সর্বশেষ সংবাদ :

চাঁপাইনবাবগঞ্জে আলোচিত জেম হত্যার নেপথ্যে!

স্টাফ রিপোর্টার : গত ১৯ এপ্রিল চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহরের উদয়ন মোড়ে প্রকাশ্যে ছুরিকাঘাতে খুন হন খাইরুল আলম জেম ওরফে বোমারু জেম (৫৪)। আলোচিত হত্যাকান্ড ও বিস্ফোরকসহ ১৬ মামলার আসামী জেম খুনের ঘটনায় ৪৮ জনকে আসামী করে মামলা দায়ের করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত সে মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে ১৪ জনকে।
তবে জেম হত্যাকান্ডের কারণ এবং হত্যা মামলার আসামী নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে রহস্য। চলছে নানা আলোচনা সমালচনা। প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতে এ হত্যাকান্ড ঘটানো হয়েছে কি না তা নিয়েও রয়েছে নানা গুঞ্জন। বিশেষ করে জেম হত্যা মামলায় পৌরসভার মেয়র ও জেলা আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির অন্যতম সদস্য মখলেসুর রহমানসহ গণহারে জেলাজুড়ে জনপ্রতিনিধি, আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী, হাট-ঘাট মালিক, বালু ব্যবসায়ী, শিক্ষক-ছাত্র ও বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষ আসামি হয়েছেন। যাদের অনেকেই জেমকে চিনেনও না। এ নিয়ে স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের মধ্যে চরম ক্ষোভ দেখা দিয়েছে।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর থানার ওসি সাজ্জাদ হোসেন বলেন, নিহত জেমের ভাই মনিরুল ইসলাম বাদী হয়ে ৪৮ জনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করেন। এ মামলায় এখন পর্যন্ত ১৪ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাদের মধ্যে পাঁচজনকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। আরও কয়েকজনকে রিমান্ডে নেয়ার আবেদন জানানো হয়েছে। জেম হত্যার কারণ উদঘাটনের চেষ্টা বলছে বলে জানান ওসি।
নিহত খাইরুল আলম জেমের বাড়ি শিবগঞ্জ পৌরসভার মর্দানা গ্রামে। গত দুই বছর ধরে নিজ এলাকা ছেড়ে তিনি চাঁপাইনবাবগঞ্জ পৌরসভার ১ নং ওয়ার্ডে নয়াগোলা এলাকায় বসবাস করতেন। থাকতেন স্থানীয় সংসদ সদস্য আব্দুল ওদুদ এর ছত্রছায়ায়। আব্দুল ওদুদ এর ছত্রছায়ায় তিনি জেলা যুবলীগের শ্রম বিষয়ক সম্পাদকের পদ পান।
খাইরুল আলম জেম শিবগঞ্জ পৌরসভার ৯ নং ওয়ার্ডে একবার কাউন্সিলর ছিলেন। জেম পুলিশের তালিকাভুক্ত শীর্ষ সন্ত্রাসী ছিলেন। নিজ এলাকায় আধিপত্য বিস্তারে খুন পাল্টা খুন, বোমাবাজি, প্রতিপক্ষের ঘরবাড়ি লুট ও অগ্নিসংযোগের মতো গুরুতর অপরাধে জেমের বিরুদ্ধে ১৬টি মামলা রয়েছে। এলাকায় মোমারু জেম নামে পরিচিত খাইরুল আলম জেম সাইফুদ্দিন আহমেদ সাফু হত্যার মুলহোতা ছিলেন। ২০২০ সালের ১৪ জুন জেম ও তার ক্যাডার বাহিনী সাফুকে প্রকাশ্যে নৃশংসভাবে হত্যা করে।
পুলিশ ও এলাকাবাসী সূত্রে জানা গেছে, নিহত জেম শিবগঞ্জ পৌরসভার ৯ নং ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর। একই ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর আব্দুস সালামের সঙ্গে জেমের দুই যুগের রেষারেষি ছিল। বছর দুয়েক আগে সালাম মারা যাওয়ার পর জেম নিজ এলাকা ছেড়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহরে আশ্রয় নেন। খুন হওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি চাঁপাইনবাবগঞ্জ-৩ (সদর) আসনের সংসদ সদস্য আব্দুল ওদুদের শেল্টারে ছিলেন।
সূত্রমতে, জেম নিজ এলাকা ছেড়ে শহরে আসলেও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ত্যাগ করতে পারেননি। এমপি ওদুদের প্রতিপক্ষের সন্ত্রাসীদের সঙ্গে বিরোধে জড়ান। গত ১ ফেব্রুয়ারি চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর আসনে হওয়া উপ-নির্বাচনের আগে ও পরে শহরের বিভিন্ন স্থানে শতাধিক বোমা বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। এসব ঘটনায় জেমের সম্পৃক্ততা থাকলেও এমপির শেল্টারে থাকায় পুলিশ তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়নি।
