সর্বশেষ সংবাদ :

ব্রি-৭৫ ধানের উৎপাদনে চমক

স্টাফ রিপোর্টার : উত্তরের জেলা রাজশাহীতে শুরু হয়েছে আমনের কাটা-মাড়াইয়ের কাজ। হেমন্তের শুরুতেই ক্ষেতে ক্ষেতে সোনালী ধানের শীষ দোল খাচ্ছে। তাই আগেভাগেই বরেন্দ্র অঞ্চলের কৃষকরা মাঠে নেমেছেন সোনালী ধান ঘরে তোলার কাজে। এখন মাঠের পাকা ধান ঘরে ঘরে তোলা নিয়ে ব্যস্ত কৃষাণ-কৃষানী ও শ্রমিকরা।
চলতি বছর মৌমসুমের শুরুতেই প্রাকৃতিক দূর্যোগ ও সার ঘাটতিসহ নানা প্রতিকূলতা কাটিয়ে রাজশাহীতে আমনের বাম্পার ফলনের প্রত্যাশা করছেন কৃষি সংশ্লিষ্টরা। নানা জাতের আমনের পাশাপাশি নতুন উদ্ভাবিত ব্রি-৭৫ জাতেরও বাম্পার ফলন হয়েছে এবার রাজশাহীর বরেন্দ্র অঞ্চলে।
রাজশাহী জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্যমতে, এবছর রাজশাহীতে আমন ধান আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ছিলো ৮০ হাজার ৫০ হেক্টর জমি। তবে লক্ষ্যমাত্রা পেরিয়ে শেষ পর্যন্ত আমনের আবাদ হয়েছে ৮০ হাজার ৮৩২ হেক্টর জমিতে। এ বছর জেলায় উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ২ লাখ ৭৯ হাজার ৩৭৫ মেট্রিক টন ধান। ইতিমধ্যে ধান কাটা মাড়াই শুরু হয়েছে। ইতিমধ্যে জেলায় ১ হাজার ১২০ হেক্টর জমির ধান কাটা শেষ হয়েছে। যা মোট আবাদের ১ দশমিক ৩৯ শতাংশ। কর্তনকৃত ধানের ফলন হয়েছে ৩ হাজার ৫৩৭ মেট্রিক টন।
বরেন্দ্রের কৃষকরা বলছেন, এবছর আমন আবাদের শুরুতেই কৃষকরা ধাক্কা খেয়েছে। পানি ও সারের ঘাটতি ছিল; যেটার সুযোগ নিয়েছিলো অসাধু সিন্ডিকেট। এতে প্রান্তিক পর্যায়ে অনেক কৃষক সরকার নির্ধারিত দামে সার পান নি। বেশি দামে সার কিনতে হয়েছে তাদের। এতে উৎপাদন খরচ বেড়েছে। তবে কৃষক যেটুকু জমিতে আবাদ করেছে সেটার পূর্ণ যত্ন নিয়েছে। রাসায়নিক সারের বদলে ছাই ও গোবর সার ব্যবহার করেছে। একারণে শেষ অবধি ফলনহানি হয়নি। দিগন্ত জোড়া বিস্তীর্ণ মাঠে মাঠে মাঠ এখন দোল খাচ্ছে সোনালী ধান। কৃষকরা বলছেন, সব মিলিয়ে এবার আমানের বাম্পার ফলন হবে। বাজারে ধানের কাঙ্খিত দাম মিললে কৃষক উপকৃত হবে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজশাহীতে আমনের ভরা মৌসুমে এ বছর সারের ঘাটতির মুখে পড়েছিলো কৃষক। বিশেষ করে এমওপি এবং টিএসপি সারের ঘাটতি দেখা দিয়েছিলো। রাজশাহীতে গত জুলাই মাসে চাহিদার তুলনায় প্রায় ১৩৬ মেট্রিক টন এমওপি সারের ঘাটতি ছিল। আগস্টেও প্রায় ৮০০ মেট্রিক টনের মতো ঘাটতি ছিলো। আর এই ঘাটতির মধ্যে অসাধু সার ব্যবসায়ীদের কারসাজিও ছিলো। তবে সবকিছু উপেক্ষা করে কৌশলি হয়েই আবাদের যত্ন নিয়েছিলেন কৃষকরা। এতে আবাদকৃত জমিতে ভালোভাবেই ফলনের আশা করছেন কৃষকরা।
