এনজিওর দাদনে সর্বস্বান্ত্বÍ হচ্ছে গ্রামাঞ্চলের মানুষ

সেলিম সানোয়ার পলাশ, গোদাগাড়ী: ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমে ভরে গেছে রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলা। কিন্তু নেই কোন প্রতিকার। সমাজসেবা বা সমবায় দফতর থেকে নিবন্ধন নিয়ে ভুইফোড়ের মত এনজিও খুলে ক্ষুদ্রঋণের নামে চলছে সুদের কারবার। অনেক এনজিওর নিবন্ধন না থাকলেও নিবন্ধনের জন্য আবেদন করে চালিয়ে যাচ্ছে এনজিওর কার্যক্রম।
বেশির ভাগই এনজিও গজিয়ে উঠেছে সমবায়ের নিবন্ধন নিয়ে। গজিয়ে ওঠা এইসব এনজিও প্রতিষ্ঠানের মূল লক্ষ্য হচ্ছে টাকা ধার দিয়ে সুদের ব্যবসা করা। আবার কোন কোন এনজিও গ্রাহকদের টাকা হাতিয়ে নিয়ে অফিসের কার্যক্রম গুটিয়ে নিয়ে অফিসে তালা ঝুলিয়ে পালিয়ে গেছে। আর এর খপ্পরে পড়ে সর্বস্বান্ত্বÍ হচ্ছে গ্রামাঞ্চলের সহজ সরল দরিদ্র অসহায় নারী ও পুরুষেরা।
আগে গ্রাম্য মহাজনেরা সুদের ব্যবসা করত। এখন এনজিওর নামে চলছে সুদের ব্যবসা করছে। গোদাগাড়ী উপজেলার অসংখ্য এনজিও সুদের জমজমাট ব্যবসা করছে প্রকাশ্যে। ক্ষুদ্র ঋণের আওতায় এই ব্যবসা। সমাজসেবার নিবন্ধন নেই এমন অনেক সংস্থাও চালিয়ে যাচ্ছে সুদের ব্যবসা।
মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরী অথরিটির (এম আর এ) নিবন্ধন ছাড়া ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম আইনত অপরাধ। সরকার জুলাই, ২০০৬ সালে মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরী অথরিটি আইন, ২০০৬ পাশ করেন। এই আইন অনুযায়ী কর্মরত সকল ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানকে সনদের জন্য অথরিটিতে আবেদন করতে হবে। অথরিটির সনদ ব্যতিত কোন প্রতিষ্ঠান দেশের অভ্যন্তরে ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারবে না।
সমবায় দফতর থেকে নিবন্ধন নিয়ে সমিতির সদস্যদের মাঝে ঋণ কার্যক্রম চালানোর অনুমতি থাকলেও বাস্তবে চিত্র সম্পূর্ণ উল্টো। সমবায় দফতর থেকে সমিতির নিবন্ধন নিয়ে সমিতি গুলো এনজিওর নামে সুদের ব্যাবসায়ীরা টার্গেট করছে এলাকার অসহায় দরিদ্র মানুষ গুলোকে।
এনজিওর নামে সুদের ব্যাবসাযীরা সমিতির শেয়ার বিক্রি না করে শুধু শুধুমাত্র সঞ্চয় জমা নিয়ে এলাকার সহজ সরল মানুষদের মাঝে দিচ্ছে ক্ষুদ্রঋণ। জামানতের নামে নিচ্ছে ব্লাংক ব্যাংক চেকের পাতা। জামানতের নামে ব্যাংক চেকের পাতা নিয়ে গ্রামাঞ্চলের সহজ সরল মানুষদের জিম্মি করে তাদের কার্যক্রম চালাচ্ছে বলে অভিযোগ করছে এলাকাবাসী। ২০২৩ সালে গোদাগাড়ীতে ‘আদর্শ ফাউন্ডেশন সংস্থা’ নামে একটি বেসরকারি সংস্থা (এনজিও) গ্রাহকের টাকা আত্মসাৎ করে পালিয়ে গেছে। সমাজসেবা ও সমবায় অফিসের নিবন্ধন নিয়ে গোদাগাড়ী উপজেলার প্রেমতলী, রাহী, কামারপাড়া, বাসেদেবপুরসহ জেলার বিভিন্ন এলাকায় শাখা খুলে এনজিওটি তাদের ক্ষুদ্র ঋণ ও ডিপিএস কার্যক্রম পরিচালনা করছিল।
অধিক মুনাফার লোভসহ বিভিন্ন কৌশলে ‘আদর্শ ফাউন্ডেশন সংস্থাটি’ গ্রামাঞ্চলের সহজ সরল অসহায় দরিদ্র সাধারণ মানুষের কাছ থেকে কয়েক কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে অফিসে তালা ঝুলিয়ে দিয়ে পালিয়ে গেছে।
কিছুদিন আগে দক্ষিণ বাসুদেবপুর এলাকায় অবস্থিত ‘জননী’ নামের একটি এনজিও অধিক মুনাফার লোভ সহ বিভিন্ন কৌশলে গ্রামাঞ্চলের সহজ সরল অসহায় দরিদ্র সাধারণ মানুষের কাছ থেকে প্রায় ২ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে পালিয়ে গেছে।
এছাড়াও এনজিওর কার্যক্রম থাকলেও নেই কোন অফিস। আগে অফিস থাকলেও এখন সব অফিসের সাইন বোর্ড পাল্টিয়ে অন্য এনজিওর স্ইান বোর্ড ঝুলিয়ে আগের এনজিওর কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এমন এনজিও রয়েছে গোদাগাড়ী উপজেলায়। এতে ঝুকিতে রয়েছে গ্রাহকরা।
