সরকারের সামনে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের চ্যালেঞ্জ

সানশাইন ডেস্ক: আসছে রমজান মাস। এই মাসকে সামনে রেখে অনেকটাই চ্যালেঞ্জের মুখে সরকার। দ্রব্যমূল্য কমানো ও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণকে এ মুহূর্তে সবচেয়ে অগ্রাধিকার দিচ্ছে নতুন সরকার। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়ী হয়ে টানা চতুর্থবারের মতো সরকার গঠনের পর মন্ত্রিপরিষদের প্রথম বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজে এ সংক্রান্ত কিছু দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। সে অনুযায়ী অর্থ, বাণিজ্য, খাদ্য ও কৃষি মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে একটি আন্তমন্ত্রণালয় কমিটিও গঠিত হয়েছে। কমিটির সুপারিশে চাল, ভোজ্যতেল, চিনি ও খেজুরের ওপর আরোপিত শুল্ক কমিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। কিন্তু বাজারে এর কোনও প্রভাব নেই। ভরা মৌসুমে এখনও পেঁয়াজের কেজি ১৩০ টাকা। ভোজ্যতেল লিটারে ১০ টাকা কমিয়ে বিক্রির সিদ্ধান্ত ১ মার্চ থেকে কার্যকর করার কথা থাকলেও তা বাস্তবায়নে রয়েছে নানাবিধ শঙ্কা। এসব কারণেই নিত্যপণ্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণকেই সরকারের সামনে মূল চ্যালেঞ্জ হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, মধ্যপ্রাচ্য সংকটের কারণে টালমাটাল বিশ্ব অর্থনীতি। বাংলাদেশও এই সংকটের বাইরে নয়। আমদানি করা পণ্য গম, ভোজ্যতেল, জ্বালানি তেল ও তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি), সার, তুলা, ডাল, চিনি প্রভৃতি পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি বাজারে চাপ সৃষ্টি করে। এমন পরিস্থিতিতে রমজানকে সামনে রেখে বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখতে সরকার চাল, ভোজ্যতেল, চিনি ও খেজুর এই চার পণ্যের শুল্ক কমিয়েছে। গত ৮ ফেরুয়ারি এগুলোর আমদানি শুল্ক কমানোর প্রজ্ঞাপন জারি করে এনবিআর।
সিদ্ধ ও আতপ চালের আমদানি শুল্ক পুরোপুরি প্রত্যাহার করা হয়েছে। সিদ্ধ ও আতপ চাল আমদানিতে নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক বা রেগুলেটরি ডিউটি ২৫ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশ করা হয়েছে। এ সুবিধা চাল আমদানিকারকরা পাবেন আগামী ১৫ মে পর্যন্ত। দেশে পরিশোধিত সয়াবিন ও পাম তেলের উৎপাদন ও ব্যবসা পর্যায়ের মূল্য সংযোজন কর বা মূসক বা ভ্যাট পুরোপুরি তুলে নেওয়া হয়েছে। এ সুবিধা তারা পাবেন আগামী ১৫ এপ্রিল পর্যন্ত। বিদেশ থেকে পরিশোধিত ও অপরিশোধিত সয়াবিন তেল এবং পাম তেল আমদানি পর্যায়ে ১৫ শতাংশ ভ্যাট কমিয়ে ১০ শতাংশ করা হয়েছে। আমদানিকারকরা এ সুবিধা পাবেন ১৫ এপ্রিল পর্যন্ত। খেজুরের আমদানি শুল্ক ১০ শতাংশ কমানো হয়েছে। আগে আমদানি শুল্ক ছিল ২৫ শতাংশ। আমদানিকারকরা এ সুবিধা পাবেন আগামী ৩০ মার্চ পর্যন্ত। পরিশোধিত ও অপরিশোধিত উভয় ধরনের চিনির আমদানি শুল্ক কমানো হয়েছে। অপরিশোধিত চিনি আমদানিতে প্রতি মেট্রিক টনে আমদানি শুল্ক কমিয়ে এক হাজার টাকা করা হয়েছে। আগে যা ছিল দেড় হাজার টাকা। আর পরিশোধিত চিনি আমদানিতে টনপ্রতি আমদানি শুল্ক কমিয়ে করা হয়েছে দুই হাজার টাকা, আগে যা ছিল তিন হাজার টাকা। এই শুল্ক ছাড় পাওয়া যাবে ৩১ মার্চ পর্যন্ত।
