আলু নিয়ে অস্থিরতা আলুর জেলাতেই

সানশাইন ডেস্ক: সরকারের বেঁধে দেওয়া দাম ২৭ টাকা কেজি আলু বিক্রির নির্দেশনা আসার পর থেকেই মুন্সীগঞ্জের হিমাগারগুলোয় নেমে এসেছে স্থবিরতা। অলিখিতভাবে আলু বিক্রি বন্ধ করে হাত গুটিয়ে নিয়েছেন বড় মজুতদার ও ব্যবসায়ীরা। ফলে স্থানীয় ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা হিমাগারগুলোয় গিয়ে আলু কিনতে পারছেন না।
এ অবস্থার অবসান ঘটাতে দফায় দফায় আলু মজুতদার ও খুচরা ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সমন্বয় সভা করেছে স্থানীয় প্রশাসন। সবশেষ গেল মঙ্গলবার বিকালে জরুরি সভা করে তিন দিনে ৫০ কেজি ওজনের ৫৬ হাজার বস্তা আলু হিমাগার থেকে সরকার নির্ধারিত মূল্যে ২৭ টাকা কেজি দরে এবং খুচরা বাজারে সর্বোচ্চ ৩৭ টাকা কেজিতে বিক্রির টার্গেট নির্ধারণ করে জেলা প্রশাসন। টার্গেট নির্ধারণের দুই দিন অতিবাহিত হলেও বাস্তবে সে পরিমাণ আলু হিমাগার থেকে বিক্রি হয়নি।
মুন্সীগঞ্জের রিকাবীবাজারের আড়তদার মো. শাওন বলেন, সরকার আলুর দাম নির্ধারণ করেছে ২৭ টাকা। কিন্তু আমরা বর্তমানে হিমাগার থেকে ২৭ টাকা করে কিনতে পারছি না। ব্যবসায়ীরা আমাদের কাছে আলুর দাম চাইছেন ৩৬ থেকে ৩৭ টাকা করে। কয়েকটি হিমাগারে যোগাযোগ করেছি, তারা আলুর দাম বেশি চাইছে। তাই আলু না কিনে ঘর খালি রেখেছি। বাজার স্বাভাবিক হলে কিনে বিক্রি করবো।
কয়েক দিন হিমাগারে ঘুরে আলু কিনতে পারেননি পাইকার শাহ আলী। তিনি বলেন, আমি চার দিন ধরে কয়েকটি হিমাগারে ঘুরেছি। এখনও আলু কিনতে পারিনি। দাম বেশি হওয়ায় হিমাগার থেকে ব্যবসায়ীরা আলু বের করছেন না। এখন আমাদের চলতে অনেক কষ্ট হচ্ছে। লোকসান তুলতেই আলু ব্যবসায়ীরা মানছে না সরকারি নির্দেশনালোকসান তুলতেই আলু ব্যবসায়ীরা মানছে না সরকারি নির্দেশনা
জানতে চাইলে আলু ব্যবসায়ী মোতা গাজী বলেন, আমরা কৃষকের কাছ থেকে যে দামে আলু কিনেছি আর সরকারের বেঁধে দেওয়া ২৭ টাকা দামে আলু বিক্রি করলে প্রতি কেজিতে লোকসান হবে অন্তত ১০ টাকা। তাই আমরা হিমাগার থেকে আলু বিক্রি বন্ধ রেখেছি। সরকারের কাছে দাবি, ৩০ টাকা করে যদি পুনরায় দাম নির্ধারণ করে, তাহলে আমরা উপকৃত হবো। গত কয়েক বছর আলুতে আমাদের অনেক লোকসান হয়েছে।
তবে কিছুটা প্রাণচাঞ্চল্য ফিরেছে হিমাগারগুলোয়। বৃহস্পতিবার দুপুরে মুন্সীগঞ্জের মুক্তারপুরে কয়েকটি হিমাগারে গিয়ে দেখা যায়, হিমাগার থেকে আলু বের করে ছাউনির মধ্যে রেখে সেগুলো বাছাই করছেন শ্রমিকরা। রিভারবিউ হিমাগারের ব্যবস্থাপক রেজাউল করিম জানান, চলতি মৌসুমে হিমাগারে সংরক্ষিত থাকা আলু শেষ করতে হলে প্রতিদিন কমপক্ষে ৬০০ বস্তা আলু শেডে রেখে বাজারজাত করার প্রস্তুতি নিতে হবে। অথচ এখন প্রতিদিন ২০০ বস্তা বিক্রির জন্য শেডে ঢালা হয়। সরকার নির্ধারিত ২৭ টাকা দামে আলু বেচাকেনা তেমনভাবে শুরু হয়নি মুন্সীগঞ্জের হিমাগারগুলোয়। ব্যবসায়ীরা বেশি মুনাফার আসায় এখনও তেমন আলু বিক্রি করছেন না। শেষ পর্যন্ত আলু থেকে যাবে হিমাগারে।