এদিকে কয়েক বছরের ব্যাবধানে গোদাগাড়ী উপজেলা থেকে কয়েকটি এনজিও গ্রাহকের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা নিয়ে পালিয়ে গেছে।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, গোদাগাড়ী উপজেলায় কার্যক্রম পরিচালনাকারী কয়েকটি এনজিওর এম আর এ নিবন্ধন থাকলেও বাকী গুলো এম আর এ নিবন্ধন ছাড়াই চলিয়ে যাচ্ছে ক্ষুদ্রঋণ ও ডিপিএস এর নামে সুদের কারবার।
গোদাগাড়ী উপজেলার বাসুদেবপুর ইউনিয়নে অবস্থিত একটি এনজিওর প্রধান কার্যালয়। সেখানে গিয়ে পরিচালক সাথে কথা বললে নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি জানান, সমবায় থেকে নিবন্ধন নিয়ে তারা কার্যক্রম চালু করেছে। বর্তমানে এই উপজেলায় ২টি শাখা অফিস খুলেছে। ২ টি অফিস থেকেই তারা ক্ষুদ্র ঋণের কার্যক্রম পরিচালনা করছে।
সমাজ সেবা অধিদপ্তরের নিবন্ধন আছে কিনা জানতে চাইলে পরিচালক বলেন, নিবন্ধনের জন্য আবেদন করেছি। এখনো নিবন্ধন পাইনি। শাখা অফিস খুলা ও ক্ষুদ্র ঋণের কার্যক্রম চালাতে পারেন কি প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, অন্যানও এনজিও গুলো যে ভাবে চালাচ্ছে আমিও সেই ভাবে চালাচ্ছি।
চাপাইনবাবগঞ্জ জেলা ঘেঁসে গোদাগাড়ী উপজেলা হওয়ায় চাপাইনবাবগঞ্জ জেলার সমাজসেবা ও সমবায় থেকে নিবন্ধন নিয়ে অনেক এনজিও গোদাগাড়ী উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় শাখা অফিস খুলে চালিয়ে যাচ্ছে ক্ষুদ্র ঋণের আওতায় সুদের ব্যবসা।
সংস্থাগুলো বিভিন্ন কৌশলে সুদের ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। দেখার কেউ না থাকার কারণে আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। ফলে আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের বদলে ঘটছে উল্টো ঘটনা। চলছে এনজিও মালিকদের বেপরোয়া সুদের কারবার। বিশেষ করে নিবন্ধন নেবার সময় সমাজ কল্যাণকে লিখিতভাবে বলে থাকে তারা ক্ষুদ্রঋণ পরিচালনা করবে না। একই সংস্থা জয়েন্ট স্টক এ্যাক্সচেঞ্জ বা অন্য কোন মন্ত্রণালয় থেকে নিবন্ধন নিয়ে ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম পরিচালনা করছে। স্ববিরোধী কার্যক্রম বন্ধ করার ভূমিকা নেই সংশ্লিষ্ট অধিদফতরের।
এদিকে প্রশাসনের নজর এড়াতেই স্বেচ্ছাশ্রমের নামে আলাদা সংস্থার কাছ থেকে নিবন্ধন নিয়ে এনজিওগুলো মাঠ পর্যায়ে কাজ করছে।
বিভিন্ন এনজিওর বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাত ও অনিয়মের অভিযোগ থাকলেও তাদের বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট অধিদফতর কাজ করছে না। নামে-বেনামে গজিয়ে উঠা এসব সংস্থা বিভিন্ন সময় গ্রাহকদের ফাঁদে ফেলে বিশেষ কৌশলে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। এছাড়াও ব্যাংকের ফাঁকা চেক নিয়ে বা ৩৫০ টাকার স্ট্যাম্পে লিখিত নিয়ে গ্রাহকদের ফাঁদে ফেলে চালিয়ে যাচ্ছে সুদের কারবার।
এনজিওর মালিকেরা চাকরি দেবার নামেও হাতিয়ে নিচ্ছে লক্ষ লক্ষ টাকা। মাঠ কর্মিদের নিয়োগ দেওয়ার সময় জামানত হিসাবে মাঠ কর্মিদের কাছ থেকে এ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে।
তাদের পরিচালিত কার্যক্রম ক্ষুদ্রঋণের আওতায় প্রতি সপ্তাহে বা মাসে কিস্তি আদায় করা। বিধবা অথবা স্বামী পরিত্যক্তা খুবই গরিব মহিলাকে টার্গেট করে ক্ষুদ্রঋণের নামে টাকা ধার দিয়ে অধিক সুদে সাপ্তাহিক বা মাসিক কিস্তি আদায় করে। একমাস কিস্তি দিতে না পারলে সেই টাকা সুদে আসলে দ্বিগুন হয়ে যায়। এইভাবে প্রত্যন্ত অঞ্চলে পুরো উপজেলায় গরিব অসহায় নারী এই ক্ষুদ্রঋণের আওতায় থেকে কিস্তির নামে সুদ দিচ্ছে। কিন্তু তাদের ভাগ্যের পরিবর্তন হচ্ছে না।
এ বিষয়ে গোদাগাড়ী উপজেলা সমবায় কর্মকর্ত সাথে মোবাইল ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে ফোন রিসিভ না করায় তিনার কোন মন্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।


প্রকাশিত: মার্চ ১৭, ২০২৪ | সময়: ২:৫৯ পূর্বাহ্ণ | সুমন শেখ