্জনে অন্নাহার, পিঠেপুলির উৎসবের আনন্দে মুখর হয় জনপদ। মেয়েকে নাইয়র আনা হয় বাপের বাড়ি।
নতুন ধানের ভাত মুখে দেওয়ার আগে কোথাও কোথাও দোয়া, মসজিদে শিন্নি দেওয়ার রেওয়াজ আছে। নবান্ন মানেই যেন বাংলার ঘরে ঘরে এক উৎসবের আমেজ তৈরি হয়। যা আদিকাল থেকেই পালন হয়ে আসছে।


প্রকাশিত: নভেম্বর ১৭, ২০২৩ | সময়: ৬:৩৪ পূর্বাহ্ণ | সুমন শেখ