সর্বশেষ সংবাদ :

নিপাহ ভাইরাস ‘মারাত্মক সংক্রামক’, ৭১ শতাংশেরই মৃত্যু

সানশাইন ডেস্ক: শীতের মৌসুম শুরু থেকেই আবহমান গ্রাম-বাংলার ঐতিহ্য খেজুরের রস আহরণে ব্যস্ত সময় পার করেন গাছিরা। একইসঙ্গে মানুষের মধ্যেও খেজুরের রস খাওয়ার ধুম পড়ে যায়। তবে, খেজুরের রসে যে শুধুমাত্র মানুষই মাতাল হয়, তা কিন্তু নয়। শীতে খেজুরের রস বাদুড়েরও অন্যতম একটি প্রিয় খাবার। আর বাদুড়ে মুখ দেওয়া খেজুরের রস পানে মানুষের মধ্যে দেখা দেয় নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি।
সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) তথ্য অনুযায়ী, দেশে গত ২২ বছরে নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তিদের ৭১ শতাংশেরই মৃত্যু হয়েছে। ২০০১ থেকে ২০২৩ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত সময়ে দেশে ৩২৫ জনের দেহে নিপাহ ভাইরাস শনাক্ত হয়েছে। তাদের মধ্যে ২৩২ জন মারা গেছেন।
আইইডিসিআর বলছে, দেশে ২০০১ সালে মেহেরপুরে প্রথম নিপাহ ভাইরাস শনাক্ত হয়। এরপর ২০০৩ সালে হয় নওগাঁয়। তবে এযাবৎকালের সবচেয়ে বড় আকারের প্রাদুর্ভাব হয় ফরিদপুর জেলায়, ২০০৪ সালে। সে বছর ফরিদপুরে নিপাহ ভাইরাসে ৩৫ জন আক্রান্ত হয়, তার মধ্যে ২৭ জনের মারা যায়। এ ঘটনার পরপরই আইইডিসিআর এবং আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণাকেন্দ্র, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআরবি) সম্মিলিতভাবে এ ঘটনার তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহে নামে। তখন এতে অর্থসংস্থান করে যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (সিডিসি)। আইইডিসিআরের হিসাবে, বাংলাদেশে গত ২২ বছরে ৩২টি জেলায় নিপাহ ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব হয়েছে ৪১টি।
আইইডিসিআর পরিচালক অধ্যাপক ডা. তাহমিনা শিরিন বলেন, ‘নিপাহ ভাইরাসে এই বছরে এখন পর্যন্ত আমরা একজনের মৃত্যুর হিস্ট্রি পেয়েছি। আক্রান্ত ওই ব্যক্তির বাড়ি রাজশাহী এলাকায়। এখন পর্যন্ত একজনই আক্রান্ত হয়েছে, একজনই মারা গেছেন।’
তাহমিনা শিরিন বলেন, ‘নিপাহ ভাইরাস আক্রান্তের অন্যতম কারণ খেজুরের কাঁচা রস। এছাড়াও আক্রান্ত রোগীর সংস্পর্শে এলে হয়। এছাড়াও পাখি বা বাদুড়ের অর্ধ খাওয়া যেকোনও ফলমূল খেলেও হয়। তাই কাঁচা খেজুর রসের পাশাপাশি যেকোনও পাখির অর্ধ বা আংশিক খাওয়া ফলমূল থেকেও বিরত থাকতে হবে। অনেক সময় গাছের নিচে বিভিন্ন পাকা ফলমূল পড়ে থাকে, বিশেষ করে গ্রাম এলাকায় এটি বেশি পরিমাণে দেখা যায়। এই বিষয়গুলোতে আমাদের সচেতন হতে হবে।’
এ ভাইরাসের ভয়াবহতা প্রসঙ্গে আইইডিসিআর পরিচালক বলেন, ‘নিপাহ ভাইরাস সংক্রমণটি খুবই মারাত্মক। বলা হয়ে থাকে, নিপাহ ভাইরাসে ৭০ শতাংশেরও বেশি মৃত্যু হয়। কিন্তু আমরা এখন পর্যন্ত যাদেরই আক্রান্ত হতে দেখেছি, প্রত্যেকেই মৃত্যুবরণ করেছেন। প্রতিবছর দেশে নিপাতে অনেক আক্রান্ত হয়, এমনটি নয়। কিন্তু যারাই আক্রান্ত হয়, তারাই মারা যায়। তবে, মৃত্যুর কাছ থেকে যারা ফিরে আসেন, তাদের জন্য এক ভয়াবহ সময় অপেক্ষা করে। বেঁচে থেকেও তারা স্মৃতি হারিয়ে ফেলতে পারেন এবং পঙ্গু হয়ে যেতে পারেন চিরতরে।’
