নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতে বড় বাধা প্লাস্টিক

ঢাকা অফিস: আজ ২ ফেব্রুয়ারি, দেশব্যাপী পালিত হতে যাচ্ছে ‘জাতীয় নিরাপদ খাদ্য দিবস ২০২২’। নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করতে বরাবরই তাগিদ দিয়ে আসছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। জাতীয় নিরাপদ খাদ্য দিবস-২০২২ উপলক্ষে দেওয়া এক বাণীতে তিনি বলেন, ‘খাদ্যের উৎপাদন থেকে ভোক্তা পর্যন্ত প্রতিটি ধাপে খাদ্যের নিরাপত্তা ও পুষ্টিমান বজায় রাখা জরুরি। দেশের প্রতিটি মানুষ খাদ্য নিরাপত্তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। যিনি উৎপাদন প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত, তার যেমন সচেতনতা প্রয়োজন, তেমনই  যিনি ভোগ করবেন, তার ক্ষেত্রেও নিরাপত্তার বিষয়টি অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। তাই সরকারি-বেসরকারি সব প্রতিষ্ঠানকে একযোগে কাজ করতে হবে। ’ ২০২০ সালে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ একটি সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে জানায়, নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতে প্রণীত নিরাপদ খাদ্য আইন মেনে চলার জন্য ব্যবসায়ীদের প্রতি সতর্কতামূলক বিজ্ঞপ্তি জারি করেছে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ। খাদ্যস্পর্শক প্রবিধানমালা, ২০১৯ (এস,আর,ও নং ২৫৭-আইন/২০১৯ অনুযায়ী, খাবারের প্যাকেটে স্ট্যাপলারের পিন ব্যবহার করা যাবে না। ব্যবহার করলে সর্বনিম্ন জরিমানা ৩ লাখ টাকা। নির্দেশনার মধ্যে আরও  রয়েছে— খাদ্যস্পর্শক ও খাদ্যের মোড়ক উৎপাদনে ব্যবহৃত কাঁচামাল স্বাস্থ্যসম্মত ও যথাযথ মানসম্পন্ন (ফুড গ্রেড) হতে হবে, খাদ্যের মোড়ক/প্যাকেটে ধাতব স্ট্যাপলার/পিন/সেফটি পিন বা ধাতব বস্তু ব্যবহার করা যাবে না। ওই  খাদ্যের মোড়ক হিসেবে নিম্নমানের ও রিসাইকেল পলিথিন, পুরনো খবরের কাগজ অথবা লিখিত কাগজ ইত্যাদি ব্যবহার করা যাবে না। গরম খাবার/পানীয় পরিবেশনের ক্ষেত্রে নিম্নমানের ও রিসাইকেলড প্লাস্টিক কাপ/বক্স/পাত্র ব্যবহার করা যাবে না।

বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়,  জনস্বাস্থ্য সুরক্ষায় নিরাপদ খাদ্য আইন, ২০১৩ এবং এর অধীন প্রণীত বিধিমালাগুলো মেনে চলুন এবং স্বাস্থ্যসম্মত নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করুন। নিরাপদ খাদ্য আইন, ২০১৩ এর লঙ্ঘন শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এ শাস্তি সর্বোচ্চ পাঁচ  বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড, বা ২০ লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানা হতে পারে। তবে এই নির্দেশনার পরও বন্ধ হয়নি অনিয়ম। রাস্তার ধারে কিংবা অলি-গলিতে অবস্থিত রেস্তোরাঁর খাবার পার্সেলে অহরহ ব্যবহৃত হচ্ছে প্লাস্টিক। আবার খাবারের প্যাকেটে ব্যবহার করা হচ্ছে স্ট্যাপলারের পিন। দুটিই জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকারক বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।

