এশিয়ায় সবচেয়ে ব্যয়বহুল হতে যাচ্ছে ঢাকার মেট্রোরেল ‘এমআরটি-৬’

ইন্দোনেশিয়ার জাকার্তা ও বাংলাদেশের ঢাকায় প্রায় একই সময়ে শুরু হয় প্রথম মেট্রোরেল নির্মাণ প্রকল্প। দুটি প্রকল্পেই অর্থায়ন করছে জাপান ইন্টারন্যাশনাল কোঅপারেশন এজেন্সি (জাইকা)। ২০১৯ সালের মার্চে জাকার্তার প্রথম মেট্রো ‘নর্থ-সাউথ’ চালু হলেও এখনো নির্মাণাধীন ঢাকার প্রথম মেট্রো ‘এমআরটি-৬’। ২০২৩ সালের শেষ নাগাদ ঢাকার মেট্রোটি চালুর লক্ষ্য সরকারের। অর্থায়নকারী সংস্থা এক হওয়া সত্ত্বেও বড় পার্থক্য রয়েছে মেট্রো দুটির নির্মাণ ব্যয়ে। জাকার্তার নর্থ-সাউথ লাইনের চেয়ে ঢাকার এমআরটি-৬-এর নির্মাণ ব্যয় দ্বিগুণেরও বেশি। এর মধ্যে আবার প্রায় ৫২ শতাংশ ব্যয় বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়েছে, যা অনুমোদন হলে জাকার্তার চেয়ে প্রায় তিন গুণ বেশি হবে ঢাকার প্রথম মেট্রোরেলের নির্মাণ ব্যয়। কিলোমিটারপ্রতি খরচ হবে প্রায় ২৩ কোটি ৪০ লাখ ডলার। আর এর মধ্য দিয়ে প্রথম মেট্রো নির্মাণের ক্ষেত্রে এশিয়ায় সবচেয়ে ব্যয়বহুল হয়ে উঠবে ঢাকার এমআরটি-৬।

ঢাকার প্রথম মেট্রো নির্মাণে এখন পর্যন্ত যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় হচ্ছে, তার তিন ভাগের এক ভাগ দিয়ে প্রথম মেট্রো তৈরি হয় ভারতের দিল্লিতে। ঢাকা এমআরটি-৬-এর অর্ধেকেরও কম খরচে লাহোরে প্রথম মেট্রো তৈরি করেছে পাকিস্তান। অন্যদিকে এশিয়া মহাদেশের মধ্যে সবচেয়ে কম খরচে প্রথম মেট্রো তৈরি করেছে চীন। দেশটির সাংহাই শহরের প্রথম মেট্রোটির নির্মাণ ব্যয় ঢাকার এমআরটি-৬-এর নির্মাণ ব্যয়ের পাঁচ ভাগের এক ভাগ। নির্মাণকাজ চলমান আছে এমন প্রকল্পগুলোর মধ্যে ভিয়েতনামের হ্যানয় শহরের ‘লাইন-২-এ’ ও হো চি মিন সিটির ‘এইচসিএমসি লাইন-১’র নির্মাণ ব্যয় ঢাকার এমআরটি-৬-এর তুলনায় অনেক কম।

প্রথমবার মেট্রো নির্মাণে এখন পর্যন্ত এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে ব্যয়বহুল সিঙ্গাপুরের নর্থ-সাউথ লাইন। লাইনটির প্রায় ছয় কিলোমিটারের প্রথম অংশটি তৈরি হয়েছিল ১৯৮৩ থেকে ১৯৮৭ সালের মধ্যে। সে সময় মেট্রোটি তৈরি করতে খরচ হয়েছিল ৩৭ কোটি ৮৪ লাখ ডলার। তখন ১ সিঙ্গাপুর ডলারের বিপরীতে ডলারের মান ছিল দশমিক ৪৭। ২০১৯ সালে ১ সিঙ্গাপুর ডলারের বিপরীতে মার্কিন ডলারের মান বেড়ে দাঁড়ায় দশমিক ৭৪। ২০১৯ সালের ডলারের মান অনুযায়ী সিঙ্গাপুরে প্রথম মেট্রোটি তৈরিতে খরচ হয় প্রায় ৯৭ কোটি ৭৩ লাখ ডলার। কিলোমিটারপ্রতি খরচ হয় ১৬ কোটি ৫৬ লাখ ডলার।

