পানির দামে কেনা চামড়া লবণের দামে লোকশান!

বদলগাছী প্রতিনিধি: নওগাঁর বদলগাছীতে ছাগল-ভেড়ার চামড়া প্রকারভেদে ৩০-৫০ টাকা এবং গরু-মহিষের চামড়া প্রতি পিস ৩০০ থেকে ৭০০ টাকা দামে বিক্রি হয়েছে। তবে বাজারে লবণের দাম বেশি থাকায় এবং চামড়ার দাম কম হওয়ায় লোকসান গুনছেন মৌসুমি চামড়া ব্যবসায়ীরা।
ব্যবসায়িদের অভিযোগ, সরকারের নির্ধারিত দামে চামড়া বিক্রি হচ্ছে না। চামড়া শিল্পকে রক্ষায় সরকারের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন তারা।
জানা যায়, বদলগাছী উপজেলার চাকরাইল চামড়া আড়ৎ। যেখানে সপ্তাহে প্রতি বুধবার হাটবার। ভোরের আলো ফোটার পর থেকে দুপুর পর্যন্ত চলে এই আড়ৎ এ চামড়া বেঁচা-কেনা। জেলায় দুইটি চামড়া আড়ৎ রয়েছে একটি বদলগাছী উপজেলার চাকরাইল এবং অপরটি মান্দার উপজেলার ফেরিঘাট।
চাকরাইল আড়তে জেলার বিভিন্ন উপজেলা, পার্শবর্তী জয়পুরহাট জেলা ও বগুড়ার আদমদীঘি উপজেলা এবং ঢাকা থেকে ব্যবসায়ীরা চামড়া কেনা-বেঁচার জন্য আসেন। ঈদ পরবর্তী সময়ে উত্তরের জেলার এ চামড়া আড়তে চামড়া বেঁচা-কেনা জমে উঠতে শুরু করেছে। তবে ঢাকার ব্যবসায়ীরা না আসায় কাঙ্খিত দাম পাননি ব্যবসায়ীরা।
এ আড়তে ছাগল-ভেড়ার চামড়া প্রকারভেদে ৩০ থেকে ৫০ টাকা এবং গরু-মহিষের চামড়া প্রতিপিস ৩০০ থেকে ৭০০ টাকা দামে বিক্রি হয়েছে। জেলা চামড়া ব্যবসায়ী গ্রুপের তথ্যমতে জেলায় ছোট বড় মিলিয়ে প্রায় ২০০ জন চামড়া ব্যবসায়ী আছে। এর মধ্যে বড় ব্যবসায়ী ২৫ জন। গত ২০১৫ সাল থেকে ঢাকার ১৫টি ট্যানারি মালিকদের কাছে এই ২৫ জন ব্যবসায়ীর প্রায় ১০ কোটি টাকা বকেয়া রয়েছে।
বকেয়া টাকা পাওয়া গেলে আবারও ব্যবসায়ীরা ঘুরে দাঁড়াবে। এ বছর জেলায় গরু ও মহিষের চামড়া ৬৫ হাজার পিস এবং ছাগল ও ভেড়ার চামড়া ১ লাখ পিস কেনা হবে। যার বাজার মূল্য প্রায় ৫ কোটি ৫ লাখ টাকা।
ব্যবসায়ীরা জানান, গত কয়েক বছর ধরে চামড়া ব্যবসায় ধ্বস নেমেছে। গতবছর প্রতি বস্তা লবন ৮০০ টাকায় কিনলেও এবার ১ হাজার ৫০ টাকায় কিনতে হয়েছে। এছাড়া বেড়েছে শ্রমিকের মজুরি। কাঁচা চামড়া লবণজাত করে সরকারের বেঁধে দেওয়া দামে বিক্রি না হওয়ায় মৌসুমি ব্যবসায়ীদের লোকসান গুনতে হচ্ছে। বদলগাছী উপজেলার ভরট্ট গ্রামের মৌসুমি চামড়া ব্যবসায়ী সুদেব বলেন, এ বছর প্রতি পিচ খাসির চামড়া ৩০ থেকে ৪০ টাকা হিসেবে ১৫০ পিস কিনেছি। নিজের পারিশ্রমিক ছাড়াই প্রতিপিচে খরচ পড়েছে ২০ টাকা করে। হাটে নিয়ে বিক্রি করতে আসার পর ব্যবসায়ীরা দাম হাকছে ৩৫ থেকে ৪৫ টাকা।
