রাবির ৮ খাতে ১১৩ কোটি টাকার অডিট আপত্তি

রাবি প্রতিনিধি: ২০২১-২২ অর্থবছরে এককভাবে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) ৮ টি খাতে প্রায় ১১৩ কোটি টাকার অডিট আপত্তি জানিয়েছে শিক্ষা অডিট অধিদপ্তর। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন ও ২৫টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে দেশের সর্বোচ্চ অডিট প্রতিষ্ঠান মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক (সিএজি) থেকে প্রকাশিত এক অডিট ইন্সপেকশন প্রতিবেদনে এ আপত্তি জানানো হয়েছে।
অডিটে বরাদ্দের তুলনায় অতিরিক্ত ব্যয়, ব্যাংক থেকে অর্জিত সুদ সরকারি কোষাগারে জমা না দেওয়া, ভর্তি পরীক্ষার আয়-ব্যয়ের হিসাব গোপন করা, বই ক্রয়ে অনিয়মিত ব্যয়, ভৌত অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পে বিধি বহির্ভূত ব্যয়, ঋণ পরিশোধের নামে অতিরিক্ত ব্যয়, বিধি বহির্ভূত মেডিকেল যন্ত্রাংশ ক্রয়সহ মোট ২২টি খাতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থ ব্যয়ের বিষয়ে আপত্তি জানানো হয়েছে। এদের মধ্যে ৮ টি খাতে মোট ১১২ কোটি ৯৭ লাখ টাকার ব্যয়ের বিষয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়কে এককভাবে এবং অবশিষ্ট ১৪ টি বিষয়ে অন্য প্রতিষ্ঠানের সাথে সমন্বিতভাবে আপত্তি জানানো হয়েছে।
প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে এসকল খাতে ২০২১-২২ অর্থবছরে বাজেট বরাদ্দ ছিল ১৩৩ কোটি ৩৪ লাখ ২৪ হাজার টাকা। কিন্তু ব্যয় করেছে ১৬৪ কোটি ৫১ লাখ ৫৮ হাজার টাকা। ফলে বিভিন্ন খাতে বাজেট বরাদ্দের অতিরিক্ত ৩১ কোটি ১৭ লাখ ৩৪ হাজার টাকা ব্যয় করেছে প্রশাসন। ফলে সরকারের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে।
রাবিকে এককভাবে সিএজি’র অডিট আপত্তি জানানোর বিষয়গুলোর মধ্যে রয়েছে, ২০২১-২২ অর্থবছরে বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ভৌত অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্প’র আওতায় সোনালী ব্যাংক, রাবি শাখা থেকে ২১ লাখ ৮৪ হাজার ৩৯৫ টাকা সুদ পায় রাবি প্রশাসন। অর্থ মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী উক্ত অর্জিত সুদ সরকারি কোষাগারে জমা হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ উক্ত টাকা সরকারি কোষাগারে প্রদান করেনি। ফলে ২১ লাখ ৮৪ হাজার ৩৯৫ টাকা রাজস্ব ক্ষতি হয়েছে।
২০২১-২২ অর্থবছরে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষ স্নাতক (সম্মান) ভর্তি পরীক্ষার নিরীক্ষাযোগ্য রেকর্ডপত্র ও আয়-ব্যয়ের প্রাপ্ত টাকার হিসাবও উপস্থাপন করেনি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। সিএজি নিরীক্ষা বলছে, এ অর্থবছরে প্রথম বর্ষ স্নাতক (সম্মান) ভর্তি পরীক্ষা থেকে ১৭ কোটি ৮২ লাখ ৬৮ হাজার টাকা আয় করে রাবি। কিন্তু উক্ত আয় এবং ব্যয়ের অডিট উপস্থাপন করেনি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। সিএজি কর্তৃপক্ষের অভিযোগ, এই হিসাবের আয়-ব্যয় এবং সংশ্লিষ্ট রেকর্ডপত্র অডিট উপস্থাপনের জন্য চাহিদা প্রদান করা হলেও রাবি কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে কোনো জবাব বা সহযোগিতা প্রদান করেনি।
