সর্বশেষ সংবাদ :

রকিবুলের দুর্দান্ত বোলিংয়ে রোমাঞ্চকর জয় উত্তরাঞ্চল

স্পোর্টস ডেস্ক: শেষ ওভার যখন শুরু, তখনও ম্যাচে সব ফলই সম্ভব! দক্ষিণাঞ্চলের প্রয়োজন ১০ রান, উত্তরাঞ্চলের ২ উইকেট। দুই দলের জয়-পরাজয়ের মাঝখানে দাঁড়িয়ে নাসির হোসেন, পুরনো সেই ‘ফিনিশার’ পরিচয়ে আবার আবির্ভুত হওয়ার চেষ্টায়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি রান আউট প্রথম বলেই। পেরে উঠল না তার দলও। রোমাঞ্চের দোলায় দুলে শিরোপা জিতে নিল উত্তরাঞ্চল।
বিসিএলের দশম আসরের ওয়ানডে সংস্করণের ফাইনালে দক্ষিণাঞ্চলকে ৩ রানে হারিয়ে শিরোপা জিতেছে উত্তরাঞ্চল। মিরপুর শের-ই-বাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়ামে রোববার তাদের ৮ উইকেটে ২৪৪ রানের জবাবে ৯ উইকেট হারিয়ে ২৪১ রান করে দক্ষিণাঞ্চল।
শেষ ওভারে ফয়সালা হওয়া ম্যাচে ছিল অনেক উত্থান-পতন। নানা সময়ে নানা মোড় নিয়ে এগিয়ে যায় ম্যাচ। রান তাড়ায় সাবলীল ব্যাটিংয়ে দারুণ জুটি গড়েন এনামুল হক ও জাকির হাসান। শক্ত ভিত পায় দক্ষিণাঞ্চল। কিন্তু রান আউট হয়ে যান দারুণ খেলতে থাকা জাকির। পরে রকিবুল হাসানের ঘূর্ণিতে নামে ধস, ম্যাচে ফেরে উত্তরাঞ্চল। সেখান থেকে নাসির হোসেন ও নাসুম আহমেদ দৃঢ়তায় জমে ওঠে লড়াই। নাসুম ফিরে গেলেও চেষ্টা চালিয়ে যান নাসির। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ তিনিও।
গত বছর থেকে বিসিএলের প্রথম শ্রেণির ম্যাচের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয় ওয়ানডে সংস্করণ। প্রথমবার দুই সংস্করণেই চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল মধ্যাঞ্চল। এবার প্রথমবারের মতো ৫০ ওভারের টুর্নামেন্টের শিরোপা জিতল উত্তরাঞ্চল। উত্তরাঞ্চলকে আড়াইশ ছুঁইছুঁই সংগ্রহ এনে দেওয়ার কারিগর আকবর আলি ও শামীম হোসেন। ৩ চার ও ২ ছয়ে করেন আকবর ৪১ বলে ৪৪ রান। স্রেফ ২০ বলে ৩৭ রানের ইনিংস খেলেন শামীম। এই দুজনের জুটির আগে বিপর্যয়ের মধ্যে এক প্রান্ত আগলে রেখে ফিফটি করেন ফজলে মাহমুদ রাব্বি।
পরে দক্ষিণাঞ্চলের হয়ে দুর্দান্ত শুরু করা এনামুলকে ফেরানোসহ দক্ষিণাঞ্চলকে আটকে রাখার কাজটি সুনিপুণভাবে করেন উত্তরাঞ্চলের বাঁহাতি স্পিনার রকিবুল। ১০ ওভারে স্রেফ ২৯ রান খরচায় ৪ উইকেট নেন তিনি। তার হাতেই ওঠে ম্যাচসেরার পুরস্কার। টস হেরে ব্যাট করতে নেমে উত্তরাঞ্চলের শুরুটা ভালো ছিল না। শেষ দুই ম্যাচের মতো এদিনও হাসেনি অধিনায়ক লিটন দাসের ব্যাট। শরিফুল ইসলামের নিচু হয়ে যাওয়া ডেলিভারিতে এলবিডব্লিউ হন তিনি ১১ বলে ১ রান করে।
