নৈতিক অবক্ষয়ে শিক্ষার্থীরা 

শাহ্জাদা মিলন : 

শিক্ষা নগরী হিসেবে সুনাম দেশব্যাপি রাজশাহীর। তবে বেশিরভাগ শিক্ষার্থীদের চলাফেরা ও নৈতিক শিক্ষার ঘাটতি থাকায় বিব্রত বোধ করছেন সড়কে চলাচলরত অভিভাবক ও অন্যান্যরা। আধুনিকতার নামে পিতামাতাও অনেক সময় সন্তানদের সকলের সাথে মিশতে দিচ্ছেন। তবে অনেক অভিভাবক খোঁজ নেন না স্কুল কলেজ চলাকালীন ও ছুটির পর কোথায় থেকে সন্তানরা ঘরে ফিরছে। এদিকে শহরে চলাচলরত রিক্সায় হুট উঠিয়ে ইউনিফর্ম পরিহিত অবস্থায় একে অপরকে জড়িয়ে থাকতে দেখা যাচ্ছে।

 

বর্তমান ইন্টারনেটের যুগে পরিবারের সাথে সময় দেয়ার চেয়ে বন্ধুদের সাথে সময় দিতে মোবাইলে সময় পার করছে বেশিরভাগ শিক্ষার্থীরা। ফলে ক্লাস সেভেনের পরেই অনেক শিক্ষার্থীদের হাতে দেখা মিলছে মোবাইল ফোন। সেখানেই যোগাযোগ করে দলবেধে ঘুরে বেড়ানো ছাড়াও অনেক সময় অনৈতিক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ছে শিক্ষার্থীরা। এর ফলে পড়ালেখায় ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে যার ফল ধরা পড়ছে ফলাফলে।

 

উপশহর দড়িখরবোনা রেললাইনের পাশে চায়ের দোকানে চা খেতে আসা ষাটোর্দ্ধ জামাল নামের এক বৃদ্ধের পাশে সিগারেট টানছিলেন ১৪ থেকে ১৭ বছরের কিশোররা। পাশের বৃদ্ধের দিকে কোন খেয়াল নেই কিশোরদের। কিশোরদের আলাপচারিতায় অশ্লীল কথাবার্তা ছিল সবসময়। কিশোররা চলে যাওয়ার পর সেই বৃদ্ধকে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি জানান,এখন আর আগের মত সম্মান দেখা যায়না। আমরাও বড় হয়েছি কিন্তু আমাদের বড় কেউ থাকলে তাদের সামনে আসতাম না যদি আব্বা আম্মাকে বলে দেয় এই ভয়ে। এখনকার ছেলে মেয়েরা তো ভয় পায়না। ক্লাসে শিক্ষকরাও এখন নাকি কিছু বলতে পারেন না। নৈতিক শিক্ষা আসবে কিভাবে বলে আক্ষেপ করেন।

 

 

দেখা যায়, কিশোররা ড্রাইভিং লাইসেন্স না থাকলেও স্কুল কলেজে বাইক নিয়ে যাচ্ছে নিজেকে অন্য ভাবে জাহির করতে। তার দেখাদেখি অন্য শিক্ষার্থীরাও বায়না করছে পরিবারে ফলে অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হলেও সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে অনেক সময় বাইক কিনে দিতে বাধ্য হচ্ছেন অভিভাবকরা আর সন্তানকে ঠেলে দিচ্ছেন জীবনের ঝুঁকিতে। এই শখের বাইক দুর্ঘটনায় আহত হয়ে তাদের সন্তান বিকলাঙ্গ হচ্ছে অল্প বয়সে। আর বড় দুর্ঘটনা ঘটলে প্রিয় সন্তানকে দিতে হচ্ছে অভিভাবকদের নিজ হাতে মাটি।

 

 

গত কয়েকবছরে রাজশাহীর বিভিন্ন অলিতে গলিতে ব্যাঙের ছাতার মত গজিয়ে কোচিং সেন্টার গড়ে উঠেছে। একেক কোচিংয়ে একটা করে বিষয় পড়ানোর কারণে শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন কোচিংয়ে যাওয়ার নামেও অনেক সময় বাইরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এই বিষয়টিও পরিবারের ধারণার বাইরে থেকে যাচ্ছে। বিকেল হলেই নদীর ধারে কিংবা রেস্টুরেন্ট বা কফি শপগুলোতে দেখা মিলছে স্কুল কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের জমজমাট আড্ডা। লোকলজ্জার ভয় তো নেই আধুনিকতার নামে কয়েকজন মিলে বিদেশি সংস্কৃতির ডিজে পার্টিও করছেন শহরের নামকরা হোটেল গুলোতে।

 

 

 

তবে রাজশাহী শহরকে স্বাভাবিক পরিবেশে ফিরিয়ে আনতে ইতোমধ্যে আরএমপি কর্তৃক শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রনে বিভিন্ন দিক নির্দেশনা, ড্রাইভিং লাইসেন্স সহ বাইক চালানো, গাড়িতে জোরে শব্দ তৈরি করা হলার খুলে ফেলা, স্কুল ড্রেস পরিহিত অবস্থায় বিনোদন কেন্দ্রে পাওয়া গেলে কৈফিয়ত সহ বিভিন্ন ধরণের পদক্ষেপ দেখা গেছে। তবে এখন পর্যন্ত রিক্সায় অশালীনভাবে শিক্ষার্থীদের চলাফেরার ক্ষেত্রে কোন পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি।