প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, ২০২১-২২ অর্থবছরে কোনোরূপ ক্রয়মূল্য ছাড়ায় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র এককে বিভাজন করে বই ক্রয় বাবদ অনিয়মিতভাবে ২০ লাখ ৫৮ হাজার ৪৮৩ টাকা ব্যয় করে বিশ্ববিদ্যালয়। অডিট দলের মতে বছরের শেষ দিন (৩০ জুন) ব্যয় দেখানোর উদ্দেশ্যেই এই ক্রয় সম্পাদন করেন তাঁরা। যা সাধারণ আর্থিক বিধিমালা (জিএফআর) ১০৩ মোতাবেক আর্থিক নিয়ম ভঙ্গ করার সামিল।
একই অর্থবছরে বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ভৌত অবকাঠামো উন্নয়ন’ (প্রথম সংশোধিত) শীর্ষক প্রকল্পে কার্যাদেশের শর্ত মোতাবেক নির্ধারিত সময়ে কাজ সম্পাদনে ঠিকাদার ব্যর্থ হওয়ায় ‘পাবলিক প্রকিউরমেন্ট বিধিমালা-২০০৮’ (পিপিআর) মোতাবেক চুক্তি বাতিল ও ঠিকাদারের পারফরম্যান্স সিকিউরিটি বাজেয়াপ্ত না করায় ৬৮ লাখ ৮৫ হাজার টাকা ক্ষতি হয়েছে।
সিএজি কর্তৃপক্ষ আরো বলছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ভৌত অবকাঠামো উন্নয়ন’ (প্রথম সংশোধিত) শীর্ষক প্রকল্পে ২০২১-২২ অর্থবছরে কার্যাদেশের শর্ত মোতাবেক নির্ধারিত সময়ে সময় বৃদ্ধির আবেদন করতে ঠিকাদার ব্যর্থ হওয়ায় পিপিআর ২০০৮ মোতাবেক চুক্তি বাতিল না করে ঠিকাদারকে অনিয়মিতভাবে ৬ কোটি ৫১ লাখ ৬৬ হাজার ১০০ টাকা পরিশোধ করেছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
এ অর্থবছরে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাজেটে ঋণ গ্রহণ বাবদ প্রাপ্তি না দেখানো হলেও ঋণ পরিশোধের নামে বাজেটে ৫৫ কোটি ২৯ লাখ ১৪ হাজার টাকা অতিরিক্ত ব্যয় দেখানো হয়েছে। ঋণ পরিশোধের নামে অর্থ ব্যয়ের সপক্ষে কোনো বিল ভাউচার বা সন্তোষজনক ব্যাখ্যা কর্তৃপক্ষ প্রদান করতে পারেননি। সিএজি মনে করছে, প্রকৃত ব্যয় অপেক্ষা অধিক ব্যয় দেখিয়ে ঋণ পরিশোধের নামে ৫৫ কোটি ২৯ লাখ ১৪ হাজার টাকা অন্যত্র স্থানান্তর বা অননুমোদিত কোনো খাতে ব্যয় করেছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০২১-২২ অর্থবছরে আল্ট্রাসাউন্ড মেশিনসহ মেডিকেল যন্ত্রাংশ ক্রয় করার ক্ষেত্রেও পিপিআর ২০০৮ লঙ্ঘন করে ১ কোটি ৫ লাখ ৬৫ হাজার টাকা অনিয়মিতভাবে ব্যয় হয়েছে।
অডিট আপত্তির বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাব পরিচালক অধ্যাপক ড. শেখ শামসুল আরেফিন বলেন, অডিট আপত্তি একটি স্বাভাবিক বিষয়। প্রতিবছরই সিএজি কর্তৃপক্ষ আপত্তি জানায়। তারপর আমরা জবাব দিয়ে বিষয়গুলো নিষ্পত্তি করি। এটা এমন নয় যে এবারই প্রথম। এরকম প্রতি বছরেই হয়ে থাকে। শুধুমাত্র বিশ্ববিদ্যালয় না; বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানসহ মন্ত্রণালয়েও অডিট আপত্তি হয়ে থাকে। আপত্তি উঠেছে বলেই যে এখানে দুর্নীতি হয়েছে এমনটা বলা যাবে না।


প্রকাশিত: জুলাই ১৮, ২০২৩ | সময়: ৬:০৫ পূর্বাহ্ণ | সুমন শেখ