লেনদেন ভারসাম্যে দুর্দশা বৈশ্বিক সঙ্কটের কারণে: প্রধানমন্ত্রী

সানশাইন ডেস্ক: মহামারীর পর যুদ্ধের জেরে বৈদেশিক লেনদেনের চলতি হিসাব ভারসাম্যে (ব্যালেন্স অব পেমেন্টে) ‘শঙ্কাজনক পরিস্থিতি’ তৈরি হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
তিনি বলেছেন, “কোভিড অতিমারী, রাশিয়া-ইউক্রেইন যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে বিশ্ব অর্থনীতির দুর্বল প্রবৃদ্ধি, সরবরাহ শৃঙ্খলা ব্যাহত হওয়া, বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেল, গ্যাস, খাদ্যপণ্য, ভোগ্যপণ্য, শিল্পের কাঁচামাল এবং আন্তর্জাতিক কার্গো ফ্রেইট খরচ বৃদ্ধি, রপ্তানি হ্রাস, প্রবাসী আয়ের ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধির কারণে এই শঙ্কাজনক পরিস্থিতি হয়েছে।”
বুধবার সংসদে রংপুর-১ আসনের এমপি মসিউর রহমান রাঙ্গাঁর প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী একথা বলেন। এর আগে স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে সংসদের বৈঠক শুরু হলে প্রশ্নোত্তর টেবিলে উত্থাপিত হয়। গত ২০২১-২২ অর্থবছরে দেশের বাণিজ্য ঘাটতি ৪০ শতাংশ বেড়ে রেকর্ড ৩৩ দশমিক ২৪ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছায়।
তাতে ব্যালেন্স অব পেমেন্টে ঘাটতি দাঁড়ায় ১৮ দশমিক ৬৯ বিলিয়ন ডলার, যা দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। একই প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, তার সরকার গত ১৪ বছর ধরে বাজেট ঘাটতি এবং ঋণের মাত্রা টেকসই ও সহনীয় পর্যায়ে রাখতে ‘অসাধারণ সাফল্য’ দেখিয়েছে। “করোনা পরিস্থিতিসহ নানা অভ্যন্তরীণ এবং আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক সমস্যা সত্ত্বেও বাজেট ঘাটতি জিডিপির পাঁচ শতাংশের মধ্যে রাখা সম্ভব হয়েছে। ঋণ ও জিডিপি অনুপাতও স্বাচ্ছন্দ্যের পর্যায়ে রয়েছে; ২০২১-২২ অর্থবছর শেষে ৩৪ শতাংশে, অর্থাৎ বাংলাদেশের জন্য প্রযোজ্য আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ঋণের স্থিতির প্রান্তিক সীমারেখার বেশ নিচে রয়েছে।”
পরিস্থিতি মোকাবেলায় বর্তমান সরকারের নেওয়া বিভিন্ন পদক্ষেপ তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “প্রবাসী আয় বাড়াতে প্রণোদনা বাড়ানোসহ রেমিটেন্স পাঠানো সহজ করা হয়েছে। ডলারের চাহিদা বাড়ানোর প্রবণতা ঠেকাতে বাংলাদেশ ব্যাংক কয়েক দফায় ডলারের বিপরীতে টাকার মূল্যমান সমন্বয় করেছে।
“বাংলাদেশ ব্যাংক বিভিন্ন তফসিলি ব্যাংকের নিকট বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে গত ২০২১-২২ অর্থ-বছরে ৭ দশমিক ৬২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিক্রয় করেছে। আমদানি ব্যয় মেটাতে বৈদেশিক মুদ্রার চাহিদা কমাতে, ব্যাক টু ব্যাক আমদানিসহ শিল্পের কাঁচামাল আমদানি, এবং কৃষি সরঞ্জাম এবং রাসায়নিক সার আমদানির জন্য সরবরাহকারী/ক্রেতার ক্রেডিট এর আওতায় বিলম্বিত সময়কাল বাড়িয়ে দ্বিগুণ করা হয়েছে।”
আমদানি নির্ভরতা ও কম গুরুত্বপূর্ণ সরকারি ব্যয় বন্ধ অথবা কমানো, বিলাসী ও অপ্রয়োজনীয় আমদানি নিরুৎসাহিত করা এবং আন্ডার /ওভার ইনভয়েসিংয়ের বিষয়টি সতর্ক পর্যবেক্ষণে রাখার কথাও প্রধানমন্ত্রী বলেন। সরকারের নেওয়া এসব পদক্ষেপে শিগগিরই ব্যালেন্স অব পেমেন্টের হিসাবে ‘সার্বিক উন্নতি হবে’ বলে আশা প্রকাশ করেন প্রধানমন্ত্রী।
জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য ফখরুল ইমামের এক প্রশ্নের উত্তরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন ২০১৫ সাল থেকে প্রায় দ্বিগুণ হওয়ায় অবসর ভাতার পরিমাণও কয়েক গুণ বেড়েছে। বর্তমান সরকারের সময়ে ২০০১-২০২২ সালের জুলাই পর্যন্ত ১ লাখ ১৪ হাজার জন অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক-কর্মচারীকে ৬ হাজার ৬১ কোটি টাকা অবসর সুবিধা দেওয়া হয়েছে। বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান শিক্ষক ও কর্মচারী অবসর সুবিধা বোর্ড এবং বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান শিক্ষক ও কর্মচারী কল্যাণ ট্রাস্টকে যথাক্রমে ৮২২ কোটি ও ৩৬০ কোটি টাকা এককালীন বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।
