রাবিতে ভর্তি জালিয়াতে ৩০ জনের চক্র

স্টাফ রিপোর্টার/ রাবি প্রতিনিধি: ‘বি’ ইউনিটের পরীক্ষার মধ্য দিয়ে বুধবার মেষ হয়েছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) ভর্তিযুদ্ধ। দিনদিন ব্যাপী অনুষ্ঠিত ভর্তি পরীক্ষার প্রথম ও শেষদিনে কোনো অঘটন না ঘটলেও দ্বিতীয়দিন বদলী পরীক্ষার কারণে এক চিকিৎসকসক ৫ জনকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। আর এসব প্রক্সি পরীক্ষার নেপথ্যে উঠে এসেছে রাবি ছাত্রলীগের এক নেতাসহ ৩০ সদস্যের চক্রের সন্ধান।
দ্বিতীয় দিনের পরীক্ষায় প্রক্সি দেওয়ার ঘটনা ছাড়া উৎসবমুখর পরিবেশে এবারের ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়েছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। এবার তিনদিনে মোট পরীক্ষার্থী ছিলো এক লাখ ৭৮ হাজার। রাবি কর্তপক্ষ বলছে এবারের পরীক্ষায় অংশগ্রণকারীর শিক্ষার্থীর হার ৮৭ ভাগ।
এদিকে পরীক্ষায় প্রক্সি দিতে এসে এবার চারজন আটক হয়েছেন। এদের মধ্যে একজন চিকিৎসকও ছিলেন। ভ্রাম্যমাণ আদালত তাকে এক বছরের কারাদণ্ড দিয়ে কারাগারে পাঠিয়েছেন। মঙ্গলবার বিকেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের এ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষার চতুর্থ শিফটে এ ঘটনা ঘটে। ওই চিকিৎসকের নাম ডা. সমের রায়। তিনি খুলনা মেডিক্যাল কলেজের প্রাক্তন ছাত্র এবং খুলনার একটি বেসরকারি মেডিকেল কলেজের প্রভাষক বলে জানা গেছে।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, রাহাত আমিন নামে একজনের হয়ে প্রক্সি দিতে এসেছিলেন ডা. সমের রায়। তাকে যেন চেনা না যায় এ কারণে মাথায়, নাক ও হাতে ব্যান্ডেজ বেঁধে এসেছিলেন। তিনি খুলনার একটি মেডিক্যাল কলেজের প্রভাষক বলে দাবি করেছেন। তাকে এক বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। একইসঙ্গে যার হয়ে প্রক্সি দিতে এসেছিল, সেই রাহাত আমিনকে এক মাসের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।
ভ্রাম্যমাণ আদালতের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট কৌশিক আহমেদ বলেন, সন্দেহজনক অবস্থায় তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে তিনি পরিচয় গোপন করেন। পরে জিজ্ঞাসাবাদের মুখে তিনি নিজের চিকিৎসক পরিচয়ের কথা স্বীকার করেন। নিজেকে খুলনা মেডিক্যাল কলেজের কে-২৪ ব্যাচের শিক্ষার্থী এবং বর্তমানে খুলনার গাজী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের শিক্ষক বলে দাবি করেন। আমরা তাকে এক বছরের কারাদণ্ড দিয়ে কারাগারে পাঠিয়েছি। প্রসঙ্গত, একইদিন আরও তিনজন প্রক্সি দিতে এসে আটক হয়েছেন। তাদেরও এক বছর করে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।
এদিকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালেয়ে ভর্তি পরীক্ষায় প্রক্সি দিতে আসা চার জন এবং একজন ক্যান্ডিডেটসহ মোট পাঁচ জনকে দণ্ডিত করে রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানো হয়েছে। এঘটনায় প্রক্সিদাতা বায়জিদ খানকে জিজ্ঞাসাবাদ করার পর তিনি রাবি ছাত্রলীগ নেতা মুশফিক তাহমিদ তন্ময়ের নির্দেশে ভর্তি পরীক্ষায় প্রক্সি দিয়েছেন বলে জানিয়েছেন।
এছাড়া আটক হওয়া ওই চারজনকে জিজ্ঞাসাবাদে চাঞ্চল্যকর তথ্য পেয়েছে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী। উঠে এসেছে ছাত্রলীগ নেতাসহ ৩০ সদস্যের একটি চক্রের তথ্য। চক্রটি নওগাঁর একটি হোটেল থেকে ভর্তি পরীক্ষায় প্রক্সি পরিচালনা করত। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা এসব তথ্য জানিয়েছেন।
