সর্বশেষ সংবাদ :

কৃষকদের জিম্মি করে চলছে হাতিয়া বিল দখলের মহড়া

স্টাফ রিপোর্টার, বাগমারা: রাজশাহীর বাগমারা উপজেলার নরদাশ ইউনিয়নের হাতিয়া বিলের চারপাশের ছয় গ্রামের সহস্রাধিক কৃষককে জিম্মী করে কোটি কোটি টাকার মাছ মেরে নিচ্ছে স্থানীয় প্রভাবশালীরা। তারা মাছ লুট করতে বিল এলাকায় দেশীয় অস্ত্র সহ ক্যাডার বাহিনী দিয়ে মোটর সাইকেলের মহড়া দিয়ে বেড়াচ্ছে বলেও অভিযোগ উঠেছে।
প্রভাবশালীদের এমন উদ্ধত্যপূর্ণ আচরণে ফুঁসে ওঠেছে গ্রামের কৃষক সমাজ। তাদেরও অনেকে মাছ ধরার কাজে বাঁধা দিয়ে গিয়ে মামলা হামলার শিকার হয়েছেন। এনিয়ে উভয়পক্ষের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
জানা গেছে, গত ১ ফেব্রুয়ারি সকালে প্রভাবশালীদের ৬০-৭০ জন উচ্ছৃংখল ক্যাডার ধারাল অস্ত্র নিয়ে বিল এলাকার নিরীহ কৃষকদের ওপর অতর্কিত হামলা চালায়। হামলায় নারী পুরুষ সহ বেশ কয়েকজন কৃষক আহত হন। তাদের বাগমারা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও রাজশাহী মেডিকেলে ভর্তি করা হয়।
কৃষকরা জানান, নরদাশ গ্রামের জোনাব আলী (৪৪), কর্মচারী বেলাল হোসেন (৩৮), আবেদ আলী (২৬), বাবুল হোসেন (৪০) ও জোনাব আলী প্রাং (৩৫) সরাসরি হামলায় নেতৃত্ব দেন ও ক্যাডারদের দেশীয় অস্ত্র সরবরাহ করেন।
কৃষকরা অভিযোগ করে বলেন, ভূমিদুস্যরা ছয় গ্রামের কয়েক হাজার কৃষককে জিম্মী করে জমির লীজ মূল্য পরিশোধ না করে অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে দিনে দুপুরে কোটি টাকার মাছ মেরে নিয়ে যাচ্ছে। আবার তারাই ঘটনা ভিন্নখাতে নিয়ে যাওয়ার জন্য নিরীহ কৃষকদের হামলাকারী সাজিয়ে তাদের নামে মামলা দিয়ে অপপ্রচার চালাচ্ছে।
এরই ধারাবাহিকতায় গত শনিবার সকালে উপজেলার নরদাশ ইউনিয়নের সুজনপালশা আমপাড়া এলাকায় কতিপয় ক্যাডার জড়ো হয়ে কৃষকদের বিরুদ্ধে একটি পাতানো মানববন্ধন করে ইউপি চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ গোলাম সারোয়ার আবুলের কুশপুত্তলিকা দাহ করেছে।
কৃষকদের দাবী, ইউপি চেয়ারম্যান জনপ্রিয় ব্যক্তি। তিনি জনপ্রতিনিধি হওয়ায় বিলের প্রকৃত ভূমি মালিক ও সাধারণ কৃষকদের পক্ষে কথা বলায় এবং তাদের ন্যায্য হিস্যা আদায়ের চেষ্টা করায় প্রভাবশালীরা চেয়ারম্যানকে নিয়ে নানা অপপ্রচার চালাচ্ছে। কথিত ওই মানববন্ধনে চেয়ারম্যানের কুশপুত্তলিকাও দাহ করেছে ভূমদস্যুরা। এতে বিল এলাকার সাধারণ কৃষকদের মাঝ চরম ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে।
