রাবি শিক্ষক তাহের হত্যা : মুহিউদ্দিন ও জাহাঙ্গীরের ফাঁসি কার্যকর

স্টাফ রিপোর্টার : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) ভূতত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. এস তাহের আহমেদ হত্যা মামলার দুই আসামির ফাঁসি অবশেষে কার্যকর করা হয়েছে। বৃহস্পতিবানর রাত ১০ টা এক মিনিটে রাজশাহী কেন্দ্রিয় কারাগারের একইমঞ্চে মিয়া মোহাম্মদ মহিউদ্দিন ও অপর আসামী জাহাঙ্গীর আলমের ফাসি কার্যকর করা হয়।
ফাঁসি কার্যকরের পর এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন রাজশাহী কেন্দ্রিয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার মোহ, আবদুল জলিল। কারাগারে নিযুক্ত জল্লাদ আলমগীর তাদের ফাসি কার্যকর করেন। তাকে সহযোগীতায় ছিলো আরও ৭ জল্লাদ।
রাজশাহী কারাগারের সিনিয়র জেলা সুপার বলেন, বিধি অনুযায়ী সকল পদক্ষেপ সম্পন্ন করে দুই আসামীর ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে। রাতেই নিজ নিজ পরিবারের ঠিকানায় এম্বুলেন্সে করে লাশ পাঠনো হয়েছে। ফাঁসি কার্যকরের সময় সরকারি বিধি ও জেল কোডের নিয়ম অনুসরণ করা হয়। এসময় রাজশাহী জেলা প্রশাসক শামিম আহমেদ, জেলা পুলিশ সুপার এবিএম মাসুদ হোসেন, জেলা সিভিলি সার্জন ডা, আবু নাইদ মোহাম্মদ ফারুক উপস্থিত ছিলেন।
দুই আসামীর ফাঁসি কার্যকরের মধ্য দিয়ে দীর্ঘ ১৭ বছরের আইনী লড়াইয়ের অবসান হলো। দুই আসামীর ফাঁসি কার্যকরের পর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) ভূতত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. এস তাহের আহমেদের পরিবার, তাদের পক্ষের আইনজীবী ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা সন্তোস প্রকাশ করেছেন।
রাজশাহীর ডিআইজি (প্রিজন) কামাল হোসেন বলেন, ‘প্রাণভিক্ষার আবেদন নাকচ করার ফলে দুই আসামির ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে। ফাঁসি কার্যকরের আগে জেল কোড অনুযায়ী সকল প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়। মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার আগে আত্মীয়স্বজনকে শেষ দেখা করার সুযোগ দেওয়া হয়।
গত মঙ্গলবার বেলা তিনটার দিকে কারাগারে বন্দি জাহাঙ্গীরের স্বজনরা তার সঙ্গে দেখা করেন। এ সময় তার পরিবারের ৩০ জন্য সদস্য উপস্থিত ছিলেন। তার আগে প্রধান আসামী মুহিউদ্দিনের স্ত্রীসহ পরিবারের আরও দুই সদস্য শেষ দেখা করে গেছেন।
এর আগে মঙ্গলবার সকালে ড. তাহের হত্যা মামলায় চূড়ান্ত রায়ে মৃত্যুদণ্ড পাওয়া আসামি জাহাঙ্গীরের ফাঁসি কার্যকরের প্রক্রিয়া স্থগিত চেয়ে করা আবেদন খারিজ করে দেন আপিল বিভাগ। এর পরপরই কারাগারের ভেতরে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বৈঠক হয়। কারা সূত্রে জানা গেছে, মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের সময় যে কর্মকর্তাদের উপস্থিত থাকার কথা, তাঁরা এ বৈঠকে যোগ দিয়েছিলেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, কারা কর্তৃপক্ষ ও গণপূর্ত অধিদপ্তর এক সপ্তাহ আগে ফাঁসির মঞ্চ প্রস্তুত