টাকা-উপহারে ‘বিক্রি হচ্ছেন’ চিকিৎসক, বাড়ছে ব্যয়!

সানশাইন ডেস্ক: চিকিৎসার ব্যয় মেটাতে গিয়ে প্রতি বছর বাংলাদেশে নতুন করে দরিদ্র হচ্ছেন প্রায় ৮৬ লাখ মানুষ। এর মধ্যে দফায় দফায় ওষুধের দাম বাড়তি যেন ‘মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা’ হয়ে এসেছে। কেন ওষুধের দাম এভাবে বাড়ছে? সংশ্লিষ্টরা বলছেন ওষুধ উৎপাদন করতে খরচ আগের চেয়ে বেড়েছে। তবে এটিকে কারণ হিসেবে দাঁড় করানো হলেও পেছনের গল্প কিন্তু ভিন্ন।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর লাগামহীন প্রমোশন কস্ট (প্রচার খরচ), বিশেষ করে নিজ নিজ ব্র্যান্ডের ওষুধ লেখাতে চিকিৎসকদের পেছনে লাখ লাখ টাকা ব্যয় ওষুধের দাম বৃদ্ধির পেছনে কাজ করছে। এদিকে তাদের দ্বারা প্রলুব্ধ হয়ে নিয়মিত মাসোহারার লোভে অনেক চিকিৎসক ব্যবস্থাপত্রে লিখছেন ‘মানহীন’ ও ‘অপ্রয়োজনীয়’ ওষুধ! ফলে সাধারণ মানুষ দুই দিক থেকেই প্রতারিত হচ্ছেন- বেশি দামে ওষুধ কিনছেন, কিন্তু পাচ্ছেন নিম্ন মানের চিকিৎসা ও ওষুধ।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর আগ্রাসী বিপণন নীতি এবং অনেক চিকিৎসকের অসুস্থ মানসিকতা স্বাস্থ্যসেবার পরিবেশ নষ্ট করছে। বেআইনি ও অনৈতিক কর্মকাণ্ডে একদিকে যেমন চিকিৎসকদের ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে, অন্যদিকে বাড়াচ্ছে সাধারণ মানুষের চিকিৎসার ব্যয়। এ অবস্থায় চিকিৎসকদের আয়ের খাত এবং ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যয়ের খাত কঠোরভাবে মনিটরিংয়ের পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। পাশাপাশি ওষুধের জেনেরিক (শ্রেণিগত) নাম দিয়ে ব্যবস্থাপত্র (প্রেসক্রিপশন) চালুর পরামর্শও দেন তারা।
জানা গেছে, ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর ৫৮ ভাগ কর্মীই ওষুধের বাজারজাতকরণ (মার্কেটিং) ও বিতরণে কাজ করেন। প্রতিষ্ঠানগুলোর মোট আয়ের ২৭ ভাগেরও বেশি ব্যয় হয় বিপুল সংখ্যক এ কর্মীর পেছনে। ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর আগ্রাসী বিপণন নীতি এবং অনেক চিকিৎসকের অসুস্থ মানসিকতা স্বাস্থ্যসেবার পরিবেশ নষ্ট করছে। বেআইনি ও অনৈতিক কর্মকাণ্ডে একদিকে যেমন চিকিৎসকদের ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে, অন্যদিকে বাড়াচ্ছে সাধারণ মানুষের চিকিৎসার ব্যয়। এ অবস্থায় চিকিৎসকদের আয়ের খাত এবং ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যয়ের খাত কঠোরভাবে মনিটরিংয়ের পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটের এক গবেষণায় দেখা গেছে, অতিরিক্ত এ ব্যয়ের কারণে দেশে চিকিৎসাসেবা বঞ্চিত থাকছেন অন্তত ১৬ শতাংশ রোগী। তারা বলছেন, দেশের হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসা নেওয়া ৯৭ শতাংশ রোগীই ওষুধ পান না। প্রয়োজনীয় ওষুধ তাদের কিনতে হয় বিভিন্ন ফার্মেসি থেকে। একইভাবে ৮৫ দশমিক ১ শতাংশ পরীক্ষা-নিরীক্ষা রোগীকে করতে হয় বিভিন্ন ডায়াগনস্টিক সেন্টারে। ফলে বেড়ে যায় রোগীর চিকিৎসাব্যয়। বিশেষ করে ক্যানসার, কিডনি ডায়ালাইসিস ও ডায়াবেটিসের মতো দীর্ঘমেয়াদি রোগের চিকিৎসায় নিঃস্ব হচ্ছেন রোগী ও তাদের স্বজনরা।