তারা জানান, প্রক্সি চক্রের চারজন আটক হলেও একাধিক ভুয়া প্রার্থী পার পেয়ে গেছেন। যারা প্রক্সি পরীক্ষা দিয়েছেন, তারা অধিকাংশই বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ ও মাস্টার্সের শিক্ষার্থী। কোচিং সেন্টার থেকে ভর্তিচ্ছুদের সঙ্গে পরিচয় ও প্রক্সির জন্য দেন দরবার হয়। চক্রটির মূল হোতা হিসেবে কাজ করেছে রাবির তিন শিক্ষার্থী। এদের মধ্যে একজন বিশ^বিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মুশফিক তাহমিদ তন্ময়। তার সঙ্গে রয়েছে লোক-প্রশাসন বিভাগের ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষের আরেক শিক্ষার্থী। তাদেরকে আটক করার জন্য কাজ করছে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী।
মঙ্গলবার রাতে সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হওয়া একটি ভিডিওতে দেখা যায়, প্রক্সি দিতে এসে আটক রাবির ফোকলোর বিভাগের শিক্ষার্থী বায়োজিদ খান জিজ্ঞাসাবাদের এক পর্যায়ে তার বন্ধু ও একই বিভাগের শিক্ষার্থী তন্ময়ের নাম জানায়।
প্রক্সি দেয়ার পূর্বে তিনি তার ফোন তন্ময়ের কাছে জমা রেখেছিলেন। এর আগে ছাত্রলীগ নেতা তন্ময়ের বিরুদ্ধে রাবি ও রুয়েট ক্যাম্পাসে ইয়াবা ও মাদক পাচারের সিন্ডিকেটের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার বিষয়টি একটি গোয়েন্দা রিপোর্টে উঠে আসে।
এদিকে, প্রক্সি দিতে গিয়ে আটক হওয়া আরেকজন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জান্নাতুল মেহজাবিনের কাছ থেকেও পাওয়া গেছে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য। এর আগেও বিভিন্ন চাকরি পরীক্ষার প্রক্সি দিয়েছেন তিনি। গত প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় প্রক্সি দিয়ে তিনজনকে পাস করান তিনি। এছাড়াও ভর্তি পরীক্ষায় তার সঙ্গে প্রক্সি দিতে যান রনি নামে আরেক ভুয়া প্রার্থী। পরীক্ষা শেষে তাকে জিজ্ঞাসাবাদের সময় গোপনে রনিকে একটি খুদেবার্তায় ধরা পড়ার বিষয়টি জানিয়েছিলেন জান্নাতুল মেহজাবিন। রনির সঙ্গে মেহজাবিনের ম্যাসেঞ্জারে বিভিন্ন সময়ের কথোপকথনের চ্যাট থেকে এর আগেও বিভিন্ন পরীক্ষায় প্রক্সি দেওয়ার বিষয়ে ইঙ্গিত পাওয়া গেছে।
মঙ্গলবার রাবির সত্যেন্দ্রনাথ বসু একাডেমিক ভবনে অনুষ্ঠিত ‘এ’ ইউনিটের গ্রুপ-২ এর ভর্তি পরীক্ষায় প্রক্সি দিতে এসে ধরা পড়ে বায়জিদ খান। পরে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা তাকে আটক করে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর দফতরে নিয়ে আসেন।
প্রক্টর দফতরে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে বায়জিদ জানান, তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফোকলোর বিভাগের ২০১৪-১৫ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী। তারা বাসা টাঙ্গাইলের মধুপুরে। জিজ্ঞাসাবাদের এক পর্যায়ে বায়জিদ বলেন, একই বিভাগের তার বন্ধু ও রাবির ছাত্রলীগ নেতা মুশফিক তাহমিদ তন্ময় তাকে প্রক্সির কাজ দিয়েছেন। তিনি প্রক্সি দিতে সকালে ক্যাম্পাসে এসেছিলেন। প্রক্সি দেওয়ার পূর্বে তিনি তার ব্যক্তিগত ফোন তন্ময়ের কাছে জমা রেখেছিলেন। জিজ্ঞাসাবাদের এই ভিডিওটি গণমাধ্যমকর্মীদের হাতে এসেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মুশফিক তাহমিদ তন্ময় বিশ্ববিদ্যালয়ের ফোকলোর বিভাগের ২০১৪-১৫ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী এবং রাবি শাখা ছাত্ররীগের সাংগঠনিক সম্পাদক। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের শাহ্ মখদুম হলে থাকেন। এর আগেও তার বিরুদ্ধে ভর্তি বাণিজ্য, সিট বাণিজ্যসহ রাবি ও রুয়েট ক্যাম্পাসে ইয়াবা ও মাদক পাচারের সিন্ডিকেটের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগ রয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে ছাত্রলীগ নেতা মুশফিক তাহমিদ তন্ময়কে একাধিকবার ফোন করা হলে তার মোবাইল ফোন বন্ধ পাওয়া যায়।
ভর্তি পরীক্ষায় প্রক্সির সঙ্গে ‘সম্পৃক্ততা’ থাকায় তন্ময়ের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে কিনা এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ফয়সাল আহমেদ রুনু বলেন, এ বিষয়টি আমরা শুনেছি। আমরা খুব দ্রুতই কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদকের সঙ্গে কথা বলে এ ঘটনায় প্রমাণ সাপেক্ষ তার বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করব।
কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের মুক্তিযুদ্ধ ও গবেষণা বিষয়ক সম্পাদক এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতা মেহেদী হাসান তাপস বলেন, এই বিষয়টি আমাকে কেউ জানায়নি। তবে সে যদি সত্যিকার অর্থে এমনটা করে থাকে তাহলে তার বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রক্টর অধ্যাপক আসাবুল হক বলেন, জালিয়াতির ঘটনায় অভিযুক্তদের পুলিশের কাছে সোপর্দ করা হয়েছে। অভিযুক্তদের একজন তন্ময় নামে একজনের কথা বলেছে। এ বিষয়ে আমরা প্রশাসনকে তদন্ত করতে অনুরোধ জানিয়েছি।
রাবির উপাচার্য অধ্যাপক গোলাম সাব্বির সাত্তার বলেন, আইন সব সময় আইনের গতিতেই চলবে। ভর্তি পরীক্ষায় জালিয়াতি চক্রের সঙ্গে যে বা যারা জড়িত, তাদের পরিচয় যতই শক্ত হোক না কেন, অপরাধ প্রমাণিত হলে তাকে শাস্তির আওতায় আনা হবে। বিশ্ববিদ্যালেয় প্রশাসন এবং গোয়ান্দা সংস্থা সর্বদা তৎপর রয়েছেন। আমাদের তদন্ত চলমান রয়েছে। আশা করছি খুব দ্রুত প্রমাণসাপেক্ষ অপরাধীদের আইনের আওতায় আনতে পারবো।
অপরদিকে বুধবার রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে (রাবি) ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষে স্নাতক প্রথম বর্ষের বাণিজ্য অনুষদভুক্ত ‘বি’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষার মধ্য দিয় শেষ হয়েছে এবারের ভর্তিযুদ্ধ। সকাল ৯ টায় ‘বি’ ইউনিটের গ্রুপ-১ এর পরীক্ষার মাধ্যমে এই ভর্তি পরীক্ষা শুরু হয়। বিকেল চারটায় গ্রুপ-৪ এর পরীক্ষার মধ্য দিয়ে সমাপ্তি ঘটে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংযোগ দফতর সূত্রে জানা গেছে, ‘বি’ ইউনিটে ৫৬০টি আসনের বিপরীতে চুড়ান্ত আবেদনকৃত পরীক্ষার্থীর সংখ্যা ৩৮ হাজার ৬২১ জন।
এদিকে সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশে ভর্তি পরীক্ষা সম্পন্ন হওয়ায় রাসিক মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটনসহ সংশ্লিষ্টদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি প্রফেসর গোলাম সাত্তার সাব্বির। বুধবার গণমাধ্যমে পাঠানা এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকর্মী, প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্টদের প্রতি এ কৃতজ্ঞতা জানান।


প্রকাশিত: জুলাই ২৮, ২০২২ | সময়: ৫:৫৯ পূর্বাহ্ণ | সুমন শেখ