অধ্যাপক ডা. তাহমিনা শিরিন বলেন, ‘এই রোগের কোনও টিকা নেই। এটার কোনও স্পেসিফিক চিকিৎসাও নেই। রয়েছে শুধু সাপোর্টিভ ট্রিটমেন্ট। যতদিন সে বেঁচে থাকবে, ততদিনেই তার চিকিৎসা চলবে’। সচেতনতা প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, আইইডিসিআর এটি নিয়ে কাজ করছে, কিন্তু আমাদের একার পক্ষে তো মানুষকে সচেতন করা সম্ভব না। এক্ষেত্রে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পাশাপাশি প্রচার-প্রচারণায় গণমাধ্যমকেও আরও ভূমিকা রাখতে হবে। শুধু তাই নয়, সচেতনতার জায়গা থেকে সবাইকেই ভূমিকা পালন করতে হবে। কেউ কাঁচা খেজুরের রস খেতে চাইলে তাকে বাঁধা দিতে হবে। পরিবারের সদস্যদের সচেতন করতে হবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকেও ভূমিকা পালন করতে হবে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) ভাইরোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. রাশেদুল ইসলাম বলেন, ‘নিপাহ ভাইরাস মূলত প্রতি শীতেই একটু বেশি বেড়ে থাকে। কারণ হলো শীতকালে মানুষ কাঁচা খেজুরের রসটা বেশি খায়। এই রস রাতের বেলায় বাদুড় খায় এমনকি তারা এই রসে বিভিন্ন মলমূত্রও ত্যাগ করে। এই রসটাই যখন সকালে মানুষের পেটে যায়, সেখান থেকেই মানুষ নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়।’
তিনি বলেন, ‘খেজুরের রস ছাড়াও শাক-সবজি, ফলমূলেও বাদুড় মলমূত্র ত্যাগ করে এবং আংশিক খেয়ে থাকে। এসব জিনিস যখন মানুষ ভালো করে পরিষ্কার না করেই কাঁচা খায়, সেটাও নিপাহ ভাইরাসের অন্যতম একটা উৎস।’
নিপাহ থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার উপায় প্রসঙ্গে এই চিকিৎসক বলেন, ‘খেজুরের আমরা কাঁচা খাবো না, বাসায় নিয়ে ভালো করে ফুটিয়ে এরপর খাবো। শীতের সময় যেহেতু এই ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবটা বেড়ে যায়, সেক্ষেত্রে শাক-সবজি, ফলমূল এগুলো ভালো করে না ধুয়ে খাওয়া যাবে না। বিশেষ করে পশু-পাখির আংশিক খাওয়া কিছুও আমরা খাবো না। এই কয়েকটা বিষয় আমাদের অবশ্যই গুরুত্ব দিয়ে মেনটেইন করতে হবে, যাতে আমরা নিপাহ ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব থেকে সবাই বাঁচতে পারি।’
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও), আইসিডিডিআরবিসহ বিভিন্ন সংস্থার তথ্য বলছে, নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত হলে প্রাথমিকভাবে মাথাব্যথা, খিঁচুনি, গা ব্যথা, ঘাড় ও পিঠ শক্ত হয়ে যাওয়া, বমিবমি ভাব এবং গলাব্যথা হতে পারে। এরপর আক্রান্ত ব্যক্তি প্রলাপ বকা শুরু করতে পারে। এধরনের রোগী আলো সহ্য করতে পারে না। কখনো কখনো অজ্ঞান হয়ে যেতে পারে। পরিস্থিতির অবনতি হলে হঠাৎ হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হওয়া অথবা পক্ষাঘাতগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
লক্ষণ-উপসর্গ প্রসঙ্গে ডা. রাশেদুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের কাছে রোগীরা সাধারণ অজ্ঞান হয়েই আসে। কারণ সর্দি-কাশি, শ্বাসকষ্ট শীতকালে স্বাভাবিক একটা বিষয়। যখনই কোনও ব্যক্তি এসব উপসর্গের সঙ্গে অজ্ঞান হয়ে যাবে এবং ওই ব্যক্তির খেজুরের রস বা পশু-পাখির অর্ধ খাওয়া কিছু পান-আহার ও সংগ্রহের ইতিহাস থাকবে, তখন ধরে নিতে সে নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে। এমনকি সঙ্গে সঙ্গেই যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি মেনে ওই ব্যক্তিকে নিকটস্থ স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে যেতে হবে।’
করণীয় জানতে চাইলে তিনি আরও বলেন, ‘যখনই দেখা যাবে কারও পরিবারে একজন অজ্ঞান হয়ে গেছে, শ্বাসকষ্ট হচ্ছে, জ্বর এসেছে, একইসঙ্গে তার খেজুরের রস খাওয়ার ইতিহাস আছে, তখনই তার পরিবারের যতো সদস্য আছে সবাইকে স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে যোগাযোগ করতে হবে। একইসঙ্গে আক্রান্ত ব্যক্তি থেকে সবাইকে নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান করতে হবে, পরিবারের সবাইকে মাস্ক পরা ও ব্যক্তিগত হাইজিন বজায় রাখতে হবে। কোভিডের সময়েও কিন্তু আমরা আক্রান্ত ব্যক্তি থেকে সুরক্ষিত থেকেছি। ওই সময়ে যেমন আমরা মাস্ক পরেছি, সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখেছি, ঠিক তেমনটাই করতে হবে নিপাহ ভাইরাস থেকে বাঁচতেও।’