রবিবার সরেজমিন নরদাশের হাটমাধনাগর, বাঁইগাছা, সুজনপালশাও চন্ডিপুর এলাকার অর্ধশতাধিক কৃষকদের কাছে বিলের প্রকৃত অবস্থার কথা জানতে চাওয়া হয়। এ সময় ভুক্তভোগি কৃষকরা জানান, বিগত চৌদ্দ বছর ধরে স্থানীয় কতিপয় প্রভাবশালী ভূমিদুস্যু ‘হাতিয়ার বিল মাছ চাষ প্রকল্প’ নামে একটি ভূয়া প্রকল্প দাঁড় করিয়ে জোরপূর্বক মাছচাষ করে আসছে।
কৃষকরা দাবী করে বলেন, সরকারি কোন দপ্তরে হাতিয়ার বিল মাছ চাষ প্রকল্পের কোন নাম গন্ধ নেই। অথচ তারা কৃষকদের কানা ও বোকা বানিয়ে হাইকোর্ট দেখিয়ে কোটি টাকার মাছ লুট করে নিয়ে যাচ্ছে। এতে বিলের চারপাশের ছয় গ্রামের প্রায় দশ হাজার জমির মালিকরা বঞ্চিত হচ্ছেন।
এসবের প্রতিকার চেয়ে প্রায় সহস্রাধিক ক্ষতিগ্রস্থ কৃষক স্থানীয় উপজেলা প্রশাসন, জেলা প্রশাসক ও জেলা পুলিশ সুপারের নিকট আবেদন করেন। প্রভাবশালীদের হাত থেকে হাতিয়ার বিল রক্ষার জন্য অচিরেই প্রশাসনের আশু হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন ভুক্তভোগী হাজার হাজার গ্রামবাসী।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, হাতিয়ার বিলের জমির মালিকরা ন্যায্য পাওনা চাইতে গেলে প্রভাবশালীদের পেটুয়া বাহিনীর হাতে হামলার শিকার হয়ে অনেকে পঙ্গু হয়ে পড়েছেন। বিষয়টি নিয়ে একাধিকবার স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান ব্যবস্থা নিতে চাইলে প্রভাবশালীরা তা তোয়াক্কা না করে বিল দখল নিতে সন্ত্রাসী কায়দায় হাসুয়া, লাঠি, চাকু, দা নিয়ে এলাকার জোরদারদের ভয়ভীতি প্রদর্শনের জন্য বিলের চারি দিকে ২০-২৫টি মোটর সাইকেল নিয়ে শোডাউন দিয়ে আতঙ্ক সৃষ্টি করছে। এতে ওই এলাকায় স্বাভাবিক জীবনযাত্র চরম হুমকির মুখে পড়েছে।
উপজেলার নরদাশ ইউনিয়নের হাতিয়ার বিলের চারপাশে হাট মাধনগর, বাঁইগাছা, সুজনপালশা, চন্ডিপুরসহ পাঁচটি গ্রাম। হাতিয়ার বিল মৎস্য চাষ প্রকল্প নাম দিয়ে প্রভাবশালীরা জমি মালিকদের ঠকিয়ে একযুগ ধরে সেখানে মাছ চাষ করে আসছে।
প্রকল্পের সভাপতি তমেজ উদ্দিন এবং সাধারণ সম্পাদক আব্দুল মতিন বিল দখলের জন্য একটি লাঠিয়াল বাহিনী গঠন করেছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। বিলে জমি মালিকরা মাছ চাষ করতে না পারলেও যাদের জমি নাই এমন অনেক প্রভাবশালীও রয়েছে দখল কমিটিতে।