গত বছর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা দেশীয় প্রজাতির ১৫ প্রজাতির মাছের মধ্যে ক্ষতিকারক প্লাস্টিক (মাইক্রো প্লাস্টিক) এর সন্ধান পেয়েছেন। কালিবাউশ, রুই, কই, বেলে, টেংরা, বাটা, তেলাপিয়া, কমন কার্প, পাবদা, পুঁটি, রয়না, শিলং, বাইম, টাটকিনি ও বাছা প্রজাতির মাছসহ কৃত্রিম উপায়ে মিষ্টি পানির জলাধারে চাষ করা মাছে এই নমুনা ধরা পড়েছে। গবেষণায় ব্যবহৃত মাছগুলো সাভার ও আশুলিয়া বাজার থেকে সংগ্রহ করা হয়। এ সব মাছে ৭৩ দশমিক ৩ শতাংশ ক্ষতিকারক প্লাস্টিকের কণা পাওয়া গেছে। গবেষণায় জানা যায়, টেংরা, টাটকিনি, রয়না বা মেনি মাছে প্লাস্টিকের পরিমাণ সবচেয়ে বেশি। এসব মাছে পলিপ্রপিলিন পলিথিলিন কপোলিমার, হাই ডেনসিটি পলিথিলিন ও ইথিলিন ভিনাইল এসিটেট প্লাস্টিক পলিমারের উপস্থিতি প্রমাণিত হয়েছে। গবেষকরা জানান, এসব প্লাস্টিক কণা সরাসরি খাদ্যের সঙ্গে মানুষের দেহে প্রবেশ করে না। তবে এগুলো থেকে নিঃসৃত বিষাক্ত রাসায়নিক মাছের দেহ বা মাসলে জমা হয়। পরে এসব মাছ খাবার হিসেবে গ্রহণ করলে মানুষের দেহে স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরির সক্ষমতা রাখে।

অপরদিকে, একই গবেষকরা খাবার লবণেও পেয়েছেন মাইক্রো প্লাস্টিক। তাদের গবেষণা নিবন্ধটি আন্তর্জাতিক জার্নাল ‘এনভায়রনমেন্টাল অ্যাডভান্সেসে  ‘প্রলিফেরেশন অব মাইক্রো-প্লাস্টিক ইন কমারশিয়াল সি-সল্ট ফ্রম দ্য ওয়ার্ল্ড লংগেস্ট সি-বিচ অব বাংলাদেশ’ নামে ১৫ জানুয়ারি প্রকাশিত হয়। গবেষণাটি পরিচালনা করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক শফি মুহাম্মদ তারেক, সহযোগী অধ্যাপক ড. ফাহমিদা পারভিন এবং একই বিভাগের স্নাতকোত্তর শ্রেণির শিক্ষার্থী জয়শ্রী নাথ ও তামান্না হোসেন।

গবেষণায় উল্লেখ করা হয়,২০২১ সালের  সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরে দেশের নামকরা ১০টি ব্র্যান্ডের লবণসহ ১৩টি স্যাম্পল বিভিন্ন সুপার মার্কেট ও স্থানীয় দোকান থেকে সংগ্রহ করে গবেষণা চালানো হয়। ব্র্যান্ডের ও ‘খোলা’ উভয় লবণে আণুবীক্ষণিক প্লাস্টিক পাওয়া গেছে।  ব্র্যান্ডের লবণের তুলনায় খোলা লবণে প্লাস্টিকের মাত্রা বেশি মিলেছে। গবেষণায় দেখা গেছে, বঙ্গোপসাগর থেকে বাণিজ্যিকভাবে তৈরি করা খাবার লবণে পলিস্টেরিন, ইথিলিন-ভিনাইল অ্যাসিটেট, পলিথিলিন, নাইলন, পলিথিলিন টেরেপথ্যালেট পাওয়া গেছে। এই আণুবীক্ষণিক প্লাস্টিকের মাত্রা বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় বেশি।

