বাংলাদেশকে হতাশায় ডুবিয়ে আইরিশদের স্বপ্নময় দিন

স্পোর্টস ডেস্ক: দিনের শুরুতে ধারাভাষ্যকক্ষে জরিপ চলছিল, খেলা কখন শেষ হতে পারে। কেউ বলছিলেন প্রথম সেশনেই, কেউ বা দ্বিতীয় সেশনে। তাদের সঙ্গে দ্বিমত করার লোকও তখন খুব বেশি ছিল না নিশ্চিতভাবেই। কজন ভাবতে পেরেছিলেন, এই টেস্ট চতুর্থ দিনের মুখ দেখবে! বাংলাদেশের নির্বিষ ও প্রাণহীন বোলিং আর আয়ারল্যান্ডের বীরোচিত প্রতিরোধ মিলিয়ে সেটিই এখন বাস্তব।
স্কিল, টেম্পারমেন্ট আর নিবেদনের দারুণ প্রদর্শনীতে দারুণভাবে ঘুরে দাঁড়াল আয়ারল্যান্ড। ম্যাচ শুধু চতুর্থ দিনে টেনে নেওয়াই শুধু নয়, তাদের জয়ও এখন অসম্ভব নয়! মিরপুর টেস্টের তৃতীয় দিন শেষে আইরিশরা এগিয়ে ১৩১ রানে। উইকেট আছে ২টি। আগের দিন শেষ বিকেলে ১৩ রানে ৪ উইকেট হারিয়ে কাঁপছিল যে দল, বৃহস্পতিবার তারাই দুর্দান্ত লড়াইয়ে সারা দিনে হারায় স্রেফ ৪ উইকেট। দিনশেষে তাদের রান ৮ উইকেটে ২৮৬।
আইরিশ প্রতিরোধের মূল নায়ক লর্কান টাকার। অভিষেকে স্মরণীয় সেঞ্চুরিতে রেকর্ড বইয়ে নাম লেখান ২৬ বছর বয়সী ব্যাটসম্যান। টেস্টে আয়ারল্যান্ডের দ্বিতীয় সেঞ্চুরিয়ান তিনি। দুটি সেঞ্চুরিই অভিষেকে। আগেরটি ছিল দেশের অভিষেক টেস্টে ডাবলিনে কেভিন ও’ব্রায়েনের। বিদেশের মাঠে অভিষেকে প্রথম সেঞ্চুরি এলো তাই টাকারের ব্যাট থেকেই।
প্রথম ইনিংসের মতো এই ইনিংসেও লড়িয়ে ফিফটি করেন হেরি টেক্টর। আইরিশদের লড়াই পর্ব শেষ নয় এখানেই। বোলিংয়ে ৬ উইকেট শিকারি অ্যান্ডি ম্যাকব্রাইন আট নম্বরে নেমে ব্যাট হাতেও অসাধারণ পারফরম্যান্সে অপরাজিত ৭১ রান করে।
এই টাকার ও টেক্টর সবশেষ প্রথম শ্রেণির ম্যাচ খেলেছেন ২ বছরের বেশি সময় আগে। ম্যাকব্রাইন সবশেষটি খেলেছেন সেই ২০১৯ সালে। আইরিশরা টেস্ট খেলছে প্রায় ৪ বছর পর। ২০১৯ সালের পর তাদের দেশে লাল বলের ক্রিকেট টুর্নামেন্ট হয়নি। তার পরও তারা অসাধারণ পারফরম্যান্সে মেলে ধরলেন নিজেদের।
প্রথম ইনিংসের ৫ উইকেটের সঙ্গে তাইজুল ইসলাম দ্বিতীয় ইনিংসে যোগ করেছেন আরও ৪ উইকেট। তবে প্রত্যাশা পুরোপুরি পূরণ করতে পারেননি তিনি। অন্যদের বোলিং তো ছিল আরও ধারহীন। দলের এমন প্রয়োজনের সময়ও বিস্ময়করভাবে বোলিংয়ে খুব একটা দেখা যায়নি সাকিব আল হাসানকে। প্রথম ইনিংসে ৬৫ ওভারের পর বোলিংয়ে এসে তিনি স্রেফ ৩ ওভার বোলিং করেছিলেন। দ্বিতীয় দিনে শেষ বিকেলে ৭ ওভার বোলিং করে দুটি উইকেট নেন তিনি। তৃতীয় দিন বোলিংয়ের শুরুটাও করেন বাংলাদেশ অধিনায়ক। কিন্তু সারা দিনে সব মিলিয়ে বোলিং করেন স্রেফ ৬ ওভার! এর মধ্যে ১ ওভারের দুটি স্পেলও ছিল।
দিনের খেলা শেষে সংবাদ সম্মেলনে পেস বোলিং কোচ অ্যালান ডোনাল্ড বলেন, সাকিবের এত কম বোলিং করার কারণ তিনি জানেন না। বাংলাদেশের জন্য দিনের শুরুটাই ছিল হতাশার। দিনের দ্বিতীয় ওভারেই তাইজুল ইসলামের বলে উইকেটের পেছনে ক্যাচ ছাড়েন লিটন দাস। হ্যারি টেক্টরের রান তখন ৯। তাইজুলের পরের ওভারেই ছক্কায় টেক্টর যেন উদযাপন করেন নতুন জীবন। সময়ের সঙ্গে বাড়তে থাকে বাংলাদেশের হতাশা।