নিত্যপ্রয়োজনীয় সব পণ্যের দাম বাড়ার এক ধরনের প্রতিযোগিতার মধ্যেই এ বছরের জুলাইয়ে বহুল ব্যবহৃত ৫৩টি ওষুধের দাম বাড়ানো হয়। যেসব রোগী এসব ওষুধ নিয়মিত কেনেন তারা এতে চরম বিপাকে পড়েছেন।
রাজধানীর রামপুরার বাসিন্দা মো. সিরাজুল ইসলাম তেমনই একজন। দীর্ঘদিন ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপসহ নানা শারীরিক জটিলতায় ভুগছেন তিনি। প্রতি মাসে চিকিৎসক দেখানো আর ওষুধ কেনাবাবদ তার গুনতে হচ্ছে আট থেকে ১০ হাজার টাকা। স্ত্রী-সন্তানদের চিকিৎসার হিসাব টানলে মাসে এ খাতে ব্যয় দাঁড়ায় ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা। এদিকে, নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রায় সব পণ্যের দাম বাড়তি। ফলে সন্তানদের পড়াশোনা আর সংসার চালাতে নাভিশ্বাস উঠছে তার। দফায় দফায় ওষুধের দাম বাড়ায় চিকিৎসা চালিয়ে নেওয়া এখন কষ্টকর হয়ে দাঁড়িয়েছে তার জন্য।
সিরাজুল ইসলাম বলেন, কেবল আমার ওষুধের পেছনে প্রতি মাসে আট থেকে ১০ হাজার টাকা চলে যায়। পরিবারের অন্য সদস্যরা অসুস্থ হলে কী করব, সন্তানদের পড়াশোনার খরচ কোথা থেকে দেব, মাস চালাব কীভাবে? আমাদের রোজগারই বা কতটুকু? ওষুধ বাদ দিলে আমাকে বিছানায় পড়ে যেতে হবে। তখন সংসারের কী হবে?
সিরাজুল ইসলাম অভিযোগ করে বলেন, চিকিৎসক দেখানোর পর ওষুধ কোম্পানির লোকজন সিরিয়াল ধরে দাঁড়িয়ে থাকে প্রেসক্রিপশন দেখার জন্য। কারণ, তারা চিকিৎসকদের অর্থসহ নানা সুবিধা দিচ্ছে। সে অনুযায়ী চিকিৎসকরা তাদের কোম্পানির ওষুধ লিখছেন কি না, সেটা দেখা হয়। কোম্পানিগুলো মাসোহারা হিসেবে লাখ লাখ টাকা খরচ করছে চিকিৎসকদের পেছনে। মাসোহারার এ টাকা কমিয়ে ওষুধের দাম কম রাখা যেত।
ফার্মাসিউটিক্যালস মার্কেট-সংশ্লিষ্ট কয়েকজনের সঙ্গে কথা হয় ঢাকা পোস্টের। তারা জানান, ব্যবস্থাপত্রে নিজ প্রতিষ্ঠানের ওষুধ লেখার বিষয়ে চিকিৎসকদের নগদ অর্থ দেওয়ার প্রক্রিয়াটি সর্বপ্রথম স্বল্প আঙ্গিকে শুরু করে ড্রাগ ইন্টারন্যাশনাল ও প্যাসিফিক ফার্মা। তাদের ‘ক্রনিক কেয়ার’-এর ওষুধগুলো ব্যবস্থাপত্রে লেখার জন্য চিকিৎসকদের এ সুবিধা দেওয়া হয়।