শুল্ক কমানোর পরও বাজারে ওই চার ভোগ্যপণ্যের দাম এক পয়সাও কমেনি। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে পেঁয়াজ, রসুন, আদাসহ মাছ ও মাংসের দাম বৃদ্ধি। প্রতি কেজি গরুর মাংস কিছু দিন আগে ৫৮০ থেকে ৬০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হলেও রমজানকে সামনে রেখে ব্যবসায়ীরা সিদ্ধান্ত নিয়ে তা আবারও বিক্রি করছে ৭৫০ থেকে ৮০০ টাকা কেজি দরে। মাঠ ও কৃষকের ঘর ভরা পেঁয়াজ। ভরা মৌসুমেও ১৩০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে দেশি পেঁয়াজ। সরকার থেকে বারবারই বলা হচ্ছে মার্চের প্রথম সপ্তাহেই আসবে ভারতের পেঁয়াজ। সেটা এলেই বাজারে পেঁয়াজের দাম কমবে।
সুযোগ পেয়ে সেরকম কোনও কারণ ছাড়াই বাড়তি দামে বিক্রি হচ্ছে আদা ও রসুন। ট্যাক্স কমানোর পরেও প্রতিকেজি সাধারণ মানের খেজুরের দাম ২৩০ থেকে ২৫০ টাকা। এক মাস ধরে এ দরেই এসব খেজুর বিক্রি করছেন ব্যবসায়ীরা। যা গত বছরের তুলনায় কেজিতে ১০০ থেকে ১৫০ টাকা বেশি।
গত কয়েক মাস ধরে চিনির বাজার রহস্যময় আচরণ করছে। আন্তর্জাতিক বাজারেও দাম চড়া। সরবরাহেও রয়েছে সমস্যা। এ কারণে এই মুহূর্তে সরকার নিজেও টিসিবির জন্য চিনি আমদানি কমিয়ে দিয়েছে। এ নিয়ে সৃষ্ট জটিলতায় চিনি বিক্রি বন্ধ রেখেছে টিসিবি। প্রতিকেজি খোলা চিনিও বিক্রি হচ্ছে ১৬০ টাকা দরে। সরকারের পক্ষে শিল্প মন্ত্রণালয় থেকে চিনির দাম কেজিতে ১০ টাকা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত দুদিন পরেই বাতিল করেছে শিল্প মন্ত্রণালয়। কিন্তু সর্বনাশ যা হওয়ার তা হয়ে গেছে। বাড়তি দামে বিক্রি করা চিনির দাম আর নামানো যায়নি।
আগের মতোই প্রতিলিটার বোতলজাত সয়াবিন তেল ১৭০ থেকে ১৭৩ এবং খোলা তেল ১৫৮ থেকে ১৬৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আর পাম তেলের লিটার ১৩০ থেকে ১৩৫ টাকা। এক মাসের বেশি সময় ধরে এ দরেই বিক্রি হচ্ছে ভোজ্যতেল। শুল্ক কমানোর কারণে লিটারে ১০ টাকা কমিয়ে বিক্রির সিদ্ধান্ত ১ মার্চ থেকে কার্যকরের নির্দেশনা থাকলেও তা বাস্তবায়ন নিয়ে ভোক্তা পর্যায়ে রয়েছে নানা ধরনের আশঙ্কা।
বাজারে প্রতিকেজি মিনিকেট চাল এখনও ৭২ থেকে ৭৫ টাকা, মাঝারি মানের চাল ৫৫ থেকে ৬৫ ও মোটা চালের কেজি ৫২ থেকে ৫৪ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। শুল্ক কমানোর পর চালের দাম কমেনি। তবে চলতি অর্থবছরে এখনও কোনও ধরনের চাল আমদানি হয়নি। গত বছর ১৭ থেকে ১৮ লাখ টন চাল আমদানির অনুমতি দিলেও আনা হয়েছে চার লাখ ২১ হাজার টন।
