বিপিএল নিয়ে প্রশ্নবাণে জর্জরিত বিসিবির প্রধান নির্বাহী

স্পোর্টস ডেস্ক: আয়োজনটি ছিল বিপিএলের টাইটেল স্পন্সরশিপ ঘোষণার। কিন্তু প্রশ্নোত্তর পর্বে সেটি ছড়িয়ে গেল বিপিএলের নানা অব্যবস্থাপনা, আয়োজনের ঘাটতি-দুর্বলতা এবং প্রাসঙ্গিক আরও নানা প্রান্তরে। একের পর এক প্রশ্ন ছুটে গেল বিসিবির প্রধান নির্বাহী ও বিপিএল গভর্নিং কাউন্সিলের সদস্য নিজাম উদ্দিন চৌধুরির দিকে। তিনি একই কথা ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে বলতে থাকলেন দফায় দফায়। বিসিবির নানা সীমাবদ্ধতার কথা তার কণ্ঠে উঠে এলো বারবার। সব মিলিয়ে বিপিএলের সামগ্রিক বাস্তবতার একটি প্রামাণ্য চিত্র হয়ে থাকল এই সংবাদ সম্মেলন।
টাইটেল স্পন্সর হিসেবে বাংলাদেশ ক্রিকেটের অনেক পুরনো সঙ্গী ইম্পাহানি ও পাওয়ার্ড বাই স্পন্সর মিনিস্টার গ্রুপের নাম ঘোষণা করা হলো। কিন্তু বারংবার জিজ্ঞাসায়ও আর্থিক অঙ্ক প্রকাশ করা হলো না। এই টুর্নামেন্ট সরাসরি সম্প্রচার করা হবে নাগরিক টিভিতে। কিন্তু সম্প্রচার চুক্তির অর্থ জানাতেও অনীহা তাদের। বিসিবির প্রধান নির্বাহীর মতে, চুক্তির শর্তের কারণে তারা টাকার অঙ্ক প্রকাশ করতে পারছেন না।
বিপিএল শুরুর আগের দিন টাইটেল স্পন্সর ও সম্প্রচারকারী প্রতিষ্ঠানের নাম জানানো হচ্ছে, টুর্নামেন্টের অব্যবস্থাপনার একটি প্রমাণ হতে পারে এটিই। বিশ্বের সব দেশের বোর্ডই এই ধরনের স্পন্সরশিপ চুক্তি ও সম্প্রচার চুক্তির আর্থিক অঙ্কসহ সবকিছু প্রকাশ্যেই বিস্তারিত জানিয়ে দেয়। প্রধান নির্বাহীকে এই কথা বারবার বলার পর তিনি বললেন, ‘নিজেরা কথা বলে প্রয়োজন মনে করলে পরবর্তীতে আপনাদের জানিয়ে দেব।” বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত তা জানানো হয়নি।
টাকার অঙ্ক নিয়ে এমন লুকোচুরির পেছনে স্বচ্ছতার প্রশ্ন আছে কি না, এটিও জিজ্ঞেস করা হলো প্রধান নির্বাহীকে। তিনি তা উড়িয়ে দিলেন। টুর্নামেন্টের আয়োজনগত নানা অব্যবস্থাপনা নিয়ে একের পর এক প্রশ্ন ছুটে গেল তার কাছে। ডিআরএস না থাকার প্রসঙ্গ উঠে এলো বারবার। গত আসরেও ডিআরএস না থাকার পর বোর্ড থেকে বলা হয়েছিল, তাড়াহুড়ো করে আয়োজন করায় তারা প্রযুক্তি রাখতে পারেনি, পরের বার থেকে নিশ্চিতভাবেই থাকবে। কিন্তু এবারও তা নেই। কারণ হিসেবে বিসিবির প্রধান নির্বাহী পুরনো কথাগুলোই শোনালেন নতুন করে।