করে। কারাগারের পুর্ব দিকের দেওয়ালের পাশে এ মঞ্চ তৈরী করা হয়েছে। এছাড়াও যে দঁড়িতে ঝুলানো হবে তাতে আসামীদের তিনগুন ওজনের বস্তু বেঁধে পরীক্ষা নিরিক্ষা করে ফাঁসির দঁড়িটিও প্রস্তুত করা হয়। সূত্রমতে, ফাঁসি কার্যকর করতে আটজনের একটি জল্লাদ টিম গঠন করে কারা কর্তৃপক্ষ। এর পর তাদের প্রশিক্ষণ ও ফাঁসি কার্যকরের একাধিক মহড়া দেওয়ানো হয়। প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত আটজনের মধ্যে টিম প্রধান হেন্ডেল টেনে ফাঁসি কার্যকর করে। এ সময় তার সঙ্গে একজন সহযোগি ছিলেন। বাকি ছয়জনের মধ্যে চারজন দুই আসামীকে ধরে ফাঁসির মঞ্চে নিয়ে যান। আর দুইজন তাদের কালো কাপড়ের জম টুপি ও গলায় দঁড়ি পরিয়ে দেন।
সূত্রমতে, এক মঞ্চে এক সঙ্গে একই সময় দুই আসামীর ফাঁসি কার্যকর হয়। মিয়া মোহাম্মদ মহিউদ্দিনের বাম পাশে জাহাঙ্গীর আলমকে দাড় করানো হয়। ১০টা ১ মিনিট থেকে ৩০ মিনিট তাদের দঁড়িতে ঝুলিয়ে রাখা হয়। এর পর মৃত্যু নিশ্চিত করে ময়নাতদন্ত শেষে লাশ পরিবারের কাছে পাঠানো হয়। জাহাঙ্গীরের লাশ পাঠানো হয় নগরীর মতিহার থানার খোঁজাপুরে। আর মহিউদ্দিনের লাশ পাঠানো হয় ফরিদপুরের ভাঙ্গায়।
কারাগার সূত্রমতে, ফাঁসি কার্যকরের একঘণ্টা আগে রাত ৯টার দিকে বিষয়টি দুই আসামীকে জানানো হয় এর পর তাদের গোসল করিয়ে শেষ ইচ্ছে অনুযায়ী খাবার দেওয়া হয়। পরে কারা মসজিদের ইমাম তাদের তওবা পড়ান। এর পর ১০টার আগেই তাদের ফাঁসির মঞ্চের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। নির্ধারিত সময়ে ফাঁসি কার্যকর করা হয়।
২০০৬ সালের ১ ফেব্রুয়ারি নিখোঁজ হন রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয়ের (রাবি) ভূতত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. এস তাহের আহমেদ। তাকে নৃশংসভাবে হত্যা করে বাড়ির পাশের ম্যানহোলে লাশ ফেলে দেওয়া হয়। পরদিন ম্যানহোল থেকে তাঁর লাশ উদ্ধার করা হয়। ৩ ফেব্রুয়ারি নগরীর মতিহার থানায় মামলা দায়ের করা হয়।
একই বিভাগের জামায়াতপন্থী শিক্ষক মিয়া মো. মহিউদ্দীন ও অধ্যাপক তাহেরের কেয়ার টেকার জাহাঙ্গীর আলম তাকে হত্যা করে বিশ^বিদ্যালয় কোয়ার্টারের ম্যানহোলে ফেলে রাখে। এই ঘটনায় তৎকালীন বিশ^বিদ্যালয় শিবিরের সভাপতি মাহবুবুল আলম সালেহীর সংশ্লিষ্টতাও উঠে আসে। তবে রহস্যজনক কারণে তিনি এ মামলা থেকে অব্যাহতি পেয়ে যান।
ড. তাহেরের আইনজীবী কন্যা সেগুফতা তাবাসসুম আহমেদের দীর্ঘ ১৭ বছর আইনি লড়াইয়ের পর মামলার প্রধান দুই আসামীর ফাঁসিসহ আরও ২ জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের সাজা হয়। সর্বশেষ বৃহস্পতিবার রাতে ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত দুই আসামীর ফাঁসি কার্যকরের মধ্য দিয়ে দীর্ঘ আইনী লড়াইয়ের অবসান ঘটলো।
২০০৬ সালের ২ ফেব্রুয়ারি পরিবার ও সহকর্মীরা ড. তাহেরের খোঁজ না পেয়ে পুলিশে জানায়। খোঁজাখুঁজির পর ৩ ফেব্রুয়ারি বিশ^বিদ্যালয় কোয়ার্টারে নিজ বাড়ির পেছনের ম্যানহোলে তাঁর লাশ খুঁজে পায় পুলিশ। এই ঘটনায় সেদিনই মামলা করেন অধ্যাপক পুত্র সানজিদ আলভি আহমেদ।
