ওয়াজে গিয়ে হেনস্তা আবু ত্বহা , এবার মুখ খুললেন নিজেই

সানশাইন ডেস্ক:

গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে ওয়াজ মাহফিল করতে এসে নিজে এবং তিন সহকারী অবরুদ্ধের ঘটনায় মুখ খুলেছেন আলোচিত ইসলামী বক্তা আবু ত্বহা মুহাম্মদ আদনান। রোববার (২৫ ডিসেম্বর) ইউটিউবে প্রচারিত এক ভিডিওতে এ নিয়ে তাকে কথা বলতে শোনা যায়। এসময় তিনি ওই ওয়াজ মাহফিলের আয়োজক কমিটি থেকে শুরু করে নানা বিষয়ে বিস্তর অভিযোগ করেন। ওয়াজ মাহফিলের ওই ভিডিওতে প্রশ্নোত্তর পর্বে এক ব্যক্তি লিখিত প্রশ্ন করেন- গত ১৭ ডিসেম্বর গোবিন্দগঞ্জে ওয়াজ মাহফিলে আপনার সঙ্গে কী আচরণ করেছিল, এ বিষয় সত্যতা ও ঘটনাটা আপনার মুখ থেকে জানতে চাই?

 

 

 

তুমুল আলোচিত ইসলামী বক্তা আবু ত্বহা বলেন, ওয়াজ মাহফিল করতে এসে অনেক তিক্ত অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হতে হয়েছে, যা আপনারা কখনো কল্পনাও করতে পারবেন না। এমন অনেক মাহফিলে গিয়েছি যেগুলোতে উচ্চ সমাদর, ভালো ব্যবহার, রুটিন সিস্টেম, আমাদের যাতায়াত থেকে শুরু করে সিকিউরিটি এত সুন্দর করেছে যা বলার মতো নয়। এমন বহু মাহফিল আমি করেছি। গত বছর দেড়শ থেকে দুইশ মাহফিল করেছি। এ বছর অলরেডি মোটামুটি ৬০ থেকে ৭০টা করা হয়েছে। আমি বাসা থেকে বের হয়েছি নভেম্বরে, মাহফিলের সিজন শেষ হবে মার্চে। আপনারা জানেন না ভেতরে কত গল্প থাকে।

 

 

তিনি বলেন, ওয়াজ মাহফিলে গিয়ে এমনও হয়েছে স্বেচ্ছাসেবক দিয়ে সিকিউরিটির কথা বলে আমাদের খালি হাতে ফিরিয়ে দেয়া হয়েছে। এমন বহু মাহফিল হয়েছে। এমনও হয়েছে মাহফিল শেষ করে গাড়িতে বসেছি। কিন্তু কমিটির খবর নেই। তাদের মোবাইল ফোন বন্ধ। এমন মাহফিল হয়েছে, তাদের মনের মতো ওয়াজ করতে না পারায় খালি হাতে রাত ২টার সময় মাঝরাস্তায় নামিয়ে দিয়ে চলে গেছে। এমনও হয়েছে মাহফিলের পোস্টারে যে আমার নাম আছে, সেটা আমি নিজেই জানি না। অথচ আমার নামে দেড় দুই মাস আগে থেকেই টাকা কালেকশন করা হয়েছে। এরকমও হয়েছে একজন আমার নামে মাহফিল নিয়েছে, কমিটির কাছে কিছু টাকা অগ্রিম নিয়েছে, প্রচার করেছে আমিই টাকা নিয়ে নিয়েছি। কত কি যে হয়েছে এ জীবনে সেসব বলে বোঝাতে পারব না।

 

 

আলোচিত ইসলামী বক্তা বলেন, আমরা এখন মাহফিল নিই সরাসরি অফিশিয়ালি। আজ যারা মাহফিল নিয়েছেন, তারা কিন্তু আমার অফিসে সরাসরি গিয়েছেন, দেখা করে আমাদের একটা ফরম আছে; সেটা পূরণ করেছেন। আমাদের কিছু শর্ত আছে, সেগুলো মেনে তারপর মাহফিল নিয়েছেন। আমাদের তিনটা নম্বর আছে, সেগুলো ছাড়া আমরা কোনো মাহফিল নিই না। ফরম ফিলাপ হলে আমরা যাচাই-বাছাই করে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করি। আমরা আপনার মাহফিল নিয়েছি, মাহফিলের সব কার্যক্রম সম্পন্ন করেন। নিরাপত্তা ব্যবস্থা, থানার অনুমতি, আমাদের যাতায়াতের বিষয়গুলো দেখেন, এরপর আমরা এগুলো নিশ্চিত করি। এত সহজে মাহফিল নিই না।