তিনি আরও বলেন, তবে সরকার নির্ধারিত দামে বিক্রি বাস্তবায়ন করতে আলু বিক্রির রসিদ ও কোথায় আলু বিক্রি হচ্ছে, সেই রসিদ ও চালান দেখে হিমাগার থেকে আলু বের করছি আমরা। খুচরা বাজারে আলুর দামে অস্থিরতা শুরু হওয়ায় সম্প্রতি সরকার আলুর দাম প্রতি কেজি ৩৫ থেকে ৩৬ টাকা এবং হিমাগার পর্যায়ে ২৬ থেকে ২৭ টাকা নির্ধারণ করে দেয়। তবে সেই নির্দেশনার তোয়াক্কা না করে ব্যবসায়ীরা হিমাগার থেকে ৩৪ থেকে ৩৬ টাকা এবং খুচরা বাজারে ৪০ থেকে ৪২ টাকা কেজিতে বিক্রি করতে থাকেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্যবসায়ী বলেন, গত দুই বছর আমার ২০ লাখ টাকা লোকসান হয়েছে। এই বছর একটু লাভের মুখ দেখেছিলাম। তার মধ্যে সরকার আলুর দাম নির্ধারণ করে দেয়। আর সরকার যে দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে, সেই দামে বিক্রি করলে মাঠে মারা যাবো। তাই বাধ্য হয়েই বেশি দামে বিক্রি করতে হচ্ছে। মোবাইল ফোনে একরকম দাম হাঁকা হচ্ছে আর হিমাগার থেকে সরকারি মূল্য অনুযায়ী চালান করা হচ্ছে।
এদিকে গেলো শনিবার মুন্সীগঞ্জের হিমাগারে পরিদর্শনে আসেন জাতীয় ভোক্তা অধিকারের মহাপরিচালক (ডিজি) এ এইচ এম সফিকুজ্জামান। হিমাগার পরিদর্শন শেষে তিনি ২৬ থেকে ২৭ টাকা কেজি দরে পাইকারি ও খুচরা বাজারে ৩৫ থেকে ৩৬ টাকায় আলু বিক্রির বিষয়টি নিশ্চিত করতে নির্দেশ দেন মুন্সীগঞ্জ জেলা প্রশাসককে। এ ছাড়া আলু বিক্রির ক্ষেত্রে পাকা রসিদ ব্যবহার বাধ্যতামূলক নির্দেশনাও দেন তিনি।
এই নির্দেশনার পরিপ্রেক্ষিতে স্থানীয় প্রশাসন ও ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর নিয়মিত অভিযান চালিয়ে হিমাগার কর্তৃপক্ষ ও ব্যবসায়ীদের আর্থিক দণ্ড অব্যাহত রেখেছে। কিন্তু এত কিছুর পরও আলুর বাজারে দামের লাগাম টেনে ধরা সম্ভব হয়নি। মুন্সীগঞ্জ ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের সহকারী পরিচালক আব্দুস সালাম বলেন, সরকারের বেঁধে দেওয়া আলুর দাম কার্যকর করতে জেলা সদর ও প্রতিটি উপজেলার হিমাগার আড়ত ও বাজারগুলোয় অভিযান চালাচ্ছি। আলুর বাজার নিয়ন্ত্রণে এ অভিযান অব্যাহত থাকবে।
আলু না কিনে ঘর খালি রেখেছেন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা। বাজার স্বাভাবিক হলে কেনার কথা জানান তারা।আলু না কিনে ঘর খালি রেখেছেন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা। বাজার স্বাভাবিক হলে কেনার কথা জানান তারা। এদিকে বৃহস্পতিবার বিকাল থেকে মুন্সীগঞ্জ আলু চাষি ও ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির উদ্যোগে ভ্রাম্যমাণ ট্রাকে করে খোলা বাজারে ৩৬ টাকা কেজিতে আলু বিক্রি শুরু হয়েছে। প্রতিদিন অন্তত ৪০ টন আলু ন্যায্য মূল্যে খোলাবাজারে বিক্রির টার্গেট রয়েছে তাদের।
মুন্সীগঞ্জ জেলা প্রশাসক মো. আবু জাফর রিপন বলেন, জেলা প্রশাসনের তত্ত্বাবধানের ট্রাকে করে ৩৬ টাকা দামে আলু বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে আলুচাষি ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতি। এই উদ্যোগ অসাধু ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। ট্রাকে করে জেলা শহরের বিভিন্ন পয়েন্টে এই আলু বিক্রি করা হবে। প্রতিদিন ৪০ টন আলু বিক্রি হবে। তবে একজন ক্রেতা সর্বোচ্চ পাঁচ কেজি আলু কিনতে পারবেন।
তিনি আরও বলেন, সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী আলুর বিক্রির ক্ষেত্রে ক্রেতা-বিক্রেতার পাকা রসিদ ব্যবহার করতে হবে। হিমাগার থেকে সরকার নির্ধারিত মূল্যে ২৭ টাকা কেজি দরে ও খুচরা বাজারে ৩৭ টাকা বেঁধে দেওয়া দামে আলু বিক্রি করতে মাঠে তদারক করছে প্রশাসন ও ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণের টিম। নির্দেশনা অমান্য করলে জরিমানাসহ আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।


প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ২৩, ২০২৩ | সময়: ৪:৫৮ পূর্বাহ্ণ | সুমন শেখ