শৈত্য প্রবাহের কবলে ৮ জেলা রাজশাহীতে জেঁকে বসেছে শীত

স্টাফ রিপোর্টার : গত দিনদিনের চেয়ে রাজশাহীতে শীতের তীব্রতা আরও বেড়েছে। গত এক সপ্তাহ ধরে প্রচণ্ড শীত পড়ছে এ অঞ্চলে। তবে গত তিনদিন ধরে শীতে অসহনীয় হয়ে উঠেছে জীবনযাত্রা। এতে সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগের শিকার হচ্ছেন নিম্নআয়ের ছিন্নমুল মানুষ।
এরই মধ্যে রাজশাহীজুড়ে শীতার্ত মানুষের জন্য শীতবস্ত্র নিয়ে এগিয়ে আসছেন অনেকেই। তবে চাহিদার তুলনায় তা অপ্রতুল। শীত থেকে বাঁচতে খড়কুটা জ্বালিয়ে শীত নিবারণের চেষ্টা করছেন নিম্নআয়ের মানুষ।
রাজশাহী আবহাওয়া অফিসের তথ্যমতে, বৃৃহস্পতিবার সর্বনিম্ন এ অঞ্চলে তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এর আগে বুধবার ভোর ৬টায় সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় ১০ দশমিক ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এরআগে গত ২৯ ডিসেম্বর রাজশাহীর সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছিল ৯ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। অন্যদিনের মতো বৃহস্পতিবারের বেলা ২ টা পর্যন্ত ঘন কুয়াশায় মুড়ে ছিলো রাজশাহী।
রাজশাহী পবা উপজেলার হরিয়ান ইউনিয়নের বাসিন্দা হোসরাব হোসেন। শীতের কারণে কাজে যেতে পারছেন না। গরম কাপড়ও নেই। বাধ্য হয়ে কিছু খড়কুটা জ্বালিয়ে শীত নিবারণের চেষ্টা করছিলেন।
তিনি বলেন, ‘গত সাত দিন ধরে সূর্যের দেখা মিলছে দুপুরে। তাই কাজে যাওয়া যাচ্ছে না। শীতে কাজও করতে পারছি না। আমাদের তেমন গরম কাপড়ও নেই। তাই কিছু ডালপালা জ্বালিয়ে আগুন তেপে শীত নিবারণের চেষ্টা করছি।’
রাজশাহী আবহাওয়া অফিসের সিনিয়র পর্যবেক্ষক লতিফা হেলেন বলেন, মূলত ঘন কুয়াশা এবং ঠান্ডা বাতাসের কারণেই রাজশাহীতে তীব্র শীতে অনুভূত হচ্ছে। কিন্তু রাজশাহীর ওপর দিয়ে কোনো শৈত্যপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে না। কুয়াশা কেটে গেলেই শৈত্যপ্রবাহ শুরু হবে। তখন সর্বনিম্ন তাপমাত্রা আবারও এক অংকে নেমে আসার আশঙ্কা রয়েছে।
এদিকে দেশের প্রায় সব এলকায় দিনের বেলাতেও চলছে কুয়াশার দাপট; ভরদুপুরেও মিলছে না রোদের দেখা। থার্মোমিটারের পারদ ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নেমে গিয়ে দেশের আট অঞ্চলে শুরু হয়েছে মৃদু শৈত্যপ্রবাহ।
দিন ও রাতের তাপমাত্রার ব্যবধান কমে যাওয়ায় গত কয়েকদিন ধরে সারাদেশেই অনুভূত হচ্ছে তীব্র শীত। কুয়াশার সঙ্গে উত্তরের হিম বাতাসে নাকাল হতে হচ্ছে খেটে খাওয়া মানুষকে। হাসপাতালে বেড়েছে ঠাণ্ডার রোগীর ভিড়। আবহাওয়াবিদ আব্দুল হামিদ মিয়া জানান, রাজশাহী, পাবনা, দিনাজপুর, পঞ্চগড়, নীলফামারী, যশোর, চুয়াডাঙ্গা ও কুষ্টিয়া অঞ্চলের ওপর দিয়ে বৃহস্পতিবার মৃদু শৈত্যপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে, যা অব্যাহত থাকবে।
এ দিন যশোরে দেশের সর্বনিম্ন ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে। রাজধানীতে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল ১২.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। সারা দেশে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ৯ থেকে ১৬ ডিগ্রির মধ্যেই ছিল। ঢাকায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ১৭ডিগ্রি সেলসিয়াস। আর টেকনাফের ২৮.২ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছিল দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা।
