বাবার স্বপ্ন তুষার রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বে

রাবি প্রতিনিধি: তখন মধ্যরাত। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) কেন্দ্রীয় মসজিদের মেঝেতে কেউ কাঁথা মুড়িয়ে, আবার কেউ এমনিতেই শুয়ে শুয়ে ঘুমাচ্ছেন। মাঝে মধ্যে এপাশ ওপাশ করছেন অনেকে। কেউ আবার ঘুমের মধ্যেই মশা তাড়াচ্ছেন। এমন সময় না ঘুমিয়ে দেখা গেল, দুইজন এদিক-ওদিক হাঁটাহাঁটি করছেন। চোখে-মুখে তাদের চিন্তার ছাপ। বয়েসের মধ্যে মনে হচ্ছে তাদের বেশ ফারাক। দূর থেকে মনে হল বাবা এবং ছেলে বয়সিই হয়ত হবেন তারা। কিন্তু বয়সের ফারাক থাকলেও মনে হল তাদের বিষন্নতা, উদ্বীগ্নতা কোনো এক বিষয় নিয়েই হবে। আসলে কিসের চিন্তায় আচ্ছন্ন তারা? নিজের জানার আগ্রহ থেকে তাদের দিকে এগিয়ে জানা গেলে, যা ভাবা হয়েছিল ঠিক তাই! তারা আসলেই বাবা-ছেলে। বুকভরা স্বপ্ন নিয়ে ছেলেকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দেয়ানোর জন্য এসেছেন বাবা।
কথা বলে জানা গেল বাবার নাম মো. আবু সালাম আর ছেলের নাম তুষার হোসেন। তারা এসেছেন বগুড়ার মহাস্থানগড় থেকে। গল্পে গল্পে শোনা হল- তুষারের তিন বছরের এক বড় ভাই ছিলো। যিনি ১৩ বছর বয়সে জ্বরে হঠাৎ মৃত্যুবরন করেন। সালাম পেশায় কৃষক, অক্ষরজ্ঞান নেই। মানুষের কাজ করে যা আয় হয় তা দিয়েই চলে সংসার। সামান্য অর্থের জন্য করতে হয় হাড়ভাঙা পরিশ্রম। যে পরিশ্রম মানে না শোককেও। এক সন্তানকে হরিয়ে বাবা আবু সালামের এখন সব স্বপ্ন তুষারকে ঘিরেই। তুষারই যেন তাঁদের বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন। তাদের আশার বাতিঘর তুষারকে ঘিরেই যেন পৃথিবীতে শ্বাস নি”েছন নিজেরা। কথার মাঝে মাঝেই বাবা-ছেলের চার নয়ন বেদনার পানিতে টইটুম্বর। তবুও গল্প চালিয়ে যা”েছন বাবা আবু সালাম।
ভেজা চোখে বলতে লাগলেন, প্রত্যেক মা-বাবার স্বপ্নের মতো তাদেরও স্বপ্ন তাঁদের সন্তান তুষার হবে চিকিৎসক-প্রকৌশলী কিংবা সরকারি চাকুরিজীবী। নিজেরা মুজুরী দিয়ে চললেও তাদের সন্তান সুখে থাকবে এটাই শুধু চাওয়া তাদের। তাই এক সন্তান হারানোর পরেও তুষারকে তারা হাজার কষ্টের মাঝে তিল তিল করে বড় করে তুলেছেন। শুধু বড়ই করে তুলেননি পড়াশোনা শিখিয়ে উ”চ মাধ্যমিকের গন্ডিও পার করিয়েছেন। এখন একটাই স্বপ্ন তুষার রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বে।
এবার বাবার মুখের কথার সঙ্গে তালমিলিয়ে তুষার বললেন, মা-বাবার স্বপ্ন পূরণেই আমি এসেছি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। এবার ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে পড়তে চাই দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম এই বিশ্ববিদ্যালয়ে। তবে রাবিতে তেমন পরিচিত কেউই নেই আমার। এসব কথা বলতে বলতে পানিতে তুষারের চোখ ঝাপসা হয়ে এলো। এমন গল্পে নিজেও যেন স্তব্ধ হয়ে গেছিলাম। লক্ষ্য করলাম লুঙ্গি পরিহিত বাবা আবু সালাম আর ছেলে তুষার মৃদু শীতে কাঁপছে। তাই দেরি না করে বললাম, ‘চলেন আমার সঙ্গে’। তাদের নিয়ে আসলাম রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রিপোর্টার্স ইউনিটির কক্ষে। সেখানে পূর্ব থেকেই অনেক শিক্ষার্থী-অভিভাবকের থাকার ব্যব¯’া করা হয়েছিল। কক্ষে এসেই আবু সালাম আর তুষারের চোখে মুখে দেখলাম একটি কৃতজ্ঞতার হাসি। এ হাসি যেন সেই স্তব্ধতার গল্পকেও হার মানিয়ে যায়।


প্রকাশিত: মার্চ ৬, ২০২৪ | সময়: ৫:২৮ পূর্বাহ্ণ | সুমন শেখ