আগের দিন শেষ বিকেলে প্রতিরোধ গড়া টেক্টর ও পিটার মুর নতুন দিনের সকালেও উইকেট আঁকড়ে রাখন দাঁতে দাঁত কামড়ে। স্পিনে হতাশ অধিনায়ক সাকিব বল তুলে দেন পেসার শরিফুল ইসলামের হাতে। তার দ্বিতীয় ওভারে খোঁচা মেরে উইকেটের পেছনে ক্যাচ দেন পিটার মুর (৭৮ বলে ১৬)।
ওই সাফল্যের রেশ ধরে রাখতে পারেনি বাংলাদেশ। টেক্টরের সঙ্গে এবার টাকার মিলে এগিয়ে নেন আয়ারল্যান্ডকে। ওই সেশনে আর কোনো উইকেট হারায়নি তারা। বাংলাদেশ নানা সময়ে বেশ কিছু কৌশল নেয়। ফাইন লেগ ও স্কয়ার লেগ সীমানায় ফিল্ডার রেখে শর্ট বল করে যান পেসাররা। স্পিনে দুটি শর্ট কাভার রাখা হয় খুব কাছাকাছি। এরকম কোনো কৌশলই কাজে দেয়নি।
টেক্টর দ্বিতীয় সেশনে ফিফটি পূরণ করেন ১৪৫ বলে। প্রথম আইরিশ ব্যাটসম্যান হিসেবে এক টেস্টে জোড়া ফিফটি করলেন তিনি। মাইলফলকের পরপর মনোযোগ হারিয়ে উইকেট হারান তিনি। অ্যাঙ্গেল বদলে ওভার দা উইকেটে এসে সফল হন তাইজুল। সুইপ করতে গিয়ে এলবিডব্লিউ হয়ে যান তিনি ১৫৯ বলে ৫৬ রান করে।
জুটিতে ৭২ রান আসে ১৪৫ বলে। দ্বিতীয় সেশনেও উইকেট পড়ে স্রেফ ওই একটিই। এবার টাকারের সঙ্গে প্রতিরোধ গড়েন ম্যাকব্রাইন। উইকেট ধরে রাখার পাশাপাশি দারুণ সব শটও খেলেন দুজন। বিশেষ করে টাকারের কবজির মোচড়ে কিছু শট ছিল দেখার মতো। তাইজুলকে ক্রিজ ছেড়ে বেরিয়ে ছক্কা মারেন ম্যাকব্রাইন।
দ্বিতীয় সেশনে আইরিশরা তোলে ১০৬ রান। বাংলাদেশ তখন অপেক্ষায় দ্বিতীয় নতুন বলের। চা-বিরতির ৬ ওভার পর কাঙ্ক্ষিত সেই নতুন বল হাতে পাওয়া যায়। কিন্তু তাতেও মেলেনি সাফল্য। তাইজুলের বলে বাউন্ডারিতে টাকার সেঞ্চুরি স্পর্শ করেন ১৪৯ বলে। ১৪টি প্রথম শ্রেণির ম্যাচ খেলে তার আগের সর্বোচ্চ ছিল ৮০। ফিফটি ছিল স্রেফ ২টি।
দীর্ঘ অপেক্ষা শেষে টাকারকে ফিরিয়েই এই জুটি ভাঙতে পারে বাংলাদেশ। ইবাদত হোসেনের বলটি যদিও ছিল অফ স্টাম্পের অনেক বাইরে। কাভারের ওপর দিয়ে খেলতে গিয়ে শর্ট কাভারে তুলে দেন টাকার। তার অসাধারণ ইনিংস থামে ১৬২ বলে ১০৮ রান করে। ৭ম উইকেটে জুটতে আসে ১১১ রান, টেস্টে আয়ারল্যান্ডের যা দ্বিতীয় সর্বোচ্চ জুটি। ৩ রানের জন্য তারা ছুঁতে পারেননি ৭ম উইকেটেই কেভিন ও’ব্রায়েন ও স্টুয়ার্ট থমসন জুটির রেকর্ড।
এরপর মার্ক অ্যাডায়ারকে নিয়েও ৩১ রানের কার্যকর জুটি গড়েন ম্যাকব্রাইন। অ্যাডায়ারকে ১৩ রানে ফেরান তাইজুল। তবে এ দিন আর আইরিশদের অলআউট করতে পারেনি বাংলাদেশ। গ্রাহাম হিউমকে নিয়ে দিন শেষ করে দেন ম্যাকব্রাইন। দিন শেষে তিনি অপরাজিত ১৪৪ বলে ৭১ রান করে। জিততে হলে এখনই রেকর্ড গড়তে হবে বাংলাদেশকে। দেশের মাঠে তারা কখনও ১০১ রানের বেশি তাড়া করে জেতেনি। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ওই ম্যাচেও ১০১ করতে উইকেট পড়েছিল ৭টি।
এবার উইকেট অবশ্য এখনও যথেষ্ট ভালো। ১৩১ রানের লিড খুব বড় কিছুও মনে হচ্ছে না। তবে আর কিছু রান যদি আইরিশরা করে ফেলতে পারে, বাংলাদেশের অপেক্ষায় তাহলে কঠিন চ্যালেঞ্জ।


প্রকাশিত: এপ্রিল ৭, ২০২৩ | সময়: ৫:১৮ পূর্বাহ্ণ | সুমন শেখ