মামলায় প্রাথমিকভাবে কেয়ারটেকার জাহাঙ্গীর আলমকে আটক করে পুলিশ। তদন্ত শেষে ২০০৭ সালের ১৮ মার্চ ছয়জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ। তাতে ড. মিয়া মো. মহিউদ্দিন, বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন সভাপতি মাহবুবুল আলম সালেহী, কেয়ারটেকার জাহাঙ্গীর আলম, তার ভাই আবদুস সালাম, তাদের বাবা আজিমুদ্দীন মুন্সী ও আত্মীয় নাজমুলকে আসামি করা হয়। গ্রেফতার হওয়ার জাহাঙ্গীর, নাজমুল ও সালাম আদালতে ১৬৪ ধারায় দেওয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে বলেছিলেন, মহিউদ্দিন ও সালেহী তাদের কম্পিউটার, টাকা-পয়সা এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে তাহের আহমেদকে হত্যা করার কাজে লাগান। তবে মিয়া মহিউদ্দিন আদালতে নিজেকে নির্দোষ দাবি করেছিলেন।
৩৯ জনের সাক্ষ্য ও জেরার পর ২০০৮ সালের ২২ মে রাজশাহীর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল মহিউদ্দিন, জাহাঙ্গীর, সালাম ও নাজমুলকে মৃত্যুদণ্ড দেয়। তবে সালেহী ও আজিমুদ্দিনকে খালাস দেওয়া হয়। পরে মৃত্যুদণ্ড অনুমোদনের জন্য মামলার নথিপত্র হাই কোর্টে যায়। এসময় আসামিরা আপিল করেন। শুনানি শেষে ২০১৩ সালের ২১ এপ্রিল আপিলের রায়ে মিয়া মহিউদ্দিন ও জাহাঙ্গীরের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখা হয়। তবে সালাম ও নাজমুলের সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
হাই কোর্টের ওই রায়ের বিরুদ্ধে ফের আপিল বিভাগে আবেদন করেন আসামিরা। পাশাপাশি যাবজ্জীবন দণ্ডিত দুই আসামির দণ্ড বাড়াতে আপিল করে রাষ্ট্রপক্ষ। নয় বছর পর তা শুনানির জন্য ওঠে। দুই পক্ষের শুনানি শেষে ২০২২ সালের ৫ এপ্রিল দুই আবেদনই খারিজ করে দেয় আপিল বিভাগ। গত বছরের ১৫ সেপ্টেম্বর আপিল বিভাগের রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশ হয়। ওই রায় পুর্নবিবেচনার (রিভিউ) আবেদন করে আসামিরা। চলতি বছর ২ মার্চ মৃত্যুদণ্ডের দুই আসামিসহ তিনজনের রায় পুনর্বিবেচনার আবেদনও খারিজ হয়ে যায়।
মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তরা কারাবিধি অনুযায়ী রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার আবেদনও করেছিলেন। তবে সেই আবেদন নাকচ হয়ে গেছে। তার চিঠি ও সংশ্লিষ্ট কাগজপত্র গত ৫ জুলাই রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে এসে পৌঁছায়।
এসময় ফাঁসি কার্যকরের প্রস্তুতি নিতে থাকলে আসামি জাহাঙ্গীরের রিট খারিজের বিষয়ে আপিল করে তার ভাই সোহরাব। এই আবেদনে ফাঁসি কার্যকরের প্রক্রিয়া স্থগিত চেয়ে আবেদন করা হয়। গত ১৭ জুলাই বিচারপতি ভীষ্মদেব চক্রবর্তী ও বিচারপতি মো. আলী রেজার হাইকোর্ট বেঞ্চ রিট খারিজ করে আদেশ দেন। এরপর আর তাদের ফাঁসি কার্যকরে আর আইনত কোনো বাঁধা নেই। সোহরাবের রিট খারিজের পর মৃত্যুদণ্ড ঠেকাতে নথিপত্র নিয়ে জাহাঙ্গীরের পরিবার মার্কিন দূতাবাসে যোগাযোগ করলেও সাড়া পায়নি তারা।


প্রকাশিত: জুলাই ২৮, ২০২৩ | সময়: ৬:০৯ পূর্বাহ্ণ | সুমন শেখ

আরও খবর