রাজশাহী তানোর উপজেলার জাতীয় পদকপ্রাপ্ত কৃষক নূর মোহাম্মদ জানান, মৌসুমের শুরুতেই এবার রাসায়নিক সারের ঘাটতি ছিলো। ডিলারদের কাছে চাহিদা অনুযায়ী সার না পেয়ে হাট-বাজারের দোকান থেকে চড়া দামে সার কিনতে বাধ্য হয়েছেন তারা। কোনো সারই সরকার নির্ধারিত দামে তারা পান নি। এতে উৎপাদন খরচ বেড়েছে। তবে প্রথম দিকে ফলন হানির যে শঙ্কা ছিলো; সেটা নাই। এখন পর্যন্ত ভালো ফলন আছে। তিনি জানান, এরইমধ্যে কিছু আমন ধান কেটেছেন তিনি। কিছু আধাপাকা এবং কিছু কর্তনযোগ্য অবস্থায় রয়েছে। ফলন নিয়ে তিনি সন্তুষ্ট।
জেলার পবা উপজেলার কৃষক আনসার আলী জানান, ধানের ফলন অনেক ভালো আছে এবার। তবে যে খরচ হয়েছে তাতে লাভের আশা করা যায় না। কোনোমতে খরচটা হয়তো তুলতে পারবেন। তারমতে বাজারে ধানের মূল্যের ওপর নির্ভর করবে কৃষকের লাভ-ক্ষতির হিসেব।
রাজশাহী েেজলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক মোজদার হোসেন জানান, কৃষি বিভাগ কৃষকদের পাশে সবসময় ছিলো। এরই ধারাবাহিকতায় এবারও লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি জমিতে আমনের আবাদ হয়েছে জেলায়। ফলনও অনেক ভালো। এখন আর ফলনহানী শঙ্কা নেই।
এদিকে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতে ধানের জাত উদ্ভাবন করে আসছে। এই প্রতিষ্ঠানের অবমুক্ত করা উচ্চফলনশীল নতুন ধানের জাত ব্রিধান ৭৫। এবার এ ধান বিঘায় ২২মণ হারে ফলন দিয়েছে রাজশাহীতে। রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার দেওপাড়া ইউপির সারইল গ্রামে চলতি আমন মৌসুমে চাষ করা হয়েছিল ব্রিধান ৭৫। ১১০ দিনে মাথায় গেল শুক্রবার কাটা হলো সেই ধান। এসময় জমিতে উপস্থিত ছিলেন রাজশাহী বিভাগীয় কমিশনার জি এস এম জাফরউল্লাহ, ব্রি’র মহাপরিচালক ড. শাহজাহান কবীর, রাজশাহী রিজিওনের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও অফিস প্রধান ড. মো: ফজলুল ইসলাম ও কয়েকশ কৃষক।
জমি থেকে কাটা ধান মাড়াই করার পর কাঁচাভেজা দাঁড়িপাল্লায় মেপে দেখা গেলো কাঁটায় কাঁটায় প্রায় ২২ মণ! এতে জমির মালিক আবুল হোসেন মাসুদ বেজায় খুশি। শুধু আবুল হোসেন নয়, এই উপজেলাসহ বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট রাজশাহী কৃষি অঞ্চলে (রাজশাহী, নাটোর, নওগাঁ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ) অন্তত চারশ বিঘা জমিতে ব্রিধান ৭৫ চাষাবাদ করা হয়েছে। পোকামাকড়ের বালাই নেই। সুগন্ধি জাতের এমন ধান চাষের পরও জমিতে সরিষা লাগানোর সুযোগ থাকে। ফলে কৃষকরা ব্রি-৭৫ জাতের নতুন ধান চাষ করে বেশ লাভবান হয়েছেন।