গত ১১ জানুয়ারি নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে বছরের প্রথম এক নারীর মৃত্যু হয়েছে বলে জানায় আইইডিসিআর। ভাইরাসে মৃত নারীর বাড়ি রাজশাহী এলাকায়। খেজুরের রস খেয়ে তিনি বাদুড় বাহিত এ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছিলেন। এর আগে গত বছরও (২০২২) নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্তের তিনটি কেস পাওয়া গেছে। তাদের মধ্যে দুজন মারা গেছেন। এদের একজন ছিলেন নওগাঁর, অন্যজন ফরিদপুরের।
আইইডিসিআর আরও জানায়, নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত ৭১ শতাংশ মানুষ মারা যায়। তাই কাঁচা খেজুরের রস খাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। কারণ, বাদুড় যখন খেজুরের রস খায়, তখন তার দ্বারা সেটি ‘ইনফেকটেড’ হয়ে যায়। মানুষ সেই রস কাঁচা খেলে আক্রান্ত হয়ে পড়ে। তারপর আক্রান্ত ব্যক্তির মাধ্যমে তার পরিবারের সদস্য ও পরিচিতরা আক্রান্ত হয়। তাদের মাধ্যমে স্বাস্থ্যকর্মীরাও আক্রান্ত হতে পারেন।
লক্ষণ প্রসঙ্গে সংস্থাটি আরও জানায়, দূষিত খেজুরের রস খাওয়ার পর নিপাহ আক্রান্তের লক্ষণ দেখা দিতে ৮-৯ দিন লাগতে পারে। অন্যদিকে, ইতোমধ্যে আক্রান্ত রোগীর সংস্পর্শে এসে আক্রান্ত হওয়ার ক্ষেত্রে লক্ষণ দেখা দেয় ৬-১১ দিন পর।
নিপাহ ভাইরাস সংক্রমণ রোধে গত ২০১১ সালে প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে একটি জাতীয় নির্দেশিকা জারি করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। নির্দেশিকায় খেজুরের কাঁচা রসকে নিপাহ ভাইরাসের প্রধান বাহন হিসেবে চিহ্নিত করে সংক্রমণ রোধ করতে খেজুরের কাঁচা রস খাওয়ার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (রোগনিয়ন্ত্রণ) অধ্যাপক মো. নাজমুল ইসলাম বলেন, ‘দেশে নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্তের হার কম হলেও ভাইরাসটি খুবই বিপদজনক। এই রোগে মৃতের হার খুবই বেশি। তাই প্রতিকারের চেয়ে আমাদের প্রতিরোধে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। মূলত নিপাহ ভাইরাস থেকে বাঁচার উপায় হলো কাঁচা খেজুরের রস খাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘আমরা প্রচার-প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছি। এই প্রচারটাই আরও জোরদার হওয়া উচিত। এক্ষেত্রে গণমাধ্যমগুলোকে মুখ্য ভূমিকা পালন করতে হবে। ধর্মীয় নেতারা জুমার খুতবায় যদি সাধারণ মানুষকে কাঁচা রসের বিষয়ে সতর্ক করে, এটার সামাজিক গুরুত্ব কিন্তু অনেক বেশি। আমরা আমাদের সীমিত বাজেট অনুযায়ী প্রচারণা করছি। আমরা যশোর-খুলনা অঞ্চলে অ্যাডভোকেসি কমিউনিকেশন ও সোশাল মোভিলাইজেশনের জন্য সরকার থেকে আমরা আমাদের লোকজন পাঠাচ্ছি।’
নাজমুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের তো জনবল কম, এরমধ্যেই আমাদের কর্মকর্তারা বিভিন্ন জেলায় গিয়ে স্টেক হোল্ডারদের সঙ্গে মিটিং-অ্যাডভোকেসি করছে। কিন্তু এর পাশাপাশি যদি গণমাধ্যমগুলোতে ব্যাপক প্রচারটা হতো, টেলিভিশনে, টকশোতে আলোচনা হতো, তাহলে ভালো হতো। কারণ, আমাদের যে বিজ্ঞাপনের কলেবর, আমরা তো প্রতিদিন বিজ্ঞাপন আর প্রতিটি মিডিয়াকে কাভার করতে পারি না। এক্ষেত্রে সংবাদকর্মীরা চাইলে বিভিন্ন সংবাদের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের কাছে আমাদের বার্তাগুলো পৌঁছে দিতে পারেন।’
ভাইরাসের চিকিৎসা প্রসঙ্গে রোগনিয়ন্ত্রণ পরিচালক আরও বলেন, ‘এখন পর্যন্ত বিশ্বের কোথাও নিপাহ ভাইরাসের টিকার কোনও খবর নেই। প্রিভেনশন হলো খেজুরের কাঁচা রস, বাদুড়ে খাওয়া কলাসহ বিভিন্ন ফলমূল থেকে বিরত থাকতে হবে।’


প্রকাশিত: জানুয়ারি ১৭, ২০২৩ | সময়: ৫:৪৯ পূর্বাহ্ণ | সুমন শেখ