তিনি জানান, বর্তমানে ৩২ হাজার শিক্ষক-কর্মচারীর আবেদন নিষ্পত্তির অপেক্ষায় রয়েছে। এটা নিষ্পত্তি করতে তিন হাজার কোটি টাকার প্রয়োজন। এসব আবেদন পর্যায়ক্রমে নিষ্পত্তি করা হচ্ছে। বগুড়া-৫ আসনের হাবিবর রহমানের এক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, জাতিসংঘে বর্তমানে ৮টি শান্তিরক্ষা মিশনে মোট ৬ হাজার ৮৩৬ জন শান্তিরক্ষী নিয়োজিত রয়েছেন, এর মধ্যে ৫২১ জন নারী। মিশনে নিয়োজিত থাকা অবস্থায় এ পর্যন্ত মোট ১৬১ জন নিহত হয়েছেন এবং ২৫৮ জন আহত হয়েছেন।
সরকারি দলের সংসদ সদস্য শহিদুল ইসলামের প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, চাহিদা বিবেচনায় জুলাই-ডিসেম্বর ২০২২ সময়ের জন্য প্রয়োজনীয় পরিমাণ জ্বালানি তেল আমদানির লক্ষ্যে সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আমদানিসূচি নিশ্চিত করা হয়েছে। “জ্বালানি তেলের চাহিদা এবং চাহিদা পূরণ করা একটি চলমান প্রক্রিয়া। বিদেশ থেকে জ্বালানি তেল সংগ্রহের জন্য ছয় মাসভিত্তিক চুক্তি করা হয়ে থাকে। বর্তমানে বিদ্যমান চুক্তির মেয়াদ আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত বলবৎ আছে।
“মজুদকৃত জ্বালানি তেল দিয়ে ৩০ থেকে ৩৫ দিনের চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হবে এবং এই সময়ের মধ্যে জ্বালানি তেল নিয়ে দুটি জাহাজ দেশে এসে পৌঁছাবে। অর্থাৎ নিরবচ্ছিন্নভাবে দেশে জ্বালানি তেল সরবরাহ অব্যাহত থাকবে।” সংসদ নেতা বলেন, গত ১৬ অগাস্ট পর্যন্ত দেশে ৬ লাখ ২০ হাজার ১৪৮ মেট্রিক টন পরিশোধিত, ৮১ হাজার ৮৪৬ মেট্রিক টন অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের মজুদ আছে। অর্থাৎ মোট মজুদে আছে ৭ লাখ ১ হাজার ৯৯৪ মেট্রিক টন তেল।
জ্বালানি তেল আমদানি অব্যাহত রাখতে সরকারের নেওয়া পদক্ষেপ তুলে ধরে তিনি বলেন, চাহিদা বিবেচনায় চলতি আগস্ট মাসে প্রায় ৩ লাখ ২৫ হাজার মেট্রিক টন ডিজেল, ৫০ হাজার মেট্রিক টন জেট ফুয়েল এবং ৫০ হাজার মেট্রিক টন অকটেন আমদানি হবে। সেপ্টেম্বরে প্রায় ৩ লাখ মেট্রিক টন ডিজেল, ২০ হাজার মেট্রিক টন জেট ফুয়েল, ৫০ হাজার মেট্রিক টন ফার্নেস অয়েল এবং ২৫ হাজার মেট্রিক টন অকটেন আমদানির সূচি চূড়ান্ত করা হয়েছে।
জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য সৈয়দ আবু হোসেনের প্রশ্নের জবাবে সংসদ নেতা বলেন, “দেশে বিদ্যুতের চাহিদা অনুযায়ী উৎপাদনের সক্ষমতা রয়েছে। এদিক থেকে দেশে কোনো বিদ্যুৎ সংকট নেই। বৈশ্বিক চলমান জ্বালানি সংকটের কারণে বাংলাদেশ বিদ্যুতের সাশ্রয়ী ব্যবহার এবং পরিকল্পিত লোডশেড করার মাধ্যমে সৃষ্ট সংকট উত্তরণের চেষ্টা চালাচ্ছে।”
“বিদ্যুৎ উৎপাদন অব্যাহত রাখতে উৎপাদন সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও জ্বালানি সাশ্রয়ের লক্ষ্যে ক্ষেত্র বিশেষে ১ হাজার মেগাওয়াট হতে ২ হাজার মেগাওয়াট পর্যন্ত বিদ্যুৎ পরিকল্পিত লোডশেড করা হচ্ছে। পরিকল্পিত এ লোডশেড সিডিউল বিভিন্ন মাধ্যমে গ্রাহকদের নিয়মিতভাবে পূর্বেই অবহিত করা হচ্ছে।”
প্রধানমন্ত্রী জানান, একদিকে এলাকাভিত্তিক পরিকল্পিত লোডশেডিংসহ ‘হলিডে স্ট্যাগারিং’ এর মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদন ও চাহিদার মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করা হচ্ছে। অপরদিকে সাশ্রয়ী বিদ্যুৎ ব্যবহার নিশ্চিত করার জন্য রাত ৮টার মধ্যে সকল শপিংমল, দোকানপাট ইত্যাদি বন্ধ করা, এসির তাপমাত্রা ২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের উপরে রাখা, রুটিন অনুযায়ী শিল্প প্রতিষ্ঠানের সাপ্তাহিক ছুটি মেনে চলা, বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা এবং আলোকসজ্জা পরিহারে গুরুত্বারোপ করা হচ্ছে।


প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ১, ২০২২ | সময়: ৬:০৫ পূর্বাহ্ণ | সুমন শেখ