 

 

আবু ত্বহা বলেন, গোবিন্দগঞ্জে আমাদের নামে মাহফিল নেয়া হয়েছে, আমরা সেটা জানিই না। ১৭ ডিসেম্বর আমার মাহফিল রাতের বেলা বগুড়ায়। তারপর শুনলাম কিছু দ্বীনি ভাইয়ের মাধ্যমে গোবিন্দগঞ্জ এলাকায় আপনার নামে একটা মাহফিলের আয়োজন করা হয়েছে। আপনার নামে প্রচুর টাকা পয়সা তোলা হয়েছে। আমি বললাম কে মাহফিল নিয়েছে, কার মাধ্যমে? তখন আমাদের এক পরিচিত ভাইকে দেখিয়ে দিলেন। ওই ভাইয়ের মাধ্যমে মাহফিল নেয়া হয়েছে। অথচ সেই ভাইয়ের সঙ্গে আমাদের মাহফিল নিয়ে কোনো কথা হয়নি। আল্লাহ সাক্ষী আছে।

 

 

তিনি বলেন, আরেক ভাইয়ের মাধ্যমে মাঝখানে থার্ড পার্টির মাধ্যমে ওই কমিটির সঙ্গে যোগাযোগ করে মাহফিলের দিনক্ষণ ঠিক করেছেন উনি। আমি তো জানি না। মাহফিলের দুই দিন আগে তারা এসে হাতে-পায়ে ধরে কান্নাকাটি শুরু করেছেন। ভাই মাহফিলের আয়োজন তো করা হয়েছে, আল্লাহর ওয়াস্তে মাহফিলে আপনি ৩০টা মিনিট সময় দিয়েন। মাহফিলের আয়োজন করেছি, টাকা পয়সা তোলা হয়েছে, আপনি যদি না আসেন, বলছে ১০টা মিনিটের জন্য আসেন। এসে চেহারাটা দেখিয়ে চলে যাবেন। তা নাহলে জনগণ আমাদের পিটিয়ে শেষ করে ফেলবে। তারপর আমরা বলেছি বগুড়ায় আমাদের মাহফিল আছে, সেখানে যাওয়ার সময় আপনাদের ওখানে একটু সময় দিয়ে চলে যাবো আমরা। এই প্রসেসে আমরা কখনো মাহফিল নেই না। পরে সেখানে গিয়েছি।

 

 

আলোচিত এ ইসলামী বক্তা বলেন, শুনেছি তারা প্রচার করেছে, আমরা মাহফিল করব দুপুর তিনটা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত। তারপর আমাদের কানে খবর আসছে বাদ মাগরিব আপনাকে আলোচনা করতে হবে। আমরা সেখানে গিয়ে উপস্থিত হয়েছিলাম বিকেল ৪টার সময়। আমি চিন্তা করেছি যাব, একটু রেস্ট নেব, রেস্ট নিয়ে নামাজ-কালাম সারবো। তারপর বাদ মাগরিব স্টেজে উঠবো। গিয়ে শুনি মাইকে ঘোষণা করা হয়েছে বিকেল ৩টা থেকে মাহফিল আমার নামে ঘোষণা করা হয়েছে। জনগণ বসে আছে। জনগণ তো নিষ্পাপ। তাদের তো কোনো দোষ নেই। তারা তো সত্যটা জানেই না। তবু তাড়াহুড়ো করে স্টেজে উঠালো। আমি সেখানে ৪৫ থেকে ৫০ মিনিট বক্তব্য দিয়েছি। তিনি বলেন, আমি আলোচনা শেষে বলেছি আপনারা বসেন। মাগরিবের নামাজের পর ওয়াজ হবে। এখানে আমরা মাগরিবের নামাজ পড়ব। নামাজের পর আলোচনা হবে, প্রশ্নোত্তর পর্ব হবে। সেখানে আমার ইউটিউবের সদস্যদের ক্যামেরা সেট করতে দেয়নি। সেই ঘটনার পুরোটাই আগে থেকে পরিকল্পিত ছিল। সেদিন কেনো তারা ক্যামেরা বসাতে দিলো না। ক্যামেরা থাকলে মানুষ দেখতে পারতো সেখানে কি হয়েছে?