পাহাড়পুর গ্রামের মৌসুমি চামড়া ব্যবসায়ী কৃষ্ণ বলেন, ১০ থেকে ২০ টাকা দামে ছাগলের চামড়া ১০০ পিচ কিনেছি। প্রতি পিচে ২-৩ টাকা লাভ হয়েছে। এ লাভ দিয়ে তো আর সংসার চলবে না।
সাপাহার উপজেলার মৌসুমি চামড়া ব্যবসায়ী জিতেন বলেন, এবছর এক বস্তা লবন ১ হাজার ৫০ টাকা টাকা দামে কিনতে হয়েছে। যা গত বছর ছিল ৮০০ টাকা। প্রায় ৬০০ পিস চামড়া দেড় লাখ টাকায় কিনেছি। দাম কম হওয়ায় প্রায় ২০ হাজার টাকার মতো লোকসান গুনতে হচ্ছে। আর এভাবে চলতে থাকলে আমরা এক সময় হারিয়ে যাবো। চামড়া শিল্পকে রক্ষায় সরকারের হস্তক্ষেপ প্রয়োজন।
জয়পুরহাট জেলা থেকে আসা চামড়া ব্যবসায়ী সুজাউল ইসলাম বলেন, সরকার যে নির্ধারিত দাম বেঁধে দিয়েছে সে দামে আমরা চামড়া বিক্রি করতে পারছিনা। এ হাটে চামড়ার দাম কম। আমাদেরও কম দামে বিক্রি করতে হবে। গত ২০০৪ সাল থেকে ট্যানারি মালিকদের কাছে ৮ লাখ টাকা পাওনা আছি। এ বছর এক টাকাও পাইনি। ধারদেনা করে কিছু টাকা সংগ্রহ করেছি। ঢাকায় বিক্রি করতে গেলে বাঁকী দিয়ে বিক্রি করতে হবে। তারা ১৫ দিনে টাকা পরিশোধের কথা বলে বছর পেরিয়ে যাবে তারপরও দিবেনা।
জেলা চামড়া ব্যবসায়ী গ্রুপের সহসভাপতি ও চাকরাইল চামড়া আড়তের আহ্বায়ক আবুল কালাম আজাদ বলেন, জেলায় দুইটি চামড়ার আড়ৎ রয়েছে। তার মধ্যে একটি চাকরাইল আড়ৎ। ঈদ পরবর্তী এ আড়তে গরুর চামড়ার সরবরাহ কম হলেও ছাগলের চামড়ার সরবরাহ হয়েছে বেশি।
ঢাকার ব্যবসায়ীরা না আসায় চামড়ার দাম তুলনামূলক কম। এ আড়তে প্রায় ১২ থেকে ১৫ লাখ টাকা বেচাকেনা হয়েছে। তবে বছরের অন্য সময়ে প্রতি হাটে প্রায় ৫০ হাজার টাকার চামড়া বেচাকেনা হয়। তবে এ বছর লবণের দামের কারণে ব্যবসায়ীদের বেহাল অবস্থা।
নওগাঁ জেলা চামড়া ব্যবসায়ী গ্রুপ সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ আলী বলেন, এ বছর জেলায় গরু ও মহিষের চামড়া ৬৫ হাজার পিচ এবং ছাগল ও ভেড়ার চামড়া ১ লাখ পিচ লবণজাত হয়েছে। বতর্মানে লবনের দাম ঊর্ধ্বমূখী। গত বছর লবন ১৫ টাকা ৯০ পয়সা কেজিতে কিনলেও এবছর ২১ টাকা কেজি। জেলায় প্রায় ৩৫০ মেট্রিক টন লবনের প্রয়োজন হয়। বড় আকারের একটি চামড়া প্রস্তুত করতে লবন ও শ্রমিক দিয়ে প্রায় ২৫০ টাকা খরচ পড়ে। এতে করে কাঁচা চামড়ার দাম কম দেখা যায়। তখন আমাদের দোষারোপ করা হয়। আসলে কাঁচা চামড়ার দাম কম না।
তিনি আরও বলেন, শ্রমিক সংকটের কারণে মজুরি বেশি। তারপরও চামড়া ফেলে না দিয়ে লবন দিয়ে রাখা হচ্ছে। অন্তত চামড়া নষ্ট না হলে লবনের দামটা উঠে আসবে। কোরবানির সময় লবনের দাম সহনশীল পর্যায়ে রাখতে সরকারের সুদৃষ্টি কামনা করছি।


প্রকাশিত: জুলাই ৯, ২০২৩ | সময়: ৫:২০ পূর্বাহ্ণ | সুমন শেখ