বিক্ষোভে উত্তাল রাবি

স্টাফ রিপোর্টার : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) শিক্ষার্থীদের সঙ্গে স্থানীয়দের সংঘর্ষের দ্বিতীয় দিন রবিবারও ক্যাম্পাসের পরিস্থিতি আরো উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। পুরো ক্যাম্পাসজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে উত্তেজিত ছাত্রদের ক্ষোভের আগুন। সকাল থেকে দিনভর বিক্ষোভে স্লোগানে কার্যত অচল হয়ে পড়ে রাবি ক্যাম্পাস ও ক্যম্পাস সংলগ্ন বিনোদপুর এলাকার মহাসড়ক।
গত শনিবার স্থানীয়দের হামলা ও পুলিশের গুলিতে দুই শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হওয়ার প্রতিবাদে রবিবার সকাল থেকে ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ করে শিক্ষার্থীরা। এক পর্যায়ে তারা প্রশাসন ভবনে তালা দিয়ে অবরোধ করে। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলোচনা করতে গিয়ে উপাচার্য অধ্যাপক গোলাম সাব্বির সাত্তারসহ প্রশাসনের উর্ধ্বতন কর্তারা অন্তত দুই ঘণ্টার বেশীসময় অবরুদ্ধ হয়ে পড়েন।
এদিকে এক পাক্ষিক সংবাদ পরিবেশনের অভিযোগে দায়িত্বরত সাংবাদিককে মারধর ও ক্যামেরা ভাঙচুর করেন বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা। বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা কিছু সময়ের জন্য প্রধান ফটকের সমানে আগুন জ¦ালিয়ে ঢাকা-রাজশাহী মহাসড়ক অবরুদ্ধ রাখে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে শনিবার রাত ১০টা থেকে রবিবার সারাদিন বিনোদপুর বাজার এলাকায় সাঁজোয়া যান নিয়ে ৭ প্লাটুন বিজিবিসহ বিপুল সংখ্যক পুলিশ ও র‌্যাবের সদস্যরা সক্রিয় থাকতে দেখা যায়। এছাড়া পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী এদিন বিশ^বিদ্যালয়ে সব ধরণের ক্লাস ও পরীক্ষা বন্ধ ছিলো।
প্রত্যক্ষদর্শী ও শিক্ষার্থীরা জানান, শনিবার রাতে পুলিশের গুলি ও স্থানীয়দের হামলার প্রতিবাদে রবিবার সকাল ১০টায় বিক্ষোভ মিছিল করে ছাত্ররা। তারা কিছুক্ষণ প্রশাসন ভবনে তালা দিয়ে অবস্থান কর্মসূচী পালন করে। এতে প্রশাসন ভবনের কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা অবরুদ্ধ হয়ে পড়েন। পরে উপাচার্য বাসভবনের সামনে অবস্থান নেয়। তাদের দাবি ছিল, হামলার ঘটনায় জড়িতদের দ্রুত বিচার, পুলিশের গুলি চালানোর জবাব চাওয়া, ক্যাম্পাসে বহিরাগতদের প্রবেশাধিকার নিয়ন্ত্রণ এবং ক্যাম্পাস ও আশপাশের এলাকায় মেসে অবস্থানরত শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। বেলা সাড়ে ১১টার দিকে উপাচার্য গোলাম সাব্বির সাত্তার বিক্ষোভরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলতে চাইলে তোপের মুখে পড়েন তিনি। এক পর্যায়ে শিক্ষার্থীরা ‘ভুয়া, ভুয়া’ বলে স্লোগান দেন। বেলা ১২টার দিকে উপাচার্য শাবাশ বাংলাদেশ মাঠে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলোচনায় বসতে চাইলে বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা মানতে রাজি হননি। তাদের দাবি, যেখানে শিক্ষার্থীদের রক্ত ঝরেছে সেই বিনোদপুরে আলোচনায় বসতে হবে। তাঁরা উপাচার্যকে সঙ্গে করে মিছিল নিয়ে বিনোদপুরে যেতে চান। এ সময় দুই পক্ষের মধ্যে ধাক্কাধাক্কি ও ব্যাপক বাগ্বিতণ্ডা হয়। এ সময় মানবঢাল তৈরি করে তাঁদের রক্ষা করার চেষ্টা করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরিয়াল বডির সদস্যরা।
