ক্লিকে ক্লিকে মুনাফা, ‘শতকোটি টাকা’ হাতিয়ে লাপাত্তা

সানশাইন ডেস্ক: ওয়েবসাইটের নির্দিষ্ট বাটনে নির্দিষ্ট সংখ্যক ক্লিক করলেই ‘মুনাফা’ দেওয়ার কথা বলে অন্তত ১ লাখ তরুণের কাছ থেকে শতকোটিরও বেশি টাকা হাতিয়ে নিয়ে লাপাত্তা হয়েছে ‘ই-টাইম’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান। যা টের পায়নি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও। মূলত মাল্টিলেভেল মার্কেটিং (এমএলএম) প্রক্রিয়ার মতো করে সদস্য সংগ্রহ করে চক্রটি বিভিন্ন মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে টাকা সংগ্রহ করেছে। এরপর গত ঈদে ছুটির কথা বলে কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়। তারা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম টেলিগ্রামে গ্রুপ খুলে নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ করতো, সেই গ্রুপগুলোও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
ভুক্তভোগী কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত ফেব্রুয়ারি মাসে ই-টাইম নামে ওয়েবসাইটটি তাদের কার্যক্রম শুরু করে। এই প্রতারণার নেপথ্যে রয়েছে রংপুর ও গাইবান্ধার দুই যুবক; তারা সম্পর্কে মামা-ভাগ্নে। তারা যেসব নাম ব্যবহার করে প্রতারণা করেছে, সেগুলো তাদের প্রকৃত নাম কিনা তাও নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তাদের দাবি, প্রতিষ্ঠানটিতে এই অল্প সময়েই লাখেরও বেশি সদস্য যুক্ত হয়েছিলেন। তাদের অনেকেই একাধিক অ্যাকাউন্ট খুলে কয়েক লাখ পর্যন্ত টাকা বিনিয়োগ করেছেন। তাদের হিসাবে, শতকোটি টাকারও বেশি হাতিয়ে নিয়ে লাপাত্তা হয়েছে এই প্রতারকরা।
ই-টাইমের ওয়েবসাইটেই সদস্য হওয়ার বিস্তারিত প্রক্রিয়ার তথ্য দেওয়া আছে। তবে ওয়েবসাইটটিতে অ্যাকাউন্ট খুলতে হয় পুরনো সদস্যের হাত ধরেই। মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে নির্দিষ্ট ফি দিয়ে এক ব্যক্তিকে সদস্য হতে হয়। সদস্য হওয়ার পর তিনিও অন্যকে এখানে অ্যাকাউন্ট খুলে টাকা বিনিয়োগ করতে উদ্বুদ্ধ করবে। এরপর ওয়েবসাইটে নির্দিষ্ট বাটনে নির্দিষ্ট সংখ্যক ক্লিক করলে জমা টাকার সুদ জমা হয় সদস্য ব্যক্তির ডিজিটাল অ্যাকাউন্টে। সুদ বা মুনাফা উত্তোলনের জন্য ওয়েবসাইটে নির্দিষ্ট ফরম রয়েছে, সেটি পূরণ করে জমা করলে মোবাইল ব্যাংকিংয়ে ৭২ ঘণ্টার মধ্যে সুদ জমা হবে, যা সদস্য তুলে নিতে পারবেন। প্রথম প্রথম এভাবে কিছু সদস্যকে বিনিয়োগের পরে কিছু টাকা দিয়েছে, তা শুনে অনেকেই বিনিয়োগ করেছে। পরবর্তী সময়ে ই-টাইম কাউকে টাকা ফেরত না দিয়ে উধাও হয়েছে।
ভুক্তভোগীরা জানিয়েছেন, ই-টাইম অ্যামাজান, ফ্লিপকার্ট, আলিবাবাসহ বিভিন্ন বড় প্রতিষ্ঠানের কোম্পানি ভ্যালু বাড়ানোর কথা বলে মানুষকে বোকা বানিয়েছে। সদস্যদের মুনাফা দেওয়ার বিষয়ে তারা কয়েকটি ধাপ রেখে কাজ করেছে। যে যত বেশি বিনিয়োগ করবেন, তত বেশি মুনাফা পাবেন। ওয়েবসাইটটিতে চার ক্যাটাগরির সদস্য নেওয়া হতো। যার যত বেশি বিনিয়োগ, তার মুনাফা তত বেশি। ভুক্তভোগী ও ই-টাইমের ওয়েবসাইটের তথ্যানুযায়ী চার ধাপে মুনাফা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে।