জানা গেছে, গত ৫ ডিসেম্বর স্থানীয় পৌরসভা পার্ক মাঠে জেলা কৃষক লীগের সম্মেলনে ব্যাপক বোমাবাজির ঘটনা ঘটে। জেম ও তার প্রতিপক্ষ মেসবাহুল হক টুটুল গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষের সময় এই বোমাবাজির ঘটনা ঘটে। এসবকে কেন্দ্র করে ফেসবুকে প্রতিপক্ষের উদ্দেশ্যে পোস্ট ও পাল্টা হুমকিমূলক পোস্ট দিতেন জেম। খুন হওয়ার একদিন আগে জেম হুমকি দিয়ে ফেসবুকে একটি লাইভ করেন। এর পরের দিন প্রতিপক্ষের ছুরিকাঘাতে খুন হন জেম।
এদিকে জেম হত্যাকান্ড রাজনৈতিক আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে শহরের মধ্যে ঘটলেও এই মামলায় আসামি বাণিজ্যের অভিযোগ উঠেছে। বিশেষ করে মামলায় জেলাজুড়ে হাট, ঘাট মালিক, বালু ব্যবসায়ী, ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান, মেম্বার থেকে শুরু করে শ্রমিক নেতা, শিক্ষক-ছাত্র ও বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষ আসামি হয়েছেন। যারা গত উপ-নির্বাচনে স্থানীয় এমপি আব্দুল ওদুদের বিরুদ্ধে কাজ করেছেন।
জেম হত্যা মামলায় মুল আসামী করা হয়েছে চাঁপাইনবাবগঞ্জ পৌরসভার মেয়র ও জেলা আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য মখলেসুর রহমান এবং গত উপ-নির্বাচনে এমপি ওদুদের বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বীতাকারী জেলা যুবলীগের সাবেক সভাপতি সামিউল হক লিটনকে। এ নিয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের মাঝে ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে।
আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের অভিযোগ, জেম হত্যার ঘটনাকে কেন্দ্র করে এমপি আব্দুল ওদুদ তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ও জেলার বিভিন্ন স্থানে থাকা তার বিরোধী পক্ষের লোকেদের আসামি করেছেন। এমনকি এমপি তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ পৌরসভার মেয়র মোখলেসুর রহমানের মালিকানাধীন গ্রামীণ ট্রাভেলসের জিএম ও জেলা শ্রমিক লীগের সহ-সভাপতি আসাদুজ্জামান ছানা ও গ্রামীন ট্রাভেলসের কাউন্টার ম্যানেজার শামসুল হোদা সনি, রানীহাটি ইউপি চেয়ারম্যান রহমত আলী, চর বাগডাঙ্গা ইউপি চেয়ারম্যান শহিদ রানা টিপু, স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা কাদেরসহ এমন সব লোকেদের আসামি করা হয়েছে যারা জেমকে চিনতেনও না।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ পৌরসভা আওয়ামী লীগের সভাপতি অধ্যক্ষ আব্দুল জলিল বলেন, যে কোন হত্যাকান্ড বেদনার। কিন্তু জেম হত্যায় রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে জেলাজুড়ে বিভিন্ন শ্রেণীর পেশার মানুষকে আসামি করেছেন। দলের ভেতরে ও বাইরে যারা গত উপ-নির্বাচনে এমপি ওদুদ বিপক্ষে ছিলেন তাদের অনেকেই জেম হত্যার আসামি হয়েছেন। এ নিয়ে স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। বিষয়টি দলের কেন্দ্রকে লিখিতভাবে জানানো হবে।
জেম হত্যায় নিরাপরাধ ব্যক্তিদের জড়ানোর অভিযোগ প্রসঙ্গে চাঁপাইনবাবগঞ্জ-৩ আসনের সংসদ সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল ওদুদ সাংবাদিকদের বলেন, ‘জেম কোন সন্ত্রাসী কর্মকান্ডে যুক্ত ছিলেন না। জেমকে হত্যা করে তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষরা প্রতিশোধ নিয়েছে। কারণ জেম উপ-নির্বাচনে তার হয়ে কাজ করেছিলেন।’
তিনি আরও বলেন, ‘জেম হত্যায় তার ভাই বাদী হয়ে এই মামলা করেছেন। তিনি কোন প্রভাব খাটায়নি বা কাউকে আসামী করতে বলিনি।’
চাঁপাইনবাবগঞ্জের পুলিশ সুপার এএইচএম আবদুর রকিব বলেন, বাদী যেভাবে এজাহার দেন সেটাকেই মামলা আকারে রেকর্ড করতে হয়। তবে তদন্তের পর আমরা বলতে পারব কারা অভিযুক্ত আর কারা নির্দোষ। তদন্ত করে হত্যাকান্ডের কারণ উদঘাটন ও এর সঙ্গে জড়িতদের শনাক্ত করার চেষ্টা বলছে। খুব শ্রীঘ্রই সেটি বের করা হবে।


প্রকাশিত: এপ্রিল ২৭, ২০২৩ | সময়: ৫:০৭ পূর্বাহ্ণ | সুমন শেখ