যেসব কারণে বিনিয়োগ কমছে সঞ্চয়পত্রে

সানশাইন ডেস্ক: সরকার সামাজিক সুরক্ষার কথা বিবেচনায় নিয়ে সঞ্চয়পত্রে বেশি মুনাফা দেয় সরকার। নিম্ন-মধ্যবিত্ত, সীমিত আয়ের মানুষ, নারী-প্রতিবন্ধী ও অবসরপ্রাপ্ত চাকরিজীবীদের জন্য সঞ্চয়পত্রের বিভিন্ন প্রকল্প চালু রয়েছে। কিন্তু কেন গ্রাহক সঞ্চয়পত্র থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। কেন বিক্রির চেয়ে পরিশোধ করা হচ্ছে বেশি। এসব নিয়ে সাধারণ গ্রাহক ও খাত সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা হয়।
সাধারণ গ্রাহক বলছেন, পণ্য ও সেবার দামে লাগামহীন ঊর্ধ্বগতিতে জীবনযাপনে খরচ বেড়েছে কয়েকগুণ। এর প্রভাব পড়ছে সঞ্চয়ে। এছাড়া সাম্প্রতিক সময়ে কড়াকড়ি আরোপ করাসহ নানা কারণে সঞ্চয়পত্র বিক্রি তলানিতে নেমেছে। যাদের কাছে টাকা আছে, তারাও কড়াকড়ির কারণে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগে আগ্রহ হারাচ্ছেন। এতে সঞ্চয়পত্র বিক্রিতে ধস নেমেছে। খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মূলত উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে জীবনযাত্রার মান ব্যহত হচ্ছে। বেশ বিপাকে পড়ছেন সীমিত আয়ের মানুষ। ক্রয়ক্ষমতা কমে যাচ্ছে। ভোগ কমিয়ে হাতের বাড়তি টাকা দিয়ে পরিস্থিতি মোকাবিলা করছেন, কেউ জমানো সঞ্চয় বিক্রি করছেন।
এ বিষয়ে কথা হয় পোশাক ব্যবসায়ী শফিউল্লাহ সিকদারের সঙ্গে। তিনি রাজধানীর মগবাজারে স্ত্রী আর দুই মেয়েকে নিয়ে ভাড়াবাসায় থাকেন। বড় মেয়ে অনার্স প্রথম বর্ষে ও ছোট মেয়ে নবম শ্রেণিতে অধ্যয়নরত। নিজের আয় দিয়ে দুই মেয়ের পড়াশোনা ও সংসার চালানো কষ্টকর হয়ে পড়েছে। এবার ঈদে ব্যবসাও ভালো হয়নি। তাই পাঁচ লাখ টাকার পরিবার সঞ্চয়পত্র বিক্রি করে দেন তারা। মেয়াদ পূর্তির আগেই বিক্রি করেছেন।
শফিউল্লাহ সিকদার বলেন, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দামে বাড়ার কারণে সন্তানের পড়াশোনা তো দূরের কথা ঢাকা থাকতে পারবো কি না জানি না। আগামী ঈদে বেচা-বিক্রি না হলে ব্যবসা গুটিয়ে নিতে হবে। চলে যেতে হবে গ্রামের বাড়ি। এখন সঞ্চয়পত্র ভেঙে লাভ হচ্ছে না লোকসান হচ্ছে সেদিকে তাকানোর সময় নেই, আগে বাঁচতে হবে। পুরান ঢাকার আক্তারুজ্জামান বলেন, ছেলে-মেয়ে নিয়ে আমাদের সংসার, ভালোই যাচ্ছিল দিন। মেয়ের বিয়ে আসতেই এখন টাকায় টান পড়েছে। জমানো টাকায় সব খরচ মেটানো যাবে না। তাই সঞ্চয়পত্র ভাঙতে হচ্ছে।
তিনি বলেন, আমার পরিবার সঞ্চয়পত্র কেনা ছিল, এখন বিক্রি করে দিতে হবে। এর আগে ছেলের বিয়েতে দুই লাখ টাকা খরচ করে বিয়ে দিয়েছিলাম। এখন মেয়ের বিয়ের জন্য কমিউনিটি সেন্টার পাঁচ থেকে সাড়ে পাঁচ লাখ টাকা চাচ্ছে। কমিউনিটি সেন্টার থেকে বলা হচ্ছে সব কিছুর দাম বেড়ে যাওয়ায় বাড়তি দাম দিতে হবে। আমার জমানো দেড়-দুই লাখ ছিল সেটা দিয়ে হচ্ছে না তাই সঞ্চয় ভাঙার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
