রাবির মেধাবী ছাত্রের মৃত্যু : জন্ডিসে কেড়ে নিলো দিনমজুর বাবার স্বপ্ন ভাই হারানোর শোকে বোনের মৃত্যু

অহিদুল হক, বড়াইগ্রাম: ‘পরের জমিতে কাজ কইরি, শীতের মধ্যে খেজুর গাছ লাগাইয়ি দুই ছাওয়ালের জন্যি খরচ করিচি। বড়ডা গতবছর চাকরী পাইছে। ছোট ছাওয়াল লেখাপড়া শিকপি, বড় অফিসার হবি এই আশায় কখনও ধার করে, কখনও সুদের উপরে লিয়েও টাকা পাটাইচি। ছাওয়াল চাকরী পাইলি আমার দুঃখু ঘুচপি। ছাওয়ালও বইলতো, আব্বা আর কয়ডা দিন কষ্ট করো, আমি চাকরী পাইলে তোমারে আর এইসব কাজ করতে দিবো না। তখন আর এতো কষ্ট করা লাইগবি না। কিন্তু আমার কষ্ট আর দুর হইলো না।’
বুক চাপড়ে কাঁদতে কাঁদতে কথাগুলো বলছিলেন নাটোরের বড়াইগ্রামের কাটাশকোল গ্রামের দিন মজুর আব্দুস সাত্তার মৃধা। তিনি সোমবার সন্ধ্যায় জন্ডিস রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়া রাবির মেধাবী ছাত্র মুরাদ হোসেন মৃধার হতভাগ্য বাবা। মুরাদ গণিত বিভাগের ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী।
এদিকে, মুরাদের মৃত্যুর খবর সইতে না পেরে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে কয়েক ঘন্টার মধ্যেই চাচাতো বোন দোলেনা বেগমও (৫২) মারা যান।
জানা যায়, গত ২৬ জানুয়ারী মুরাদ বাড়ি এসে জ্বরে আক্রান্ত হন। স্থানীয় চিকিৎসকের কাছে পাঁচ দিন চিকিৎসা করার পরও সুস্থ না হওয়ায় তাকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। লিভার ও কিডনির সমস্যা ধরা পড়ে তার। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় সোমবার সন্ধ্যায় তিনি মারা যান। রাতেই বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষকের নেতৃত্বে সহপাঠিরা তার মরদেহ বাড়িতে পৌঁছে দেন।
মঙ্গলবার সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, বাড়িতে টিনের ছাপড়া এবং পাটকাঠি ও বনের বেড়ার তিনটি ঘর। উঠানে খাটিয়ায় শোয়ানো মুরাদের লাশ। খবর পেয়ে স্বজনসহ এলাকার লোকজন লাশটি দেখার জন্য ওই বাড়িতে আসছেন। ছেলে হারা বাবা-মায়ের বুক ফাটা কান্নায় এলাকার পরিবেশ ভারী হয়ে উঠেছে।
স্বজনরা তাদের শান্তনা দেয়ার চেষ্টা করছেন। মুরাদের খালাতো ভাই আলমগীর কবিরাজ জানান, বাড়ির ভিটাসহ মাত্র বিঘা খানেক জমি আছে মুরাদের বাবার। দুই ছেলের মধ্যে বড় ছেলে ঢাকায় একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরী করে। স্ত্রীকে নিয়ে তিনি সেখানেই থাকেন। মুরাদের বাবা পেশায় দিনমজুর। তবে শীতকালে খেজুর গাছ লাগিয়ে গুড় তৈরি করে বিক্রি করে ছেলের লেখাপড়াসহ কোন রকমে নিজেদের সংসার চালান।
মুরাদের বাবা আব্দুস সাত্তার মৃধা কাঁদতে কাঁদতে জানান, মুরাদ মাত্র এক মাস আগে গণিত বিভাগ থেকে অনার্স পরীক্ষায় ফাষ্টক্লাশ পেয়ে উত্তীর্ণ হন। বর্তমানে তিনি মাস্টার্স শেষ বর্ষের ছাত্র ছিলেন। সে খবর মোবাইলে বাড়িতে জানালে আনন্দে অভাবের মাঝেও মিষ্টি কিনে সবাইকে খাইয়েছিলেন তিনি। মুরাদের স্বপ্ন ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক বা বিসিএস দিয়ে প্রশাসনিক কর্মকর্তা হবার। বিসিএস দেয়ার জন্য প্রস্তুতি নিতেও শুরু করেছিলেন মুরাদ।
মুরাদের স্কুল শিক্ষক বেনেডিক্ট গমেজ জানান, মুরাদ অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র ছিল। ওর মতো এতো ভদ্র ও বিনয়ী ছাত্র পাওয়া মুশকিল। ছুটিতে বাড়িতে এলে মাঝে মাঝেই স্কুলের স্যারদের সঙ্গে দেখা করতে আসতো। খুব ওকে নিয়ে আমরা স্বপ্ন দেখেছিলাম যে, সে বড় কিছু হবে। কিন্তু সর্বনাশা ডেঙ্গু সব স্বপ্ন কেড়ে নিলো।
জোয়াড়ী ইউপি চেয়ারম্যান আলী আকবর জানান, মঙ্গলবার সকাল ১১টায় নিজ বাড়ির আঙ্গিনায় জানাযা শেষে স্থানীয় কবরস্থানে তার লাশ দাফন করা হয়েছে। দরিদ্র বাবার মেধাবী সন্তানের এমন করুণ মৃত্যু সত্যিই খুব কষ্টকর।


প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ৭, ২০২৪ | সময়: ৬:৪৯ পূর্বাহ্ণ | সুমন শেখ

আরও খবর