পেশায় শিক্ষকতা হলেও রাজশাহীর গোদাগাড়ীর কেতাদুরস্ত কৃষক আবুল হোসেন মাসুদ। কথা হয় তার সাথে। তিনি বলেন, এই ধানের (ব্রি-৭৫) চাল চিকন। এর ভাত হয় ঝরঝরে। আমরা ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরামর্শ ও সহায়তা নিয়ে ব্রি-ধান ৭৫ চাষ করেছি। উচ্চফলন এবং আরও কিছু সুবিধা হওয়ায় আমাদের দেখাদেখি অন্যান্য কৃষকও এতে আগ্রহী হয়েছেন। আরো একটি সুবিধে এই ধান হেলে পড়ে না। আর সবচেয়ে বড় লাভ হলো ধান কেটে একই জমিতে সরিষার পাশাপাশি অন্য যেকোনো ফসল চাষাবাদ সম্ভব।
একই এলাকার কৃষক আবুল হোসেন, সাইফুল ইসলাম, সিরাজুল ইসলাম, আব্দুল জব্বারসহ কয়েকজন জানান, আমরা আগামী বছর আরও বেশি জমিতে এই ধানের চাষ করতে চাই। ২২ মণ হারে ফলন হলে কৃষকরা চাষ করবেই। যেধান ভালো আর চাষ করার পর অন্য ফসল হবে সেটাতেই কৃষক ঝুঁকবে বলে বলেন তারা।
রাজশাহী ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. ফজলুল ইসলাম বলেন, এ বছর রাজশাহীর ৪০০ বিঘা জমিতে ব্রি-ধান-৭৫ চাষ হয়েছে। আমরা কৃষকদের বীজ ও সার সরবরাহ ছাড়াও অনেক সহায়তা দিয়েছি। গবাদিপশুর খাবার হিসেবে এই ধানের খড় বেশ উপযোগী। ধান হেলে পড়েনা, ফলন বেশি, খেতে সুস্বাদু, রোগ-বালাই কম।
ব্রি’র মহাপরিচালক ড. শাহজাহান কবীর বলেন, এই ধান অন্য ধানের তুলনায় অনেক উন্নত। এই ধান চাষ করার পর সরিষা ভালো হবে। আমরা তেল জাতীয় ফসলের দিকে পিছিয়ে আছি। দেশে সয়াবিন আমদানির ষড়যন্ত্রের কারণে সরিষা চাষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বছরে ২৪ থেকে ২৫ হাজার কোটি টাকার তেল আমদানি করতে হয়। যদি আমরা সরিষা চাষ করি তাহলে বাড়তি টাকা পাব। দেশ বাঁচবে আপনারাও (কৃষক) লাভবান হবেন। এজন্য ফসলের শস্যবিন্যাস খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
রাজশাহী বিভাগীয় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের অতিরিক্ত পরিচালক কৃষিবিদ শামছুল ওয়াদুদ বলেন, এই ধান যদি আরোও আগে লাগাতে পারলে আরোও আগে তুলতে পারবেন। আগের প্রাচীন পদ্ধতি ছেড়ে আধুনিক কৃষির দিকে যেতে হবে। এই ধান কেটে সরিষা, এরপর সরিষা তুলে বোরো হবে। এরবছর ৩০ শতাংশ সরিষা আবাদ বাড়াতে হবে, আগামী বছর ৭০ শতাংশ ও পরবর্তীতে দেড়শ শতাংশে উন্নত করতে হবে।


প্রকাশিত: অক্টোবর ৩০, ২০২২ | সময়: ৬:৪১ পূর্বাহ্ণ | সুমন শেখ

আরও খবর