বড় এলাকাজুড়ে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে নেমে গেলে তাকে তীব্র শৈত্যপ্রবাহ হিসেবে ধরা হয়। তাপমাত্রা ৬ থেকে ৮ ডিগ্রির মধ্যে থাকলে মাঝারি এবং তাপমাত্রা ৮ থেকে ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে থাকলে তাকে মৃদু শৈত্যপ্রবাহ বলে।
আবহাওয়াবিদ হামিদ বলেন, “সারাদেশে রাতের তাপমাত্রা প্রায় অপরিবর্তিত থাকতে পারে। দিনের তাপমাত্রা সামান্য বাড়তে পারে। দিন ও রাতের তাপমাত্রার পার্থক্য কমে যাওয়ায় দেশের উত্তর, উত্তর পশ্চিমাঞ্চল ও মধ্যাঞ্চলে মাঝারি থেকে তীব্র শীতের অনুভূতি হচ্ছে এবং তা অব্যাহত থাকতে পারে।”
পৌষের মাঝামাঝি এসে টানা কয়েকদিন ধরে তাপমাত্রা কমায় শীত ও কুয়াশার দাপট বেড়েছে। দিনের অল্প যেটুকু সময় কুয়াশা ভেঙে সূর্যের দেখা পাওয়া যায়, তার বাইরে সারাদিনই গরম কাপড় গায়ে চাপিয়ে থাকতে হচ্ছে। সকাল সকাল কাঁপতে কাঁপতে স্কুলমুখী হচ্ছে স্কুল শিক্ষার্থীরা। নগরীর শ্রমজীবী আর পেশাজীবীরাও গায়ে মোটা কাপড় জড়িয়ে ছুটছেন গন্তব্যে।
তবে এই আবহাওয়ার মধ্যেও নির্মাণ শ্রমিক ওমর ফারুককে দেখা গেল পাতলা গেঞ্জি আর লুঙ্গি পরে কাজ করছেন। মোহাম্মদপুরের তিনরাস্তার মোড় এলাকায় এক ঠিকাদারের সঙ্গে ছাদ ঢালাইয়ের কাজ করছেন তিনি। দিনভরই পানির মধ্যে কাজ করতে হয় জানিয়ে ফারুক বললেন, “কাম করলে শইলে গরম আহে, শীতে কামুড় মারতে পারে না। এহন থামলেই লাগবো জন্মের শীত।”
ফুলগেঞ্জির ওপর হাফশার্ট চাপিয়ে ভোরে রিকশা নিয়ে বের হয়েছেন রিকশাচালক মহসিন। তিনি বলছেন, বের হওয়ার পরপর ঠাণ্ডা লাগে। কিছুক্ষণ রিকশা চালানোর পর আর ঠাণ্ডা লাগে না, তখন আবার ঘামতে শুরু করেন। নিউমোনিয়া আক্রান্ত ছয় মাসের সন্তানকে নিয়ে ঢাকার শিশু হাসপাতালে এসেছিলেন জাফর আহমেদ ও সুমি আক্তার দম্পতি। শিশু রোগীর সঙ্গে মাকে থাকার অনুমতি দেয় হাসপাতালের কর্তৃপক্ষ। বাধ্য হয়ে শীতের মধ্যে শিশু হাসপাতালের বাইরে বাগানে মশারি টাঙিয়ে ঘুমাতে হয়েছে জাফরকে।
শিশু হাসপাতালের ভেতরের করিডোরগুলোতে রোগীদের সঙ্গে আসা দর্শনার্থীদের থাকতে দেওয়া হয় না। হাসপাতালের প্রবেশমুখের গাড়িবারান্দায় সকালে জড়োসড়ো হয়ে পাটি বিছিয়ে শুয়ে ছিলেন জনা দশেক মানুষ। করিডোরেও সার বেঁধে কম্বল পেঁচিয়ে শুয়ে থাকতে দেখা যায় কয়েকজন। আর যারা এখানেও জায়গা পাননি, রাতে তাদের পাটি বিছাতে হয়েছে শিশু হাসপাতালের খোলা বাগানে, আউটডোরের সামনের বারান্দায়।
হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, “শীতের প্রকোপ বেড়ে যাওয়ায় রোগীর সংখ্যাও বাড়ছে। আর অনেক বাবা-মাই অসুস্থতার চুড়ান্ত পর্যায়ে শিশুদের নিয়ে হাসপাতালমুখী হচ্ছেন। এ বিষয়ে বাবা-মায়েদের আরও সচেতন হতে হবে। অবহেলা না করে এসময়ে শিশুর ঠাণ্ডা-কাশি হলে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে আসতে হবে।”
বৃহস্পতিবার সকাল ৯টা থেকে পরবর্তী ২৪ ঘণ্টার আবহাওয়ার পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, আকাশ আংশিক মেঘলা এবং সারাদেশের আবহাওয়া শুষ্ক থাকতে পারে। মধ্যরাত থেকে সকাল পর্যন্ত সারাদেশে মাঝারি থেকে ঘন কুয়াশা থাকতে পারে এবং দেশের কোথাও কোথাও তা দুপুর পর্যন্ত চলতে পারে কুয়াশার দাপট।
জানুয়ারি মাসের দীর্ঘমেয়াদী পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, চলতি মাসে ২-৩টি শৈত্যপ্রবাহ বয়ে যেতে পারে। এর মধ্যে একটি মাঝারি ধরনের শৈত্যপ্রবাহ হতে পারে।


প্রকাশিত: জানুয়ারি ৬, ২০২৩ | সময়: ৪:৫৬ পূর্বাহ্ণ | সুমন শেখ