 

 

আবু ত্বহা আরও বলেন, সেখানে একটি ছেলে ক্যাডার বাহিনী নিয়ে আমাদের সঙ্গে যাচ্ছেতাই ব্যবহার করেছে। তার কথা বার্তা এমন যে আপনাদের টাকা দিয়ে নিয়ে আসি, ভাড়া দিয়ে নিয়ে আসি, যতক্ষণ বলবো ততক্ষণ আলোচনা করতে হবে। দুই ঘণ্টা আলোচনা করতে হবে। এসময় কথা শোনার পর কোনো আলেম বসে থাকতে পারে? তখন আমি বললাম, কত টাকা দিয়েছেন আপনি? তখন তিনি বলেন আপনার ওই ব্যক্তির মাধ্যমে ২০ হাজার দিয়েছি। কিন্তু ওই ব্যক্তিকে আমি চিনিই না, জানি না। তারপর তাকে বললাম নিয়ে আসুন তাকে, যত টাকা নিয়েছেন ফেরত দেন। তিনি বলেন, আমার অপমান হওয়ার কোনো প্রয়োজন নাই। হাদিয়ার টাকাসহ নিয়ে জান, আমার মাহফিল করার দরকার নেই। জনগণ দেখলও যে একটা হট্টগোল শুরু হয়েছে। মাহফিলের দর্শকশ্রোতা সবাই আমাদের পক্ষে ছিলেন। মাহফিলের দর্শকশ্রোতা আমাদের নিরাপত্তা দিয়ে গাড়িতে তুলে দেন। আর আমাদের সঙ্গে যে ছিলেন, মুজাহিদ ও আরও দুই ভাইকে তারা বেদম পিটিয়েছেন।

 

 

মাহফিলের ৫০ হাজার টাকা সম্পর্কে আবু ত্বহা বলেন, ৫০ হাজার টাকা মুখের কথা নাকি? উল্টো আমাদের ৩৬ হাজার টাকা তারা ছিনতাই করেছেন। হাতঘড়ি ছিনিয়ে নিয়েছেন। ক্যামেরা ভাঙচুর করেছেন। পিটিয়ে অপমান করেছেন। ওই ঘটনার পর থানায় মামলা দায়েরের কথাও ওই ভিডিওতে উল্লেখ করেন তিনি। কিন্তু কোন থানায় মামলা দায়ের করেছেন সেটি উল্লেখ করেননি। ওয়াজ মাহফিলের ওই ভিডিও সম্পর্কে আবু ত্বহার সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি চ্যানেল২৪ অনলাইনের পক্ষে।

 

 

এর আগে গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে ওয়াজ মাহফিল করতে এসে আলোচিত ইসলামী বক্তা আবু ত্বহা এবং তার তিন সহকারীকে অবরুদ্ধের ঘটনা ঘটে। সোমবার (১৯ ডিসেম্বর) সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সেই ঘটনার একটি ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে। তাতে দেখা যায়, ত্বহা ও তার তিন সহকারী মাওলানা শায়েক আবদুল আলিম, মাওলানা মোজাহিদ এবং মাওলানা ফিরোজকে ঘিরে রেখেছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। ত্বহার ব্যবহৃত মাইক্রোবাসসহ তাদের প্রায় আধা ঘণ্টা অবরুদ্ধ করেন বিক্ষুব্ধ জনতা। পরে মাওলানা মোজাহিদকে রাস্তায় টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যাওয়া হয়। তখন তাকে মারধরও করা হয়।

 

 