শাহাদাত হোসেন ও সৈকত আলিও হতাশ করলে পঞ্চাশের আগেই ৩ উইকেট হারায় উত্তরাঞ্চল। ধাক্কা সামাল দিয়ে চতুর্থ উইকেটে ৭৮ রান যোগ করেন ফজলে রাব্বি ও মাহমুদউল্লাহ। উইকেট আগলে রাখার কাজটি করেন ফজলে মাহমুদ। শুরুতে একটু সময় নিলেও মাহমুদউল্লাহ পরে চেষ্টা করেন রানের গতি বাড়ানোর। জিয়াউর রহমানকে টানা দুই বলে স্লগ করে ছক্কা মারেন তিনি মিড উইকেট দিয়ে।
দুজনের ৭৮ রানের জুটি ভাঙে মাহমুদউল্লাহর বিদায়ে। ৫৩ বলে ৩৯ রান করে তার ইনিংস শেষ হয় নাসির হোসেনের বলে প্যাডল খেলতে গিয়ে বোল্ড হয়ে। ছয় নম্বরে নেমে খেলার গতিপখ বদলে দেন আকবর। কামরুল ইসলাম রাব্বির বলে সোজা ব্যাটে লং অন দিয়ে দৃষ্টিনন্দন ছক্কা হাঁকান এ কিপার-ব্যাটসম্যান। ইতিবাচক ব্যাটিংয়ে রানের গতি বাড়াতে থাকেন তিনি।
অপরপ্রান্তে রয়েসয়ে খেলে পঞ্চাশ করেন ফজলে রাব্বি। তার ব্যাট থেকে আসে ১১৪ বলে ৬৫ রানের ইনিংস। যেখানে ছিল ৪ চার ও ১ ছয়। ফজলে রাব্বি আউট হওয়ার পর ব্যাটিংয়ে নামেন শামীম। দক্ষিণাঞ্চলের সবচেয়ে মিতব্যয়ী বোলার মেহেদী হাসান মিরাজের এক ওভারে রিভার্স সুইপে বাউন্ডারি মারার পরের বলেই স্লগ সুইপে বিশাল এক ছক্কা হাঁকান তিনি। পরে নাসিরের এক ওভারে মারেন তিন চার।
শামীমের শেষ দিকের এই ৫ চার ও ১ ছয়ের ঝড়েই লড়াই করার পুঁজি পায় উত্তরাঞ্চল। দক্ষিণাঞ্চলের হয়ে ৩ উইকেট নেন বাঁহাতি পেসার শরিফুল। মিরাজ ১০ ওভারে ৩১ রান দিয়ে নেন ২ উইকেট। টুর্নামেন্টে সর্বোচ্চ ১০ উইকেট শিকারি তিনিই। রান তাড়া করতে নেমে শুরুতেই হোঁচট খায় প্রথম পর্বের তিন ম্যাচে অপরাজিত থাকা দক্ষিণাঞ্চল। আকবর আলির দুর্দান্ত সরাসরি থ্রোয়ে ফেরেন আগের তিন ম্যাচে টানা ফিফটি করা ওপেনার মোহাম্মদ নাঈম শেখ।
তবে শুরুর ধাক্কা দারুণভাবে সামলে নেন এনামুল ও জাকির। প্রথম তিন ম্যাচে রান পাননি দুজনের কেউই। ফাইনালের মঞ্চে জ্বলে ওঠেন দুজনই। স্রেফ ১২.২ ওভারে ১০০ রানের জুটি গড়েন তারা। মাহমুদউল্লাহ ও রকিবুলকে ডিপ মিড উইকেট দিয়ে ছক্কায় ওড়ান জাকির। এনামুল ছিলেন আরও আগ্রাসী। শফিকুল ইসলামের পরপর দুই বাউন্সারে দারুণ দুটি পুল শটে সীমানা পার করেন তিনি। পরে সৈকত আলির বলে ছক্কা মেরে ফিফটি পূরণ করেন স্রেফ ৩৪ বলে।