 

 

রাজশাহীর সিনিয়র সাংবাদিক ও সুশাসনের জন্য নাগরিক ( সুজন) এর রাজশাহী জেলা সভাপতি আহম্মেদ শফিউদ্দিন বলেন, নৈতিক অবক্ষয় থেকে সন্তানদের রক্ষা করতে হলে ত্রীড়া, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে ব্যস্ত রাখতে হবে। এখনতো সাংস্কৃতিক চর্চা অনেক কমে গেছে। ধর্মীয় নেতৃবৃন্দের বাস্তবধর্মী আলোচনা বেশি করতে হবে। রাজনৈতিক নেতারা যুবকদের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছেন, এটা বন্ধ করতে হবে। সিনিয়র সিটিজেন নীতিমালা ২০১৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হলেও আজ অব্দি বাস্তবায়িত হয়নি। সিনিয়রদের সম্মান যখন সবাই দেয়া শিখবে তথন কোমলমতি শিক্ষার্থীরা তাই দেখে শিখবে। অথচ রাষ্ট্রইতো এ সম্মান এখনো দিতে পারছেনা। সামগ্রিক ভাবে এই অবক্ষয় দূর করতে আমাদের সামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিক গবেষণা প্রয়োজন। দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করে ছোটদের সবসময় কাজে ব্যস্ত রাখতে হবে। ভালো কাজে উৎসাহ দিতে হবে। তবে নৈতিক অবক্ষয় থেকে শিক্ষার্থী ও কিশোর কিশোরীদের মুক্ত করা সম্ভব।

 

 

নৈতিক অবক্ষয়ের বিষয়ে রাজশাহী কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর আব্দুল খালেক বলেন,বর্তমানে বেশিরভাগ শিক্ষার্থীরা সামাজিক ও পারিবারিক কারনে বিষন্নতায় ভূগছে বলে মনে হয়। যার কারনে পরিবার ছেড়ে বন্ধুবান্ধবদের সাথে আড্ডা দিচ্ছে। একজন খারাপ ছেলে আরো পাঁচটা ভালো ছেলেকে নেশার পথে নিয়ে যাচ্ছে। বর্তমান প্রশাসনের কাছে অনুরোধ রাখবো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চলাকালীন সময়ে যেনো কোচিং সেন্টার না খোলা থাকে সেদিকে দৃষ্টিপাত করেন। কারন শিক্ষার্থীরা এখন ক্লাসমুখী না হয়ে কোচিংমুখি হওয়ার প্রবণতা বেশি দেখাচ্ছে। কারন ক্লাসে থাকলে বাইরে বের হওয়ার সুযোগ কম আর কোচিংয়ের নামে বাইরে ঘুরে বেড়ালেও কেউ দেখার থাকছে না।

 

 

আমি মনে করি, যদি সিটি মেয়র,আরএমপি,ডিসি,সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক ও অভিভাবকবৃন্দকে একই টেবিলে আনা সম্ভব হয় তবে এই নৈতিক অবক্ষয় থেকে পরিত্রাণ অনেকটা কমানো সম্ভব। আমাদের কোমলমতি সন্তান শিক্ষার্থীরা চোখের সামনে নষ্ট হলে গেলে ভবিষ্যত দেশ পরিচলনা করা খুব কষ্টকর হয়ে পড়বে। তাই অবক্ষয় রোধে পরিবারে ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে পড়ালেখার পাশাপাশি সামাজিক ও নৈতিক মূল্যবোধ শেখাতে হবে।

 

 

সার্বিক বিষয়ে আরএমপির মিডিয়া মুখপাত্র অতিরিক্ত উ-পুলিশ কমিশনার জামিরুল ইসলাম বলেন, এইচএসসির আগে শিক্ষার্থীদের তো লাইসেন্স হওয়ার বয়স হয় না সেক্ষেত্রে তারা সম্পূর্ণ বেআইনিভাবে বাইক চালাচ্ছে হয়তো। তবে আমাদের পুলিশ কমিশনার স্যারের কঠোর নির্দেশ রয়েছে, বাইক পার্টি,হলার লাগিয়ে শব্দ দূষণকারীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য। তাছাড়া রিকশায় অশালীনভাবে কাউকে পাওয়া গেলে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা চলমান রয়েছে।  আসলে নৈতিক অবক্ষয় থেকে বাঁচাতে সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে। অভিভাবকদের তাদের সন্তানকে একটু বেশি সময় দেয়া,কোথায় যাচ্ছে সেটির খোঁজ নেয়া,বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণের মাধ্যমে সন্তানদের সাথে নিয়ে বেড়ানো গেলে এটি কমে আসবে।

সানশাইন / শামি


প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ১১, ২০২৩ | সময়: ৯:৫৯ অপরাহ্ণ | Daily Sunshine