শুক্রবার, ৬ই ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ২১শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ।
স্টাফ রিপোর্টার: পুরোপুরি নাগরিকসেবা থেকে বঞ্চিত হয়ে পড়েছেন দেশের পৌর এলাকার বাসিন্দারা। কাউন্সিলরদের বরখাস্ত করায় যেসব সেবা পৌরবাসী পেতেন, তার ছিটেফোঁটাও এখন মিলছে না। এ অবস্থায় সেবা নিয়ে দেখা দিয়েছে ভয়াবহ ভোগান্তি। প্রতিদিনই সেবা না পেয়ে ফিরে যেতে হচ্ছে তাদের।
এদিকে সম্প্রতি ইউনিয়ন পরিষদ নিয়ে দুঃশ্চিন্তা বিরাজ করছে ইউনিয়ন পরিষদ জনপ্রতিনিধিদের মধ্যে। অপসারণ বিষয়ে কয়েকটি পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশ হওয়ায় একটা অজানা আতঙ্কের মধ্যে পড়েছেন তারা। তবে সচেতনমহল জানান, সত্যিকার অর্থে ইউনিয়ন পরিষদের প্রতিনিধিদের অপসারণ করা হলে নাগরিক সেবা তো বটেই-এমনকি সামাজিক নিরাপত্তা ভেঙ্গে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
অপরদিকে দেশের চার হাজার ৫৭৮টি ইউনিয়নের মধ্যে কতটি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান-মেম্বার বর্তমানে অনুপস্থিত আছেন তার তথ্য চেয়ে গত ৬ অক্টোবর জেলা প্রশাসকদের (ডিসি) চিঠি দিয়েছে স্থানীয় সরকার বিভাগ। এতে ইউনিয়ন পরিষদের জনপ্রতিনিধিদের মধ্যে নতুন করে আবারো হতাশা বৃদ্ধি পেয়েছে।
গত ৫ আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপটে দেশের ১২ সিটি করপোরেশনের মেয়রকে অপসারণের পর ঢালাওভাবে সব সিটি করপোরেশন ও পৌরসভার মেয়র-কাউন্সিলরদেরও বরখাস্ত করা হয়। সিটি করপোরেশন-পৌরসভাগুলোতে বসানো হয় প্রশাসক। তারা কোনো রকম মেয়রদের দায়িত্ব পালন করলেও কাউন্সিলরদের ঘাটতি কোনোভাবেই পূরণ সম্ভব হচ্ছে না বলেই অভিজ্ঞমহল দাবি করেছেন।
তবে বর্তমানে সিটি করপোরেশনের ওয়ার্ড সচিবগণ প্রয়োজনীয় অনেক সেবা দিচ্ছেন বলে জানা গেছে। কিন্তু উপজেলা ভিত্তিক পৌরসভার ওয়ার্ড কার্যালয় নাই এবং ওয়ার্ডভিত্তিক কোন সচিবও নাই। ফলে বিশেষ করে পৌরসভাগুলোর নাগরিক সেবা একেবারে শূন্যের কোটায় অবস্থান করছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রাজশাহীর পবা উপজেলার নওহাটা পৌরসভার এক বরখাস্তকৃত কাউন্সিলর বলেন, গত ২৬ সেপ্টেম্বর তাদের বরখাস্ত আদেশ জারি করে স্থানীয় সরকার বিভাগ। এরপর থেকেই মূলতঃ আমরা জনগণের কোন কাজেই আসতে পারছি না। এখনো প্রতিদিনই গ্রামের অনেক মানুষই বিভিন্ন কাজে (প্রত্যয়ন, ওয়ারিশন সার্টিফিকেট, ভোটার আইডি সংশোধন, নাগরিকত্ব সার্টিফিকেট) আসছেন। কিন্তু আমরা কোন উপকারে লাগছি না। এছাড়াও অনেককে সাধারণ কাজের জন্য প্রায় ৫ কি.মি দুরে পৌর ভবনে যেতে হচ্ছে। আবার অনেক সময় কর্মকর্তাদের পাওয়া যাচ্ছে না। এতে ভোগান্তি বাড়ছে। আর মূল বিষয় হচ্ছে সিটি করপোরেশনের মত উপজেলা ভিত্তিক পৌরসভাগুলোতে রাজনৈতিক বলয়ে থেকে কাউন্সিলর নির্বাচিত হয় না। এসব পৌরসভাগুলোতে রাজনৈতিক নয়- অতি পরিচিত কাছের মানুষকে জনগণ ভোট দিয়ে প্রতিনিধি নির্বাচন করে থাকেন। নওহাটা পৌরসভাতেই ১২জন কাউন্সিলরের মধ্যে বেশীরভাগ প্রতিনিধিরাই আওয়ামী লীগের বাইরে অন্য দলের সমর্থিত।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক নওহাটা পৌরসভার ১নং ওয়ার্ডের একব্যক্তি বলেন, জমি ক্রয়-বিক্রয়ের জন্য প্রায় দুইমাস থেকে ওয়ারিশন সার্টিফিকেট পাচ্ছেন না। এখন বিভিন্ন দায়িত্বে আছেন-এসব কর্মকর্তারাও তাদের নির্ধারিত দপ্তরে কাজে ব্যস্ত থাকেন। ফলে সঠিক সময়ে তাঁদেরকেও পাচ্ছি না। এতে অনাকাঙ্খিত ভোগান্তি বাড়ছে।
শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর দেশের বেশির ভাগ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও মেম্বার (সদস্য) গা-ঢাকা দিয়েছেন এমন খবর প্রকাশ হয়েছে। বিশেষ করে আওয়ামী লীগ সমর্থিত চেয়ারম্যান-মেম্বাররা বর্তমানে পলাতক রয়েছে। দুই মাস ধরে সংশ্লিষ্ট এলাকায় জনপ্রতিনিধি না থাকায় সেখানকার সেবাপ্রার্থী মানুষের দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে।
তবে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, খবরের কাগজে অনেকটা বাস্তবতা নিরিখ না করেই সংবাদ ছাপানো হয়েছে। ব্যতিক্রমধর্মী দু’চারটে ইউনিয়নকে কেন্দ্র করে পুরো দেশের কাল্পনিক চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। মূলতঃ ৫ আগস্টের পর ৭-১০ দিন ভাংচুর, মারপিট, হুমকী ধামকিতে আতঙ্কিত হয়ে চেয়ারম্যানসহ জনপ্রতিনিধিরা আড়ালে ছিলেন। বর্তমানে রাজশাহীর প্রায় ৯০ শতাংশ ইউনিয়ন পরিষদে জনগণকে শতভাগ সেবা প্রদান করা হচ্ছে। যেখানে চেয়ারম্যান অনুপস্থিত আছেন সেখানে প্যালেন চেয়ারম্যান কাজ করছেন।
ইউনিয়ন পরিষদ হলো বাংলাদেশে পল্লী অঞ্চলের সর্বনিম্ন প্রশাসনিক একক। বাংলাদেশে বর্তমানে ৪৫৭৯টি ইউনিয়ন আছে। কালের পরিবর্তনে এই ইউনিয়ন পরিষদই তৃণমূলের জনগণের সেবা গ্রহণের একমাত্র ভরসা। যদিও বর্তমানে জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে অনেক গুঞ্জন রয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের এক প্রধান শিক্ষক বলেন, বেশীরভাগ মানুষের ধারণা ২০১৮ সালের পর যেহেতু স্থানীয় সরকারের সব ধরনের নির্বাচন বয়টক করে বিএনপি ও সমমনা রাজনৈতিক দলগুলো। যে কারণে গত ৬ বছরে হাতে গোনা কিছু ইউনিয়ন, উপজেলা পরিষদ বাদে বেশিরভাগেই জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হয় আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা। যা অনেকটা সত্য।
তবে ঢালাওভাবে বলা হয় বিএনপিসহ বিরোধী রাজনৈতিক জোটের উপস্থিতি ছাড়াও এসব নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলেও রয়েছে অনিয়ম কারচুপির অভিযোগ। ভেবে দেখবার বিষয় যে, বিএনপি ও সমমনা রাজনৈতিক দলগুলো এসব ইউপি নির্বাচনে অংশ না নিলেও তৃণমুলের প্রায় সব রাজনৈতিক দলের সমর্থিত জনগণ ভোট দিয়েছেন।
ইউনিয়ন পরিষদ কমিটির কেন্দ্রীয় ভাইস চেয়ারম্যান ও পবা উপজেলার হড়গ্রাম ইউনিয়নের চারবারের নির্বাচিত চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘ইউনিয়ন পরিষদ হলো স্থায়ীয় মানুষের নানা সেবা পাওয়ার একমাত্র ভরসা। বর্তমান পরিস্থিতিতে অনেক কথা শুনা যাচ্ছে। এতে আমাদের কাজের উৎসাহ কমে যাচ্ছে। একটা অজানা আতঙ্ক কাজ করছে।
বর্তমানে ইউনিয়ন পরিষদ থেকে নাগরিক সনদপত্র, ট্রেড লাইসেন্স, চারিত্রিক সনদপত্র, ভূমিহীন সনদপত্র, ওয়ারিশান সনদপত্র, অবিবাহিত সনদপত্র, প্রত্যয়নপত্র, অস্বচ্ছল প্রত্যয়নপত্র, উত্তরাধিকার সনদপত্র, আইডি কার্ডে নাম সংশোধন, জন্ম নিবন্ধন, মৃত্যু নিবন্ধন, বিবাহ সংক্রান্ত সার্টিফাইড কপিসহ নানা সেবা প্রদান করা হয়।