জানতে চাইলে সিটি গ্রুপের বিশ্বজিৎ সাহা জানিয়েছেন, বাংলাদেশে চিনি আসে প্রধানত ব্রাজিল থেকে। আর সয়াবিন ও পাম তেল আনা হয় ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়া থেকে। ব্রাজিল থেকে চিনি আনতে সব মিলিয়ে কমপক্ষে এক মাস লাগে। আর ভোজ্যতেল আনতে ১৫ দিন থেকে এক মাস লাগে। ফলে আমরা নতুন আমদানি করলে শুল্ক কমানোর সুবিধা পাবো। তারপরও আমরা চেষ্টা করছি আগেই আমদানি করা তেল ও চিনির দাম কমাতে। কয়েক দিনের মধ্যেই তেলের দাম কিছুটা কমবে। অনেকেই রোজার মাসের চাহিদা হিসাব করে তেল-চিনি নিয়ে এসেছেন। হয়তো ওই মাসের জন্য নতুন অল্প কিছু আমদানি হবে। পাইপলাইনে যা আছে তা শুল্ক সুবিধা পাবে। যার এলসি আগেই খোলা হয়েছে, পাইপলাইনে আছে, সেগুলো নির্ধারিত সময়ের আগে খালাস হলে শুল্ক সুবিধা পাওয়া যাবে। সরকার যে নির্ধারিত সময়ের জন্য শুল্ক সুবিধা দিয়েছে, তাতে অল্প অল্প পরিমাণ তেল-চিনি এই সুবিধায় আনা যাবে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান বলেন, সামনে রমজান মাস। রমজানকে সামনে রেখে অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের তৎপরতা বাড়বে। কৃত্রিম সংকট তৈরি করে বাজারে দ্রব্যমূল্য বাড়ানো হবে। এতে ভোক্তার কষ্ট আরও বাড়বে। ভোগ্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় সাধারণ মানুষের সবচেয়ে বেশি কষ্ট হয়। এ কারণে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে সরকারের কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। প্রয়োজনে মুদ্রানীতি, রাজস্ব নীতি ও সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি সমন্বয়ের মাধ্যমে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। এছাড়া আমদানি শুল্ক হ্রাস করে পণ্য আমদানি ব্যয় কমিয়ে আনতে হবে। তিনি যুক্ত করেন, নিত্যপণ্যের বাজারে স্বস্তি দিতে নতুন বছরে মূল্যস্ফীতি ৪-৫ শতাংশের মধ্যে নামিয়ে আনা প্রয়োজন।
এ প্রসঙ্গে বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম টিটু জানিয়েছেন, আমরা বাজার নিয়ন্ত্রণে কাজ শুরু করেছি। আসলে ব্যবসায়ীরা দাম বাড়ায়, কৃত্রিম সংকট তৈরি করে। তারা ইচ্ছা করে সরবরাহ কমিয়ে দিয়ে বাজারকে অস্থির করে তোলে। এবার যাতে সেটা করতে না পারে সেজন্য আমরা নানা ব্যবস্থার কথা ভাবছি। ১ মার্চ থেকে রমজানে প্রয়োজনীয় এই চারটি পণ্য কম দামে বিক্রি করতে হবে। আমরা এর মধ্যে আমদানিকারকদের আগে আনা পণ্য ক্লিয়ার করতে বলেছি। এক তারিখ থেকে আমরা আমদানিকারকদের গুদামে ইন্টারভেন করবো।
এদিকে, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, গত নভেম্বরে দেশের মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৪৯ শতাংশ। এছাড়া দেশি-বিদেশি নানা সংকটের মুখে বছরের শুরুতে মূল্যস্ফীতি দাঁড়ায় ১২ শতাংশের ওপরে। বিশেষ করে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধি, ডলারের মূল্য বৃদ্ধি ও খাদ্যপণ্য আমদানি ব্যাহত হওয়ার কারণে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যায়। তবে তা এখন ধীরে ধীরে কমতে শুরু করেছে। বিশেষ করে খাদ্যে মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমায় স্বস্তি ফিরতে শুরু করেছে নিত্যপণ্যের বাজারে।


প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ২৯, ২০২৪ | সময়: ৫:২৯ পূর্বাহ্ণ | সুমন শেখ