প্রথম ক্যাটাগরির গ্রাহকরা ৬৫০ টাকা দিয়ে অ্যাকাউন্ট খোলেন। তারা ‘ভিআইপি-১’ কাজ সম্পাদন করতে পারেন। অর্থাৎ ওয়েবসাইটের নির্দিষ্ট বাটনে প্রতিদিন ২০টি ক্লিক করলে, তিনি ৩ শতাংশ হারে সুদ পাবেন। অর্থাৎ তার অ্যাকাউন্টে প্রতিদিন জমা হবে ১৯ টাকা ৫০ পয়সা। আর যদি কেউ ৪ হাজার টাকা দিয়ে অ্যাকাউন্ট খোলেন, তিনি হবেন ভিআইপি-২ সদস্য। তিনি মুনাফা পাবেন ৩ দশমিক ৩ শতাংশ হারে। সেই হিসাবে তিনি নির্দেশনা অনুযায়ী ক্লিক দিলে তার অ্যাকাউন্টে প্রতিদিন জমা হবে ১৩২ টাকা।
তৃতীয় ক্যাটাগরিতে কোনও ব্যক্তি ২০ হাজার টাকা দিয়ে অ্যাকাউন্ট খুললে তিনি প্রতিদিন মুনাফা পাবেন ৩ দশমিক ৬ শতাংশ হারে। অর্থাৎ তার অ্যাকাউন্টে প্রতিদিন জমা হবে ৭২০ টাকা। ওয়েবসাইটটিতে ‘ভিআইপি-৪’ ক্যাটাগরির সদস্য হতে বিনিয়োগ করতে হতো ১ লাখ টাকা। আর এই বিনিয়োগে প্রতিদিন মুনাফা মিলতো ৪ শতাংশ হারে। অর্থাৎ প্রতিদিন উপার্জন হবে ৪ হাজার টাকা।
প্রথম প্রথম এই হিসাবে কিছু তরুণকে মুনাফা দেওয়াও হয়। লাভের মুখ দেখার পর অনেকেই বিনিয়োগ বাড়িয়েছেন ওয়েবসাইটটিতে। অনেকেই ধারদেনা করে টাকা বিনিয়োগ করেছেন এখানে। এরপর ঈদের ছুটির কথা বলে হঠাৎ বন্ধ হয়ে যায় ই-টাইম। ই-টাইমের ওয়েবসাইটটি ঈদের পর কিছু দিন বন্ধ থাকার পর পুনরায় চালু হয়েছে। সেখানে এর প্রতিষ্ঠাতা ও বোর্ড সদস্য হিসেবে এক ভারতীয় বংশোদ্ভূত এক ব্যক্তির ছবি ও নাম ব্যবহার হয়েছে। তবে প্রযুক্তির মাধ্যমে ছবিটির উৎস সন্ধান করে দেখা গেছে, এটি বাণিজ্যিকভাবে বহুল ব্যবহৃত একটি ছবি; যা ছবি বিক্রির ওয়েবসাইট পিক্সেলডটকম থেকে ডাউনলোড করা।
সেখানে প্রতিষ্ঠাতার নাম বলা হয়েছে বিশ্বাস কাপেল। তার সম্পর্কে যেসব কথা লেখা রয়েছে, তাও কোনও ট্রান্সেলটর অ্যাপ দিয়ে বাংলায় অনুবাদ করা বলেই মনে হয়েছে। এতে লেখা হয়েছে, ‘বিশ্বাস কাপেল, যিনি কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক এবং পূর্বে প্রযুক্তি পরিষেবাগুলোর জন্য পারফর্ম করেছেন, সফলভাবে ২০২০ সালে একটি কোম্পানির জন্য এক রাউন্ডের ভেঞ্চার ক্যাপিটাল সংগ্রহ করেছেন। বিশ্বাস কাপেল বর্তমানে এজেল লিগ ফাউন্ডেশনের সভাপতি এবং সিইও, উদ্যোক্তাদের আরও উচ্চাভিলাষী ই-কমার্স মিশন থেকে সরে যেতে সহায়তা করে। বর্তমানে, বাজারের বেকারত্বের সমস্যা দূর করার জন্য বাংলাদেশ এজেল লিগ ফাউন্ডেশনের নেতৃত্বে একটি বৃহৎ আকারের বৈশ্বিক প্রতিযোগিতার আয়োজন করছে।’