আবার বিভিন্ন ধরণের ভাতা ভিজিডি, ভিজিএফ, বিধবা ভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতা বিতরণ করা হয়। এসব সেবা ছাড়াও প্রতি সপ্তাহে দুইদিন গ্রাম্য আদালতে সালিশ-মীমাংসা করা হয়। যা নিয়ম-শৃংখলা ও শান্তি বজায় রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
তিনি প্রতিবেদককে বলেন, ‘বিচার চাওয়া ও পাওয়া সকলের নাগরিক অধিকার। তবে বিচারের জন্য ব্যয় করার সামর্থ্য আমাদের দেশের অনেক মানুষেরই নেই। আবার কোর্ট কাছারি উকিল মোক্তার এসব কথা শুনলে গ্রামের সাধারণ মানুষ ভয় পেয়ে থাকেন। অনেকেই ঝামেলার কারণে বিচার প্রার্থনা থেকে দূরে অবস্থান করেন। শিক্ষিত, সচেতন নাগরিক পর্যন্ত অর্থ খরচ ও ঝামেলা এড়িয়ে চলতে বিচার চাইতে যান না। গ্রাম আদালত গঠিত হওয়ার পরে ন্যূনতম বিচারের স্থানটি নিশ্চিত করা সম্ভব হয়েছে।
গ্রামের অবহেলিত মানুষ বিশেষ করে নারী, শিশু, দরিদ্র্য বা পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর বিচার প্রাপ্তি অধিকতর সহজ ও প্রসারিত করার লক্ষ্যে গ্রাম আদালত আশীর্বাদ স্বরুপ। আপনারা নিম্ম আদালত, উচ্চ আদালত (জজকার্ট, হাইকোর্ট), পারিবারিক আদালত, শ্রম আদালতসহ বিভিন্ন প্রকারের আদালতের নাম জানেন। সর্বসাধারণের মাঝে ‘গ্রাম আদালত’ সাড়া ফেলেছে। গ্রামীণ জনগোষ্ঠী গ্রাম আদালতের মাধ্যমে মানুষ শান্তির পথ খুঁজে পাচ্ছেন।
আপনারা জানেন ‘হাজার হাজার মামলার জটে এখন আদালত পাড়ায় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সেশন জটের মতো অবস্থা হয়ে দাঁড়িয়েছে। গ্রামের মানুষ তাই ছোট খাটো বিচারের জন্য গ্রাম আদালতে যেতে খুব বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে থাকেন। তারা বেশ কিছু সুষ্ঠু বিচার পেয়ে ভরসার জায়গাটি নিশ্চিত করতে পেরেছেন। জনপ্রতিনিধিরা অপসারণ বা বরখাস্ত হলে একদিকে সাজামিক নিরাপত্তাসহ আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি দেখা দিবে এবং অন্যদিকে জনগণ নাগরিক সেবা থেকে বঞ্চিত হয়ে নানা ভোগান্তি পোয়াবে। এমন বক্তব্য রাখেন উপজেলার পারিলা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সাঈদ আলী মোরশেদ, দর্শনপাড়া ইউপির চেয়ারম্যান শাহাদাৎ হোসেন সাব্বিরসহ অনেকে।
বিষয়টি নিয়ে এক উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নাম প্রকাশ না করার শর্তে গণমাধ্যমকে বলেন, ‘অনেক ইউনিয়ন চেয়ারম্যানরা আত্মগোপনে চলে গেছেন। আবার কেউ কেউ এলাকায় অবস্থান করলেও দফতরে আসছেন না। একজন নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে সব ইউনিয়ন পরিষদের দায়িত্ব নিয়ে কাজ করা খুবই কঠিন। তা ছাড়া অভাব রয়েছে জনবলের।’
এ প্রসঙ্গে নগর পরিকল্পনাবিদ ও স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক আকতার মাহমুদ বলেন, এই মুহূর্তে বিশেষ পরিস্থিতির কারণে জনপ্রতিনিধিদের অস্তিত্ব অনুপস্থিত। এই বিশেষ ব্যবস্থা কোনোভাবেই দীর্ঘায়িত করা যাবে না। এতে নাগরিক সুবিধা ব্যাপক মাত্রায় লঙ্ঘিত হবে। এ জন্য নির্বাচন কমিশনের যেসব সংস্কার করা প্রয়োজন, সেটা দ্রুত সম্পন্ন করে নির্বাচন আয়োজন প্রয়োজন। যে চ্যালেঞ্জগুলো আছে, সেটা দ্রুত কাটিয়ে উঠে স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলো দিতে হবে। কারণ জনপ্রতিনিধিরা ভালো-খারাপ হলেও তাদেরই লাগবে।