“ডিআরএস ভারত সিরিজেও ছিল। আমার এখানে ইকুয়েপমেন্টস আছে, কিন্তু ম্যানপাওয়ার নেই। বিষয়টা হচ্ছে ওদের ওই যে কোম্পানিটা এই সাপোর্ট দেবে, সেই কোম্পানির দেওয়ার মতো যথেষ্ট জনবল নেই। আমরা চেষ্টা করছি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ডিআরএস অ্যাভেইঅ্যাবল করা যায়।” “দুই-তিন মাস আগেই প্রোডাকশন টিম আমাদেরকে বিষয়টি জানায়। এরপর আমরা আমাদের জায়গা থেকে ডিআরএস আনার সব চেষ্টা করেছি। আইসিসির সঙ্গেও এ নিয়ে যোগাযোগ করেছি। কিন্তু কোনো কারণে সেটা আনা সম্ভব হয়নি। কারণ একই সময়ে বেশ কিছু আন্তর্জাতিক ক্রিকেট চলছে। কিছু ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগও চলছে। এসব কারণেই আমরা ডিআরএস আনতে পারিনি।”
অথচ এই মাস থেকেই শুরু হতে যাওয়া নতুন দুই টুর্নামেন্ট সংযুক্ত আরব আমিরাতের আইএল টি-টোয়েন্টি ও দক্ষিণ আফ্রিকার এসএ টি-টোয়েন্টিতে ঠিকই থাকবে ডিআরএস। বিপিএলের অনেক পরে শুরু হয়েও তারা ডিআরএসের ব্যবস্থা করতে পেরেছে। বিসিবি কেন আগে থেকে ডিআরএস নিশ্চিত করেনি, এই প্রশ্নে প্রধান নির্বাহী সেই একই উত্তর ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে বললেন আবার।
টাকা বাঁচানোর জন্য বিসিবি ডিআরএস আনেনি বলে অভিযোগ উঠলেও তা মানলেন না বিপিএল গভর্নিং কাউন্সিলের এই সদস্য। এক পর্যায়ে অবশ্য তিনি ছোট্ট করে স্বীকার করলেন, ‘দায় বিসিবির ওপরই আসে।’ নিজেদের নানারকম সীমাবদ্ধতার কথাও তিনি বললেন। বিপিএল নিয়ে সাকিব আল হাসানের প্রবল সমালোচনার প্রসঙ্গও উঠল অবধারিতভাবেই। বাংলাদেশের টেস্ট ও টি-টোয়েন্টি অধিনায়ক আগের দিনই বিপিএল নিয়ে স্রেফ ধুয়ে দেন বিসিবিকে। বিপিএল নিয়ে ভালো কিছু করার সৎ চাওয়া বিসিবির আছে কি না, আদৌ কোনো সদিচ্ছা আছে কি না, এসব প্রশ্ন তুলে সাকিব বলেন, “বিপিএলের চেয়ে ঢাকা প্রিমিয়ার লিগও অনেক গোছানো হয়।” তিনি বিপিএলের প্রধান নির্বাহীর দায়িত্ব পেলে এখনকার সব কিছু বদলে দিয়ে দুই-এক মাসের মধ্যে সব ঠিকঠাক করে দেবেন বলেও ঘোষণা দেন।
সাকিবের এই কথার প্রসঙ্গ টানতেই বিসিবির প্রধান নির্বাহী এটির গভীরে যেতে চাইলেন না। “আমি নিশ্চিত নই যে উনি কোন প্রেক্ষাপটে কথাটা বলেছেন বা কতটুকু তথ্য উনার কাছে ছিল। আমাদের সীমাবদ্ধতা জানলে হয়তো উনার অবস্থান থেকে এসব কথা উনি বলতেন কী না, আমার সন্দেহ। এতটুকুই বলব। এর বাইরে কিছু বলা আসলে ঠিক হবে না।” বিসিবির সদিচ্ছার অভাব বলে যে অভিযোগ সাকিব করেছেন, তা মানতে নারাজ বোর্ডের প্রধান নির্বাহী।