আর এখন পর্যন্ত নির্মাণ ব্যয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে ঢাকার এমআরটি-৬। লাইনটি তৈরি হচ্ছে উত্তরা-মতিঝিলের মধ্যে  ২০১২ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে বাস্তবায়নের মেয়াদ ধরে পাস হয় ঢাকার প্রথম মেট্রো নির্মাণ প্রকল্প। বাংলাদেশী টাকায় নির্মাণ ব্যয় প্রাক্কলন করা হয় ২১ হাজার ৯৮৫ কোটি টাকা। ২০১৩ সালে টাকার বিপরীতে ডলারের মান অনুযায়ী এই ব্যয় ছিল ২৮০ কোটি ডলার। পরের ছয় বছরে টাকার বিপরীতে ধারাবাহিকভাবে বেড়েছে ডলারের মান। ২০১৯ সালের হিসাবে মেট্রোটির নির্মাণ ব্যয় দাঁড়ায় ৩০৯ কোটি ডলার। প্রতি কিলোমিটারের নির্মাণ ব্যয় দাঁড়ায় ১৫ কোটি ৩৮ লাখ ডলারে। সম্প্রতি মন্ত্রণালয়ে পাঠানো ব্যয় বৃদ্ধির প্রস্তাবটি অনুমোদন হলে লাইনটির কিলোমিটারপ্রতি নির্মাণ ব্যয় বেড়ে দাঁড়াবে প্রায় ২৩ কোটি ৪০ লাখ ডলার।

নির্মাণ ব্যয়ের দিক দিয়ে বাংলাদেশের প্রকল্প শীর্ষে চলে আসার বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, নির্মাণ ব্যয় বেশি হচ্ছে, এমন কথা উঠলে দায়িত্বশীল ব্যক্তি ভূমি অধিগ্রহণ, ক্ষতিপূরণ, ভ্যাট-ট্যাক্সসহ নানা খাতের ব্যয়ের যুক্তি দেখান। যদি এসব বিবেচনায় নেয়া হয় তার পরও নির্মাণ ব্যয়টা তুলনীয় পর্যায়ে আসবে না। বাংলাদেশে অবকাঠামো উন্নয়নে নির্মাণ ব্যয় বেশি হওয়ার পেছনে অনেকগুলো কারণ কাজ করে। এর অন্যতম হলো প্রকল্পের ডিপিপি সঠিকভাবে প্রণয়ন না করা। ফলে কাজ শুরুর পর নকশায় সমস্যা দেখা দেয়। এমন কিছু অঙ্গ যুক্ত করার প্রয়োজন হয়, যা ডিপিপিতে ধরা হয়নি। প্রকল্প বাস্তবায়নে ধীরগতিও ব্যয় বৃদ্ধির আরেকটি বড় কারণ। আবার যেসব কর্মকর্তার কারণে এ জটিলতাগুলো হয়, তাদের কারো কাছে সেভাবে জবাবদিহিও করতে হয় না।