গোবিন্দগঞ্জের ওয়াজের আয়োজকরা জানান, গত ৮ নভেম্বর ত্বহা ও তার সহকারী আবদুল আলিমের সঙ্গে মৌখিক চুক্তি হয় ওয়াজ করতে হবে দুই ঘণ্টা। শনিবার বিকেল ৩টা থেকে ৫টা পর্যন্ত ত্বহার ওয়াজ করার কথা ছিল। কিন্তু তিনি পৌনে ৫টায় বক্তব্য শুরু করে সোয়া ৫টায় শেষ করে চলে যাচ্ছিলেন। সেসময় কথা কাটাকাটির একপর্যায়ে ক্ষিপ্ত হন স্থানীয় ব্যক্তিরা। অবরুদ্ধ করে রাখেন ওই ধর্মীয় বক্তাকে। স্থানীয় মুসল্লি, মসজিদ কমিটি ও এলাকাবাসী জানান, ঘটনাটি ঘটে শনিবার (১৭ ডিসেম্বর)। গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার কোচাশহর ইউনিয়নের মোকন্দপুর জামে মসজিদের উদ্যোগে ওয়াজ মাহফিলের আয়োজন করা হয়।

 

 

সেখানে ৫০ হাজার টাকা চুক্তিতে প্রধান বক্তা করা হয় ত্বহাকে। গত ৮ নভেম্বর প্রথম দফায় ২০ হাজার টাকা নেন ত্বহার ব্যক্তিগত সহকারী মাওলানা শায়েক আবদুল আলিম। বাকি টাকা ওয়াজ শেষে দেয়ার কথা ছিল। শনিবার সকালে মসজিদ কমিটিকে আবদুল আলিম জানান, পুরো টাকা ছাড়া তারা ওয়াজে উপস্থিত থাকবেন না। পরে বাধ্য হয়ে আরও ২০ হাজার টাকা মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে পাঠায় আয়োজক কমিটি। ওয়াজে আসার পর দেয়া হয় আরও ১০ হাজার টাকা।

 

 

শনিবার বিকেল ৩টা থেকে ৫টা পর্যন্ত ত্বহার ওয়াজ করার কথা ছিল। কিন্তু তিনি পৌনে ৫টায় বক্তব্য শুরু করে সোয়া ৫টায় শেষ করে চলে যাচ্ছিলেন। তখন কথামতো আরও দেড় ঘণ্টা বক্তব্য দিতে বলা হয় তাকে। কিন্তু বগুড়ার সোনাতলায় আরেকটি মাহফিল থাকার কথা বলে তিনি চলে যেতে চান। এসময় তার তিন সহকারীর কথায় ক্ষিপ্ত হন স্থানীয় বাসিন্দারা। মাওলানা মোজাহিদ এক মুসল্লিকে বলেন, ৫০ হাজার টাকায় আর কতক্ষণ বক্তব্য দিতে হবে? এটা বলার পর লোকজন তাকে মঞ্চ থেকে নামিয়ে নিয়ে টানাহেঁচড়া শুরু করেন।

 

 

আয়োজক কমিটি ও মসজিদ কমিটির সদস্য বোরহান উদ্দিন লেলিন বলেন, ত্বহার সঙ্গে চুক্তি ছিল দুই ঘণ্টায় ৫০ হাজার। কিন্তু তিনি ওয়াজ করলেন ৩০ মিনিট। একটা টাকাও তো কম নেননি। এটা নিয়ে জনগণ ক্ষিপ্ত হয়  ।কোচাশহর ইউনিয়নের (ইউপি) চেয়ারম্যান জহুরুল হক বলেন, ত্বহা তো কথা দিয়ে কথা রাখেননি। তাই লোকজন ক্ষিপ্ত হয়েছিলেন। আমি লোক পাঠিয়ে তাদের উদ্ধার করি। ত্বহার সঙ্গী মাওলানা মোজাহিদকে হেনস্তার কথা শিকার করলেও মারধর করার বিষয়টি অস্বীকার করেছেন তিনি। ক্রিকেটার থেকে ইসলামি বক্তা ত্বহাকে নিয়ে তুমুল আলোচনা হয় গত বছরের মাঝামাঝি সময়ে। এরপর থেকেই নানা কারণে সংবাদের শিরোনাম হচ্ছেন তিনি।

 

সানশাইন/তারেক


প্রকাশিত: ডিসেম্বর ২৫, ২০২২ | সময়: ৬:৫১ অপরাহ্ণ | Daily Sunshine