সুজনপালশা গ্রামের মৃত মেজতুল্ল্যার ছেলে তমেজ উদ্দিন, মৃত শরিয়তুল্যার ছেলে আব্দুল মতিন, নরদাশ গ্রামের রফাতুল্ল্যার ছেলে সেকেন্দার আলী, রহিম বক্সের ছেলে রফিক উদ্দিনসহ কতিপয় প্রভাবশালী ওই বিলে জোর পূর্বক মাছচাষ করে আসছে। বিভিন্ন সময়ে কৃষকরা বাধা দিলেও ওই এলাকার প্রভাবশালী ও তাদের পেটুয়াবাহিনী নরদাশ গ্রামের জোনাব আলী, আব্দুল মান্নান, জাফর আলী ও সুজনপালশা গ্রামের আফজাল হোসেন সহ কিছু লাঠিয়ালবাহিনী সন্ত্রাসী কায়দায় হাসুয়া, লাঠি, চাকু, দা নিয়ে এলাকার জোরদারদের ভয়ভীতি প্রদর্শন অব্যাহত রেখেছে। এরআগে সন্ত্রাসী বাহিনীর আক্রমণের শিকার হয়েছেন নরদাশ গ্রামের মোবারক হোসেন, রফিকসহ অনেকেই। তাদের বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে তারা হুমকি-ধামকি দিয়ে থাকে। প্রাণভয়ে তারা বিভিন্ন সময়ে পালিয়ে পালিয়ে থাকছে বলেও জানায় ভূক্তভোগীরা।
সাবেক ইউপি সদস্য চন্ডিপুর গ্রামের সেকেন্দার আলী, সাবেক ইউপি সদস্য নরদাশ গ্রামের মুনছুর রহমানসহ কৃষক মজিবর রহমান, মোবারক হোসেন, হাটমাধনগরের দেলোয়ার হোসেন, আলামিন, সুজনপালসা গ্রামের আব্দুর রহিমসহ অন্তত চার শতাধিক কৃষক দখলকারীদের হাত থেকে বিলটি উদ্ধারের দাবী জানিয়েছেন। নতুন ভাবে কৃষকরাই বিলে মাছ চাষ করতে আগ্রহী বলে জানিয়েছেন।
অপরদিকে ইউপি চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ গোলাম সরওয়ার আবুলের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, আমার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগগুলো ভিত্তিহীন। বিল দখল নিয়ে লিখিত অভিযোগ পাওয়ার পর আমি নিস্পত্তির জন্য তিনটি নোটিশ দিয়েছি। একটি পক্ষ না আসায় আমি বিষয় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য অভিযোগটি জমা দিয়েছি। বিষয়টি নিয়ে এলাকায় অশান্তি বিরাজ করছে। বিল দখল করে জোরদারদের জমিতে মাছচাষ করছে।
এ বিষয়ে প্রতিকার করতে গেলেই জমির মালিকরা হামলা-মামলার শিকার হচ্ছেন। এমনকি জনপ্রতিনিধি হিসেবে ভূমিকা নিতে তারা আমার বিরুদ্ধে অপপ্রচার মামলা ও সাজানো গুটি কয়েকজন মিলে মানব বন্ধন করছে। এ সবই তাদের সাজানো নাটক। তাদের সাথে আমার কোন বিরোধ নেই। ওই বিলে আমারও জমি আছে। অন্যান্য জোতদারের যেমনটি কোন সুযোগ দেয় না। তেমনি আমাকেও বঞ্চিত করেছে। এদের তথ্য নিলে সব জানা যাবে তাদের পাতানো ঘটনার বিষয়।
এ ব্যাপারে বাগমারা থানার ওসি আমিনুল ইসলাম জানান, বিল নিয়ে দু’পক্ষের মধ্যে মারামারির ঘটনা ঘটেছে। ঘটনার পর থেকেই এলাকায় পুলিশী টহল জোরদার করা হয়েছে। ওই ঘটনায় এক পক্ষ থানায় লিখিত অভিযোগ দাখিল করেছেন। তদন্ত করে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে তিনি জানিয়েছেন।


প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ৬, ২০২৩ | সময়: ৬:১২ পূর্বাহ্ণ | সুমন শেখ