“আমাদের যে সদিচ্ছার অভাব, তা কিন্তু নয়। আমরা কিন্তু গত ২-৩ বছরে নানারকম চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়ে আসছি। এবছরও কয়েকটি দল এসেছে, যারা আর্থিকভাবে যারা যথেষ্ট সক্ষম। তবু আমরা তাদের দিতে পারিনি (দল), কারণ নির্দিষ্টি কিছু জায়গায় স্বচ্ছতা দরকার। কিছু সীমাবদ্ধতা আছে, যেগুলোর কথা বারবার বলছি।”
সীমাবদ্ধতার কথা তিনি বারবারই বললেন। প্রায় প্রতি প্রসঙ্গেই তার কণ্ঠে শোনা গেল এই শব্দ। কিন্তু কোন ধরনের সীমাবদ্ধতা, তা খোলাসা করতে চাইলেন না। “পাবলিকলি তো সীমাবদ্ধতাগুলো আপনাকে বিস্তারিত ব্যাখ্যা করতে পারব না। তবে এটুকু বলব, আমাদের সীমাবদ্ধতা আছে।”
কোভিড মহামারীর কারণে বাধাগ্রস্থ হওয়ার কথাও বললেন। যদিও তা এখন অনেকটাই অতীত। গত বিপিএলে তবু মহামারীর কারণে সমস্যা হওয়ার ব্যাপার ছিল, এবার সেরকম বাস্তবতা থাকার কারণ নেই। আরব আমিরাত ও দক্ষিণ আফ্রিকার লিগ মহামারীর পর শুরু করেই অনেকটা গোছানোভাবে এবং সাড়া জাগিয়ে শুরু হচ্ছে। বিসিবির প্রধান নির্বাহীর উত্তরে নতুন কিছু শোনা গেল না। তবে প্রতিবার বিপিএল শুরুর আগে ও শেষের পর তারা পরবর্তী আসর ভালোভাবে করার যে আশার কথা শোনান, পুরনো সেই আশার বাণী শোনালেন আবার।
“আমাদের এখানে স্থানীয় যে সম্পদ, স্থানীয় যে স্পন্সর, তাদের ওপর ভিত্তি করেই আমরা পরিকল্পনা করি। এমন হলো যে আমরা অতি উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনা করলাম, যেটি বাস্তবায়ন করতে পারব না, আগে যেটা হয়েছেৃ এখন আমাদের একটা লক্ষ্য থাকে রাজস্বের ক্ষেত্রে। আশা করছি এই, পরিকল্পনা অনুযায়ী যদি আমরা করি, আশা করি সামনে আপনারা আরও রোমাঞ্চকর বিপিএল দেখতে পাবেন।”
“আমরা হয়তো পরবর্তীতে আরও সুসংগঠিতভাবে করতে পারব। এবার যেহেতু ফ্র্যাঞ্চাইজি ঠিক হয়ে গেছে, আগামীবার হয়তো এটা ঠিক করার চ্যালেঞ্জ থাকবে না। এটা একটা বড় চ্যালেঞ্জ ছিল। এটা ঠিক হয়ে যাওয়ায় আগে থেকেই অনেক কিছু ঠিক করা যাবে। আশা করি সামনে আরও ভালোভাবে হবে।”
১১ বছরে বিপিএলের আদৌ কোনো প্রাপ্তি কিংবা ভালো কোনো দিক আছে কি না, এমন প্রশ্নও উঠল। প্রধান নির্বাহী যে উত্তর দিলেন, তাতে মিশে থাকল যে টুর্নামেন্টকে ঘিরে বড় কোনো স্বপ্ন তাদের নেই। ‘আমরা যে টুর্নামেন্ট চালিয়ে যাচ্ছি এবং আমাদের লক্ষ্য অনুযায়ী আয় করে যাচ্ছি, এটাই একটা ইতিবাচক দিক। অনেক দেশই কিন্তু ঘরোয়া টি-টোয়েন্টি শুরু করে চালিয়ে যেতে পারছে না। তিন-চার বছর পর বন্ধ হচ্ছে। আমরা অন্তত একটা প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ টুর্নামেন্ট করে যাচ্ছি, এটাই আমাদের ইতিবাচক দিক।”


প্রকাশিত: জানুয়ারি ৬, ২০২৩ | সময়: ৪:৫০ পূর্বাহ্ণ | সুমন শেখ

আরও খবর