এতে আরও বলা হয়েছে, ‘বিশ্বাস কাপেল মনে করেন যে ই-টাইম বুদ্ধিমান ক্লাউড অ্যালগরিদম প্রক্রিয়ায় নতুন অলৌকিক ঘটনা ঘটাবে। ই-টাইম বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠানের দ্রুত বিকাশকে সক্ষম করবে এবং বাংলাদেশ ইন্টারনেট ই-কমার্সের জন্য নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে।’ আর ওয়েবসাইটে বাংলাদেশি দুই তরুণের বিষয়ে লেখা হয়েছে। যারা বাংলাদেশে নিয়োগপ্রাপ্ত বলে দাবি করা হয়েছে। এদের একজনের নাম হাফিজুর রহমান এবং অপরজনের নাম শাহীন আলম। এরাই ই-টাইমের মূল প্রতারক। আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান উল্লেখ করে ই-টাইমের বাংলা ওয়েবসাইট খুলে তরুণদের বেশি মুনাফা দিয়ে আকৃষ্ট করেছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, শাহীন আলম একসময়ে ইউটিউবে ওয়াজ মাহফিলের চ্যানেল খুলে কাজ করতো। এ বছরের শুরু থেকে দুজন মিলে এই প্রতারণা শুরু করে। ওয়েবসাইটে তারা কিছু সনদ দিয়ে রেখেছে। যাতে বিভিন্ন বিদেশিদের নাম রয়েছে। তবে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের সঙ্গে যোগাযোগ করে জানা গেছে, এসব সনদের কোনও ভিত্তি নেই। মানুষকে ধোঁকা দিতে এগুলো বানিয়ে প্রচার করা হয়েছে।
এই চক্রের নেপথ্যে আরও দুজন ব্যক্তির নাম পাওয়া গেছে, তবে তাদের ঠিকানার বিষয়ে নির্দিষ্ট করে কিছু পাওয়া যায়নি। এদের মধ্যে একজন হারুন অর রশীদ ওরফে রশীদ মাস্টার ও মিঠুন। তাদের বাড়িও উত্তরাঞ্চলে। হাফিজুর রহমান উত্তরাঞ্চলের এক সংসদ সদস্যের ঘনিষ্ঠ বলেও জানা গেছে।
অপরাধীরা যেসব মোবাইল ব্যাংকিং অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে লেনদেন করতো, সেসব নম্বর ০১৮৫৫-৮৮৬৩৮০, ০১৬১৭-০৯৮৯৭৯, ০১৩০৭-৬৯৬৩৪৫ ও ০১৭৯১-২৯৪৪৭৫। এই নম্বরগুলো বন্ধ পাওয়া গেছে। লাভের আশায় অনেক তরুণ ঋণ করে ই-টাইমে বিনিয়োগ করেছেন। এদের মধ্যে মুদ্দাসির রহমান নামে এক যুবক বলেন, ‘আমি ১৬ হাজার টাকা ধার করে ই-টাইম ঢুকাইছি। এক টাকাও বের করতে পারিনি। আমি কি করবো বুঝতে পারছি না। যে নম্বরে বিকাশ করে টাকা নিয়েছিল, সেই নম্বরগুলোও বন্ধ পাচ্ছি।’
তকি নামে এক যুবক জানান, তিনি ১৮ হাজার টাকা বিনিয়োগ করেছেন। টাকা উত্তোলন করার আগেই ই-টাইম উধাও হয়েছে। যার মাধ্যমে অ্যাকাউন্ট করেছিলেন সে অনেক লাভ করেছে, তবে তকি কিছুই পাননি। ই-টাইমের বিরুদ্ধে ইতোমধ্যে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) কাছে অভিযোগ দিয়েছে ভুক্তভোগীরা। সিআইডি এটি নিয়ে কাজ করছে।
সিআইডির সিরিয়াস ক্রাইমের বিশেষ পুলিশ সুপার (এসএস) নজরুল ইসলাম বলেন, আমরা এ ধরনের অনেক প্রতারক চক্র নিয়ে কাজ করছি। এসব প্রতারকের বিষয়ে আরও সচেতন হতে হবে।
সাবেক সভাপতি মনজুরুল আহসান বুলবুল, গ্লোবাল টেলিভিশনের সিইও সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা, ডিবিসি নিউজের সম্পাদক প্রণব সাহা এবং প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। ইলেকট্রনিক, প্রিন্ট ও অনলাইন গণমাধ্যমের মোট ২০ জন সাংবাদিক এ ফেলোশিপ প্রোগ্রামে অংশগ্রহণ করছেন।


প্রকাশিত: আগস্ট ২৯, ২০২২ | সময়: ৫:৫৪ পূর্বাহ্ণ | সুমন শেখ

আরও খবর