হাবিবুর রহমান নামে এক গ্রাহক বলেন, ব্যবসায় বিনিয়োগ ছিল, সে টাকা এখন হাতে নেই। এখন সংসার খরচ জোগাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। সংসার চালাতে সঞ্চয় বিক্রির সিদ্ধান্ত নিয়েছি। গত জুন মাসে পাঁচ লাখ টাকার পরিবার সঞ্চয়পত্র কিনেছিলেন, মেয়াদ পূর্তির আগেই বিক্রি করতে হবে। অন্যদিকে, সদ্য শেষ হওয়া ২০২২-২৩ অর্থবছরের পুরো সময়ে যে পরিমাণ সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে, ভাঙা পড়েছে তার চেয়ে ৩ হাজার ২৯৫ কোটি টাকা বেশি। অর্থাৎ পুরো অর্থবছরে এ খাত থেকে সরকার এক টাকাও ঋণ পায়নি। অথচ অর্থবছরটিতে ৩৫ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ছিল সরকারের। আর চলতি ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র বিক্রি করে ১৮ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেবে সরকার। এটি চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের চেয়ে ৪৮ দশমিক ৫৭ শতাংশ বা ১৭ হাজার কোটি টাকা কম। পুরো অর্থবছরে সঞ্চয়পত্রের মোট বিক্রি হয় ৮০ হাজার ৮৫৮ কোটি টাকা। একই সময়ে সঞ্চয়পত্র ভাঙানোর পরিমাণ ছিল ৮৪ হাজার ১৫৩ কোটি টাকা। ফলে পুরো অর্থবছরে নিট বিক্রি দাঁড়ায় ঋণাত্মক ৩ হাজার ২৯৫ কোটি টাকা।
সঞ্চয়পত্রে নানান শর্ত: মূলত সঞ্চয়পত্রে নানান শর্তজুড়ে দেওয়ায় বিক্রি তলানিতে নেমেছে। শর্তের মধ্যে রয়েছে— চলতি অর্থবছর সঞ্চয়পত্রে ৫ লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগে রিটার্নের সনদ বাধ্যতামূলক করা, ১৫ লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সব রকম সঞ্চয়পত্রের সুদহার ২ শতাংশ কমানো, সঞ্চয়পত্রের বিনিয়োগসীমা কমিয়ে আনা, মুনাফার ওপর উৎসে করের হার ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করা।
তবে, আশার দিক হচ্ছে সঞ্চয়পত্রের মুনাফাকে আয় হিসেবে গণ্যের যে নতুন নিয়মযুক্ত হয়েছিল আয়কর আইনে তা থেকে সরে এসেছে সরকার। অর্থাৎ সঞ্চয়পত্রের মুনাফার ওপর অতিরিক্ত কর কর্তন করা হবে না। আগের মতো শুধু উৎসে কর কাটা হবে। সঞ্চয়পত্রের মুনাফা থেকে বাড়তি আর কোনো কর আদায় করা হবে না। এটির মুনাফা থেকে উৎসে কর কেটে রাখা হবে, সেটিই চূড়ান্ত করদায় বিবেচিত হবে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) এ বিষয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে।
চলতি বছরের জুনে পাস হওয়া নতুন আয়কর আইনে সঞ্চয়পত্রের মুনাফাকে করদাতার আয় হিসেবে গণ্য করার কথা বলা হয়েছিল। এতে ক্ষেত্রবিশেষে করদাতাদের ওপর বাড়তি করের চাপ তৈরির আশঙ্কা ছিল। আইনে বিধানযুক্ত করার কারণে সঞ্চয়পত্রের মুনাফার ওপর নির্ভরশীল করদাতারা হতাশ হন। এ কারণে বিধানটি বাতিলের উদ্যোগ নেয় এনবিআর।
অন্যদিকে, সঞ্চয়পত্রের অধিকাংশ স্কিমে বিনিয়োগকারীদের মুনাফা দেওয়া হয় তিন মাস অন্তর। তাদের সুবিধার কথা চিন্তা করে চলতি বছরের শুরুর দিকে সব স্কিমে প্রতি মাসে মুনাফা দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়। অর্থ মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগে এ সংক্রান্ত চিঠি দেয় জাতীয় সঞ্চয়পত্র অধিদপ্তর। এরপর কেটে গেছে প্রায় আট মাস। কোনো অগ্রগতি হয়নি। ফলে সঞ্চয়পত্রের বিনিয়োগকারীরা প্রতি মাসে মুনাফা পাবেন কি না তা নিয়ে তৈরি হয়েছে ধোঁয়াশা।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, আমাদের দেশে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করা লাভজনক। তবে, বেশিরভাগ সঞ্চয়পত্র ধনীদের দখলে রয়েছে। আমি মনে করি, সঞ্চয়পত্রের মুনাফা প্রতিমাসে দেওয়া যেতে পারে। এতে সরকারের অতিরিক্ত কোনো অর্থ খরচ হবে না। বিনিয়োগকারীদের সুবিধার কথা চিন্তা করে এটি করা যেতে পারে।


প্রকাশিত: আগস্ট ২৬, ২০২৩ | সময়: ৪:৫৯ পূর্বাহ্ণ | সুমন শেখ