পরে উপাচার্যসহ প্রশাসনের উর্ধ্বতন কর্তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ সিনেট ভবনের পাশে অবস্থান নিলে শিক্ষার্থীরা সেখান তাঁদের ঘিরে রাখেন। এতে উপাচার্য গোলাম সাব্বির সাত্তার, উপউপাচার্য সুলতান-উল-ইসলাম, হুমায়ুন কবীর, প্রক্টর আসাবুল হক, বাংলা বিভাগের অধ্যাপক সফিকুন্নবী সামাদী, জনসংযোগ কর্মকর্তা ড. প্রদীপ কুমার পাণ্ডে, শেরে বাংলা হলের প্রাধ্যক্ষ ড. হাবিবুর রহমানসহ প্রশাসনের কর্তারা অবরুদ্ধ হয়ে পড়েন। সেখানে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে হ্যান্ডমাইকে বলা হয়, ‘কোনো ঘটনার বিচার আলোচনা করা ছাড়া সম্ভব নয়।’ সেখানে উত্তেজিত ছাত্ররা মহুর্মুহু স্লোগান দিতে থাকে। এক পর্যায়ে ভিড় থেকে উপাচার্যের দিকে একটি চ্যালা কাঠ ছুঁড়ে মারা হয়।
বেলা দেড়টার দিকে সেখানে উপস্থিত হয় ছাত্রলীগের নেতারা। তাদের সহায়তায় উপাচার্য বাসভবনের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করলে শিক্ষার্থীরা ফের বাধা দেন। পরে আলোচনা সাপেক্ষে শিক্ষার্থীরা তাকে ভাসভবনে ঢুকতে দেন। এসময় রাবি ছাত্রলীগের সভাপতি গোলাম কিবরিয়া, সাধারণ সম্পাদক ফয়সাল আহমেদ রুনু, রাকসু আন্দোলন মঞ্চের আহ্বায়ক আব্দুল মজিদ অন্তর, সদস্য সচিব আমানুল্লাহ খানসহ বিভিন্ন সংগঠনের নেতাকর্মীরা উপস্থিত ছিলেন। পরে উপাচার্যের বাসভবনের সামনে বিচ্ছিন্নভাবে শিক্ষার্থীদের অবস্থান করতে যায়। অনেক শিক্ষার্থী ঘটনাস্থল ত্যাগ করেছেন। এর আগে দুপুর ১টার দিকে কিছু বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থী প্রধান ফটকের সামনে ঢাকা-রাজশাহী মহাসড়ক অবরুদ্ধ করে রাখে। সেখানে তারা আগুন জ¦ালিয়ে বিক্ষোভ করে।
বিশ^বিদ্যালয়ের সহকারী প্রক্টর পুরনজিত মহালদার জানান, উপাচার্যসহ প্রশাসনের উর্ধ্বতন কর্তারা শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলোচনা করার জন্য শাবাশ বাংলাদেশ মাঠের দিকে যাচ্ছিলেন। এক পর্যায়ে বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা তাদের সিনেট ভবনের কোণায় ঘিরে ধরে। এসময় ভিড় থেকে অনেক ঠ্যালাঠেলির সৃষ্টি হয়। এসময় প্রক্টরিয়াল বডির সদস্যরাসহ শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীরা মানবঢাল তৈরী করে উপাচার্যসহ জ্যেষ্ঠ শিক্ষকদের রক্ষা করার চেষ্টা করেন বলে জানান এই সহযোগী অধ্যাপক।
এদিকে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভের সংবাদ সংগ্রহ করতে এসে তোপের মুখে পড়েন সাংবাদিকরা। উপাচার্য বাসভবনের সামনে বিক্ষোভের ছবি নেয়ার সময় চ্যানেল-২৪’র ক্যামেরাপারসন জুয়েলকে ধাওয়া করে সিনেট ভবনে নেয়া হয়। পরে তাকে ও চ্যানেল-২৪’র সাংবাদিক আবরার শাঈর মারধর করা হয়। এসময় কয়েকটি ক্যামেরা ভাঙচুর করা হয়। এ ঘটনার ছবি তুলতে গেলে বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত সাংবাদিক রিপন চন্দ্র রায়সহ আরও কয়েকজন সাংবাদিককে লাঞ্ছিত হন। শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, চ্যানেল-২৪ শিক্ষার্থীদের পক্ষ বিবেচনা না করেই একপাক্ষিকভাবে স্থানীয়দের পক্ষেই সংবাদ প্রকাশ করে আসছে।
এই ঘটনার নিন্দা জানিয়েছেন রাজশাহী সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি রফিকুল ইসলাম। তিনি বলেন, আবরার শাঈর ও জুয়েলকে মারধর করা হয়েছে। জুয়েলকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে। কালের কণ্ঠের ফটোসাংবাদিক সালাউদ্দিনের ক্যামেরাও ভাঙচুর করা হয়েছে। তাঁরা এখনই কোনো কর্মসূচি দিচ্ছেন না। সাংবাদিকদের নিরাপদ দূরত্বে থেকে পেশাগত কাজ করার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।