ঢাকার এমআরটি-৬-এর ডিপিপির সংশোধনী প্রস্তাবেও অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমানের মন্তব্যের প্রতিফলন ঘটেছে। সম্প্রতি এ প্রস্তাব সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে মেট্রোটির নির্মাণকারী কর্তৃপক্ষ ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল)। ২১ হাজার ৯৮৫ কোটি থেকে বাড়িয়ে নির্মাণ ব্যয় প্রস্তাব করা হয়েছে ৩৩ হাজার ৪৭২ কোটি টাকা। ডিএমটিসিএলের তথ্যানুযায়ী, বর্ধিত টাকার একটা বড় অংশ খরচ হবে মতিঝিল থেকে কমলাপুর পর্যন্ত মেট্রোরেল সম্প্রসারণের কাজে, যা শুরুতে পরিকল্পনায় ছিল না। পাশাপাশি উত্তরা সেন্টার স্টেশনকে কেন্দ্র করে একটি ট্রান্সপোর্ট ওরিয়েন্টেড হাব (টিওডি) নির্মাণ, স্টেশন প্লাজাসহ বিভিন্ন অবকাঠামো তৈরির জন্য নতুন করে জমি অধিগ্রহণসহ বিভিন্ন খাতে খরচ করা হবে এ টাকা। এসব পরিকল্পনাও ছিল না প্রকল্পটির মূল ডিপিপিতে।

ঢাকার প্রথম মেট্রো নির্মাণে এ ব্যয় বৃদ্ধি সম্পর্কে জানতে ডিএমটিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এমএএন ছিদ্দিকের সেলফোনে একাধিকবার কল ও মন্তব্য চেয়ে ক্ষুদে বার্তা পাঠালেও তিনি কোনো জবাব দেননি।তবে সংস্থাটির একাধিক কর্মকর্তা অন্যান্য দেশের চেয়ে বাংলাদেশে মেট্রোরেল নির্মাণের ব্যয় বেশির পেছনে সিডি ও ভ্যাট খাতকে অন্যতম কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তারা বলছেন, প্রকল্প ব্যয়ের একটা বড় অংশ চলে যায় বিভিন্ন পণ্য, নির্মাণসামগ্রী ও সেবা ক্রয় বাবদ সরকারকে শুল্ক-কর দিতে গিয়ে। এর বাইরে জমি অধিগ্রহণের পেছনেও একটা বড় ব্যয় হয়। নির্মাণাধীন এমআরটি-৬-এর উদাহরণ দিয়ে তারা বলেন, সংশোধিত ডিপিপির প্রস্তাব অনুযায়ী, প্রকল্পটির মোট ব্যয়ের প্রায় ২৩ শতাংশই খরচ হচ্ছে শুল্ক-কর ও জমি অধিগ্রহণ খাতে। এসব খাতের ব্যয় প্রকল্পটির সার্বিক ব্যয় বাড়িয়ে দিয়েছে বলে জানিয়েছেন তারা।

তবে পরিবহন বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. সামছুল হক বলছেন ভিন্ন কথা। তিনি বাংলাদেশে মেট্রোরেলের মতো প্রকল্প বাস্তবায়নে নির্মাণ ব্যয় বেশি হওয়ার জন্য ব্যবস্থাপনা ও পরিকল্পনার ত্রুটির কথা বলছেন। তিনি বলেন, গত বছর জাকার্তার মেট্রোটি চালু হয়ে গেলেও আমাদেরটির কাজ এখনো অনেক বাকি। দাতা সংস্থা এক হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশে সঠিক ব্যবস্থাপনা আর পরিকল্পনা না থাকায় আমাদের প্রথম মেট্রোটি এখনো চালু করতে পারিনি। অদূরদর্শী পরিকল্পনা এবং বাস্তবায়নে ধীরগতির খেসারত দিতে হচ্ছে নির্মাণ ব্যয় বৃদ্ধির মাধ্যমে।

ঢাকা মেট্রোরেল নির্মাণ প্রকল্পের ব্যয় বৃদ্ধির প্রস্তাব সম্পর্কে জানতে চাইলে পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম বলেন, এখন পর্যন্ত ঢাকা মেট্রোরেল প্রকল্পের ব্যয় বৃদ্ধির প্রস্তাব আমরা পাইনি। প্রস্তাব মন্ত্রণালয়ে এলে যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।


প্রকাশিত: জানুয়ারি ১৫, ২০২২ | সময়: ৪:১৫ অপরাহ্ণ | সুমন শেখ