দেশে প্রতি কেজি সামুদ্রিক লবণে ৩৯০ থেকে ৭ হাজার ৪০০ আণুবীক্ষণিক প্লাস্টিক পাওয়া গেছে। এসব প্লাস্টিকের মধ্যে ৫৯ শতাংশ ফাইবার আকৃতির, ৩৫ শতাংশ খণ্ড-বিখণ্ড এবং ৩৮ শতাংশ স্বচ্ছ এবং ৩৫ শতাংশ নীল রঙের। বঙ্গোপসাগরে পর্যটকদের ফেলে যাওয়া প্লাস্টিক দ্রব্য, নিত্য ব্যবহার্য পণ্যে মাইক্রো এবং ন্যানো পর্যায়ের কিছু প্লাস্টিক থাকে— যা লবণে আণুবীক্ষণিক প্লাস্টিকের জন্য অধিক পরিমাণে দায়ী। মানবশরীরে আণুবীক্ষণিক প্লাস্টিক দীর্ঘদিন ধরে থাকে। এতে অন্যান্য ক্ষতিকর অণুজীব তার ওপর বাসা বাধার সুযোগ পায়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে এসব প্লাস্টিকের কণা থেকে ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ নির্গত হয়, যা হরমোনের সমস্যা সৃষ্টি এবং স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর অ্যাডভান্সড রিসার্চ ইন সায়েন্সেসের প্রধান বিজ্ঞানী ড. লতিফুল বারী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমাদের দেশে যেসব প্লাস্টিক ব্যবহার করা হয়, সেগুলো ফুডগ্রেড না। হিটের মাধ্যমেই মাইক্রো প্লাস্টিক খাবারের মধ্যে চলে আসতে পারে। কোনও গরম খাবার প্লাস্টিকের মধ্যে রাখলে দেখা যায় প্লাস্টিকের গায়ে কিছুটা পলিমার ছেড়ে দেয়। ঠাণ্ডা হয়ে গেলে আবার শক্ত হয়ে যায়। যখন লুজ হয় তখন পলিমার কম্পাউন্ড খাবারে চলে যেতে পারে।’

তিনি আরও বলেন, ‘কয়েকদিন আগে লবণের মধ্যে প্লাস্টিক পাওয়া গেছে। তার মানে আমরা কী পরিমাণ যে প্লাস্টিক ফেলি সাগরে! সমুদ্রের পানিতে তা ভেঙে ছোট ছোট কণা হয়ে গেছে। সেগুলো লবণের মাধ্যমে শরীরের যাচ্ছে। এটাও একটি উদ্বেগের বিষয়। মানুষকে তো সচেতন হতে হবে। তার সঙ্গে সচেতন হতে হবে, যারা খাদ্য সংরক্ষণ করেন তাদেরও। খাবার কোথায় রাখা যাবে, কোথায় রাখা যাবে না, সেটা জানতে হবে। তাদেরও জ্ঞানের অভাব আছে। আমাদের দেশে যেসব পাতলা প্লাস্টিক ব্যবহার করা হয়, সেগুলো থেকেও শরীরে যাওয়ার সম্ভাবনা অনেকাংশেই থাকে। ’

নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের সদস্য মো. রেজাউল করিম বলেন, ‘আমাদের দেশের একটা সংস্কৃতি আছে। সেটি একদিনে পরিবর্তন করা আসলে সম্ভব না, সময়ের প্রয়োজন হয়। মানুষের কাছে বার্তা পৌঁছাতে হয়, জানাতে হয়। এই জানানোর জন্য সময় দরকার, কৌশল, ব্যবস্থাপনা ও লোকবল দরকার। আমরা এসব বিষয়ে মাত্র কাজ শুরু করেছি। আমরা ধীরে ধীরে এগোচ্ছি। অনেক ক্ষেত্রে সফল হয়েছি, যেমন- টি ব্যাগে স্ট্যাপ্লারের পিন থেকে মোটামুটি বেরিয়ে আসতে চেষ্টা করছি। এখন অন্যান্য জায়গায় যারা খাদ্যের ব্যবসা করে, তাদের কিন্তু খাদ্য ব্যবসা সংক্রান্ত কোনও নিবন্ধনের ব্যবস্থা নেই। এটা আমাদের আইনে নেই। ফলে নিবন্ধনহীন অবস্থায় খাদ্য ব্যবসা চলছে। এটাকে নিবন্ধনের আওতায় আনতে পারলে, খাদ্য ব্যবসার সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের সেভাবে প্রশিক্ষণ দিয়ে ঠিক করা যেতে পারে। তাদেরকে প্রশিক্ষিত না করে গেলে নিরাপদ খাদ্য সহসা নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। কারণ, এটি একটি প্রতিনিয়ত পরিবর্তনশীল প্রক্রিয়া।’


প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ২, ২০২২ | সময়: ১২:০৫ অপরাহ্ণ | সুমন শেখ