মানুষ যদি একবার হার্টের ওষুধ খাওয়া শুরু করে, এটা চলতেই থাকবে। ব্লাড প্রেশার, ডায়াবেটিসের ওষুধ একবার খাওয়া শুরু করলে মৃত্যু পর্যন্ত সেটা চলতে থাকবে। ক্রনিক ওষুধগুলো সাধারণত চিকিৎসকরা সহজে লিখতে চান না, যতক্ষণ না তারা নিশ্চিত হন যে ওষুধগুলো যথেষ্ট কার্যকর। এ অবস্থায় নির্বাচিত কিছু চিকিৎসকের সঙ্গে ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধি যোগাযোগ করেন এবং টাকার বিনিময়ে তাদের হাত করে ফেলেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা বলেন, আজ থেকে ১৫ বছর আগে সারা দেশে ২০ জনের বেশি এন্ডোক্রাইনোলজিস্ট ছিলেন না। তাদের সবাইকে হাত করে ফেলল প্যাসিফিক ফার্মা। কার্ডিয়াক প্রোডাক্টসের জন্য কার্ডিওলজিস্টদের হাত করে ফেলল ড্রাগ ইন্টারন্যাশনাল। ১৯৯৯ সালে ইনসেপটা ফার্মা যখন বাংলাদেশে এলো তখন তারা সাধারণভাবে গড়পরতা সব চিকিৎসককে টাকা দেওয়ার প্রচলন শুরু করল। ধীরে ধীরে সব প্রতিষ্ঠান এদিকে ঝুঁকতে থাকল।
‘লেনদেনের বিষয়টি (চিকিৎসকদের অর্থ দেওয়া) আরও ব্যাপক মাত্রা পায় ২০০৬/২০০৭ সালের দিকে। এ সময় ইনসেপটার একটা গ্রুপ অপসোনিনে চলে আসে। তারা ইনসেপটাকে টপকাতে চিকিৎসকদের দ্বিগুণ টাকা দেওয়া শুরু করে। অসুস্থ এ প্রতিযোগিতার ফলে বর্তমানে একজন চিকিৎসকের সঙ্গে একটি ওষুধ কোম্পানির মাসিক চুক্তি দাঁড়ায় লক্ষাধিক টাকায়!’
চিকিৎসকদের মাসোহারা দেওয়া প্রসঙ্গে ইনসেপটা ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের মিডিয়া কনসালটেন্ট জাহিদ রহমান বলেন, কোনো ওষুধ কোম্পানি যদি চিকিৎসকদের সঙ্গে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে, সেটা অনৈতিক। আমার জানা মতে ইনসেপটা ফার্মাসিউটিক্যালসের এমনটি করার কথা নয়। কোম্পানির প্রমোশন সিস্টেম প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এগুলো আমাদের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ভালো বলতে পারবেন। তবে আমি যতটুকু বলতে পারি, আমাদের কোম্পানি চিকিৎসকদের নানা সাইন্টিফিক সেমিনারে অংশ নেয়, সহায়তা করে। এটা আমাদের প্রমোশনের বড় মাধ্যম।
শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ আশরাফুল হক বলেন, চিকিৎসকদের এমন কর্মকাণ্ডের বিষয়ে আগে যখন শুনতাম তখন খুব বিব্রত হতাম। কিন্তু এখন আর হই না। কারণ, আমাদের আসলে লাজলজ্জা চলে গেছে। বলতে খারাপ শোনালেও সত্য, আমরা এতটাই নগ্ন হয়ে গেছি যে, ওষুধ কোম্পানিগুলো এখন আমাদের কোনো মূল্যই দেয় না। আমার কলিগ তো তাদের কাছে সোল্ড-আউট (বিক্রি হয়ে গেছে) হয়ে গেছে; তাহলে আমাকে মূল্য দিয়ে তাদের লাভ কী?
‘এমনও দেখেছি, ওষুধ কোম্পানিগুলো আমাদের অধ্যাপকদের ছেলে-মেয়েদের বিয়ের খরচ পর্যন্ত দেয়। বিদেশে বেড়াতে যাওয়ার টিকিট দেয়, বিদেশে বিভিন্ন কনফারেন্সে যাওয়ার খরচ দেয়। এভাবে আসলে তারা কোম্পানিগুলোর কাছে জিম্মি হয়ে যাচ্ছেন। এটা এখন অনেকটা ক্যান্সারের মতো ছড়িয়ে পড়েছে। কোনোভাবেই এটাকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হচ্ছে না।’


প্রকাশিত: ডিসেম্বর ৭, ২০২২ | সময়: ৫:১৫ পূর্বাহ্ণ | সুমন শেখ