এর আগে গত শনিবার বিকেলে বাসের সিট নিয়ে বাগবিতণ্ডার জের ধরে বিশ^বিদ্যালয়ের বিনোদপুর গেট সংলগ্ন বাজারে ব্যবসায়ী ও স্থানীয়দের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পরে শিক্ষার্থীরা। এসময় রাবি ছাত্রলীগ সভাপতি গোলাম কিবরিয়া পরিস্থিতি শান্ত করতে গেলে তার ওপর চড়াও হয়ে স্থানীয়রা তিনটি মোটরসাইকেলে পুড়িয়ে দেয়। পরে আশপাশের হল থেকে শিক্ষার্থীরা বিনোদপুর এলাকায় জড়ো হলে দুই পক্ষে সংঘর্ষ বাঁধে। এক পর্যায়ে স্থানীয়রা বিনোদপুর পুলিশ ফাঁড়িতে অগ্নি সংযোগ করে। শিক্ষার্থীরাও কয়েকটি দোকান ভাঙচুর ও অগ্নি সংযোগ করে। দুই পক্ষের সংঘর্ষে অন্তত দেড় শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হয়। আহতদের অ্যাম্বুলেন্স ও বিশ^বিদ্যালয়ের বাসে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়।
এসময় পরিস্থিতি শান্ত করতে বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলোচনার চেষ্টা করেন উপাচার্য গোলাম সাব্বির সাত্তার। তিনি ঘোষণা দেন, রবি ও সোমবার বিশ^বিদ্যালয়ের সব ধরণের ক্লাস ও পরীক্ষা বন্ধ থাকবে। কিন্তু শিক্ষার্থীরা শান্ত না হওয়ায় তিনি ফিরে যান এবং হাসপাতালে আহতদের দেখতে যান।
পরে রাত ১০টার দিকে শিক্ষার্থীরা বিনোদপুর বাজারে অবস্থান নিলে স্থানীয়রা ইট ও পেট্রোল বোমা ছুঁড়তে থাকে। এতে আবারও সংঘর্ষ শুরু হয়। শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, স্থানীয়রা ককটেলও বিষ্ফোরণ করে। এসময় বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা কয়েকটি দোকানে অগ্নিসংযোগ করে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশ কাঁদানে গ্যাস ও রাবার বুলেট ছুঁড়লে অন্তত ৭০ শিক্ষার্থী গুরুতর আহত হয়। আহতদের বিশ^বিদ্যালয়ের বাস ও অ্যাম্বুলেন্সে রামেক হাসপাতালে নেয়া হয়। এই ঘটনার প্রতিবাদে রাত পৌঁনে ১২টার দিকে রাজশাহী রেললাইন অবরোধ করে শিক্ষার্থীরা। পরে রাত ১টার দিকে পরিস্থিতি শান্ত হয়।
বিশ^বিদ্যালয় মেডিকেল সেন্টারের কর্মরতরা জানিয়েছেন, সংঘর্ষ শুরু হওয়ার পর থেকে অন্তত দেড় শতাধিক শিক্ষার্থীকে তারা প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়েছেন। গুরুতর আহতদের রামেক হাসপাতালে পাঠানো হয়। রামেক হাসপাতালে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, শনিবার মধ্যরাত পর্যন্ত ৮৬ শিক্ষার্থী ও ১ জন স্থানীয় আহত অবস্থায় চিকিৎসা নেয়। আহতদের মধ্যে কয়েকজন শিক্ষার্থী গুরুতরভাবে আহত হয়। পুলিশের রাবার বুলেট ও ইটের আঘাতে কয়েকজন শিক্ষার্থীর চোখও গুরুতরভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হয়। এদের মধ্যে একজনকে আইসিইউতে ভর্তি করা হয় বলেও খবর পাওয়া যায়। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, দুইটি ওয়ার্ডে আহতদের চিকিৎসা দিয়েছেন তারা।
এদিকে ক্যাম্পাস সংলগ্ন আবাসিক মেসগুলোতে অবস্থানরত শিক্ষার্থীরা জানিয়েছেন, সংঘর্ষের পর থেকে তারা রাতভর আতঙ্কে কাটিয়েছেন। গভীর রাত পর্যন্ত স্থানীয়রা তাদের দরজা ও জানালায় ইট ছুঁড়ে মারে এবং অকথ্যভাষায় গালিগালাজ করে। ভয়ে তারা দরজা-জানলা বন্ধ করে রাতভর জেগে ছিলেন। এছাড়া বিনোদপুর এলাকায় ব্যাপক টিয়ারশেল নিক্ষেপের ফলে আশপাশের মেস, বাড়ি ও হলে অবস্থানরত শিক্ষার্থীদের অবস্থা দুর্বিষহ হয়ে ওঠে। বিকেলে এ খবর লেখার সময়ও রাবি ক্যাম্পাস এলাকায় টানটান উত্তেজনা বিরাজ করছিলো। বিনোদপুর এলাকায় বিজিবির পাশাপাশি বিপুল সংখ্যক পুলিশ মোতায়েন রয়েছে। ক্যাম্পাসে উত্তেজনা থাকলেও বিনোদপুর এলাকায় থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে।
রাজশাহী মহানগর পুলিশের মুখপাত্র ও সহকারী কমিশনার রফিকুল ইসলাম জানান, রাবি ক্যাম্পাস ও বিনোদপুর এলাকায় পরিস্তিতি নিয়ন্ত্রনে রয়েছে। পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত কোনো মামলা দায়ের হয়নি কোনো পক্ষ থেকেই। তিনি বলেন, কোনো পক্ষ মামলা দিলে পুলিশ আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করেেব।


প্রকাশিত: মার্চ ১৩, ২০২৩ | সময়: ৪:৫৯ পূর্বাহ্ণ | সুমন শেখ