ইনিংসের ১৮তম ওভারে দ্রুত রান নেওয়ার কল করেন এনামুল। জাকির প্রায় মাঝ পথে চলে যাওয়ার পর ফিরিয়ে দেন তিনি। মাহমুদউল্লাহর থ্রো ধরে দ্রুততার সঙ্গে স্টাম্প ভেঙে দেন রকিবুল। থেমে যায় জাকিরের ৪ চার ও ২ ছয়ে সাজানো ৪৪ রানের ইনিংসের। পরে এনামুলও বেশি দূর যেতে পারেননি। রকিবুলের সাদামাটা ডেলিভারিতে ফিরতি ক্যাচ দিয়ে সাজঘরের পথ ধরেন তিনি। ৩ চার ও ৫ ছয়ের মারে ৪৮ বলে ৫৯ রান করেন এ কিপার-ব্যাটসম্যান। পরের বলেই তেড়েফুঁড়ে মারতে গিয়ে স্টাম্পিং হন তৌহিদ হৃদয়।
রানের খাতা খোলার আগে ফেরার পথ ধরেন নাঈম ইসলাম ও অধিনায়ক মিরাজও। ১ উইকেটে ১১৭ থেকে পরের ৪ রানে ৫ উইকেট হারিয়ে বিপদে পড়ে যায় দক্ষিণাঞ্চল। চাপ আরও বাড়ে ২৫তম নাসিরের জোরালো শট জিয়াউর রহমানের হাতে লাগলে। তীব্র ব্যথার কারণে ব্যাটিং চালিয়ে নিতে পারেননি তিনি। ফিরে যেতে হয় প্যাভিলিয়নে।
১২৭ রানের মাথায় জিয়াউরের জায়গায় নামেন নাসুম। তাকে নিয়ে নতুন লড়াই শুরু করেন নাসির। দ্রুত রান তোলার চাহিদা না থাকায় ঠাণ্ডা মাথায় পরিস্থিতি সামাল দেন এ দুজন। দেখেশুনে খেলে দলকে এগিয়ে নিতে থাকেন জয়ের পথে। ব্যক্তিগত ৪৩ রানের মাথায় রিপন মন্ডলের হাতে ফিরতি ক্যাচ দিয়ে বেঁচে যান নাসির। পরে রকিবুলের শেষ ওভারে ওভারে সেই রিপনই মিড উইকেটে দারুণ এক ক্যাচে ভাঙেন ৮৫ রানের জুটি। নাসুমের ব্যাট থেকে আসে ৭০ বলে ৩৮ রান।
জিয়াউর পরে ব্যাটিংয়ে ফিরলেও রানের খাতা খুলতে পারেননি। সাইফ উদ্দিনের বলে উইকেটের পেছনে ক্যাচ দেন তিনি। তখনও জয়ের জন্য বাকি ছিল ২৬ বলে ২৯ রান। নাসির লড়াই চালিয়ে যান। তবে শেষ দিকে প্রত্যাশিত বাউন্ডারি তিনি আদায় করতে পারেননি। শেষ ওভারে ১০ রানের সমীকরণে শফিকুল ইসলামের প্রথম বলে দুই রান নেওয়ার চেষ্টা করলেও সফল হননি।
শামীমের থ্রোয়ে দারুণ ক্ষিপ্রতায় স্টাম্প ভাঙেন আকবর। থেমে যায় নাসিরের ৮৮ বলে ৬১ রানের ইনিংস। শেষ হয়ে যায় দক্ষিণাঞ্চলের আশাও। ফাইনালে হারলেও সর্বোচ্চ রান ২১০ রান করে নাঈম শেখ পেয়েছেন টুর্নামেন্ট সেরার পুরস্কার। এছাড়া ফাইনালের পর পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে জাতীয় লিগের সেরা ক্রিকেটার আব্দুল্লাহ আল মামুনের হাতে তুলে দেওয়া হয় বিসিবির প্রবর্তিত নতুন পুরস্কার ‘জহির-মুনির অ্যাওয়ার্ড ফর ক্রিকেটিং এক্সিলেন্স।’


প্রকাশিত: নভেম্বর ২৯, ২০২২ | সময়: ৫:৩৪ পূর্বাহ্ণ | সুমন শেখ