সর্বশেষ সংবাদ :

আরডিএ’র দুর্নীতি-অবহেলা: এক যুগে অর্ধশত কোটি টাকার রাজস্ব বঞ্চিত সরকার 

স্টাফ রিপোর্টার : 
রাজশাহীতে নগরায়ণ ও সরকারের রাজস্ব বৃদ্ধির লক্ষ্যে ১৩ বছর পূর্বে পিপিপি পদ্ধতির আদলে নগরীর ৯টি স্থানে বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণ করে রাজশাহী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (আরডিএ)। বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণ ও দোকান বরাদ্দ দিয়ে সরকারের ঘরে বিপুল রাজস্ব উত্তোলনের সম্ভবনা থাকা সত্ত্বেও পরবর্তীতে আরডিএ’র উর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের দুর্নীতি ও অবহেলার কারণে প্রায় এক যুগে অর্ধশত কোটি টাকার রাজস্ব বঞ্চিত হয়েছে সরকার। অদ্যবধি কর্মকর্তাদের উদাসীনতা ও অবহেলায় অধিকাংশ ভবন পরিত্যাক্ত থাকায় মাদকাসক্ত ও জুয়াড়িদের আড্ডাখানায় পরিণত হয়েছে।

 

সূত্র জানায়, আরডিএ কর্তৃপক্ষের উদ্যোগে রাজশাহীর উন্নয়ন ও সরকারের রাজস্ব বৃদ্ধির লক্ষ্যে ২০০৯ সালে তৎকালীন চেয়ারম্যান তপন চন্দ্র মজুমদার একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ নেন। সিদ্ধান্ত হয়- সরকার তার নিজ অর্থ খরচ ব্যতীতই পুরনো এবং পরিত্যক্ত জায়গায় নগরায়ণ করবে এবং সরকারি রাজস্ব বাড়াবে। এই কাজটি সম্পন্ন হবে দ্বিতীয় পক্ষ অর্থাৎ, ঠিকাদারের মাধ্যমে (পিপিপি পদ্ধতি)। ঠিকাদার নিজ অর্থায়নে আরডিএ কর্তৃক সরকারিভাবে দরপত্র আহব্বানের মাধ্যমে বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণ করবেন। বিনিময়ে ঠিকাদার পাবেন ওই ভবনের বাণিজ্যিকভাবে গড়ে তোলা দোকানগুলোর সালামির অর্থ (সরকারিভাবে নির্ধারিত)। এভাবে ২০০৯ সালের পর থেকে বাণিজ্যিকভাবে নির্মাণ করা ভবনের কাজে নিযুক্ত ঠিকাদারগণ অনেকটায় বিপদগ্রস্ত হন।

 

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রতি স্কয়ার ফুট বাবদ আরডিএ’র প্রতিটি দোকানে নির্ধারিত ভাড়া ৩ টাকা। তিন বছর অন্তর অন্তর ভাড়া বৃদ্ধি পায় শতকরা ১৫ ভাগ। সেক্ষেত্রে শতকরা ১৫ ভাগ ছাড়াই প্রায় এক যুগে ৯টি মার্কেটের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে ১৩ কোটি ১৪ লাখ ২৯ হাজার ৫৯৪ টাকা। অন্যদিকে, চার দফায় শতকরা ১৫ ভাগ ভাড়া বৃদ্ধি বাবদ সরকার রাজস্ব হারিয়েছে ৭ কোটি ৮৮ লাখ ৫৭ হাজার ৭৫৬ টাকা। এছাড়াও অনির্মিত দোকান, বরাদ্দ না দেওয়া, দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি সহ নানা অনিয়ম, অবহেলা ও উদাসীনতার কারণে আরও ২৫-৩০ কোটি রাজস্ব উত্তোলন হয়নি। সংশ্লিষ্টদের ভাষ্য, সবমিলিয়ে এক যুগে প্রায় অর্ধশত কোটি টাকারও বেশি রাজস্ব হারিয়েছে সরকার। কর্তৃপক্ষের এমন উদাসীনতার কারণে আরডিএ’র শিরোইল পূবালী মার্কেট, গৌধূলী মার্কেট, নওদাপাড়া টার্মিনাল ভিআইপি কাউন্টার মার্কেট, আন্তঃজেলা সুপার টার্মিনাল মার্কেট ও চন্দ্রিমায় মহানন্দা মার্কেটগুলো পরিত্যাক্ত থাকায় মাদক ও জুয়ার ওপেন আড্ডাখানায় পরিণত হয়েছে। খোদ চেয়ারম্যানের বাড়ির সামনেই যে পূবালী ও গৌধূলী মার্কেট রয়েছে তাতেও চলে জুয়া ও মাদকের আড্ডা। এসব দেখার পরও সয়ং চেয়ারম্যানই উদাসীন।

 

আরডিএ’র শিরোইল কাঁচাবাজার পূবালী মার্কেট নির্মাণ করেছেন ঠিকাদার জহির হোসেন। জানতে চাইলে তিনি বলেন, ভবন নির্মাণে কোটি টাকা খরচ করে পড়েছি বিপাকে। কাজ করেও বরাদ্দ পাচ্ছি না। কয়েকজন ঠিকাদার ও ব্যবসায়ীগণ যথসামান্য বরাদ্দ পেলেও তাতে আরডিএ’র কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের কাছে গুনতে হয়েছে অতিরিক্ত অর্থ। পরবর্তীতে এমন দুর্নীতি ও বরাদ্দহীনতার কারণে মুখ ফিরিয়ে নিতে হয়েছে কাজ থেকে। এসব কারণে শুধু আমিই নই, সকল ঠিকাদারই বাকি নির্মাণ কাজ বন্ধ করে দিয়েছেন। এসব কারণে সরকার ব্যাপক রাজস্ব থেকে বঞ্চিতও হচ্ছে।

 

 

শুধু তা-ই নয়, সাধারণ ব্যবসায়ীগণ আরডিএ’র নির্মিত দোকান বরাদ্দে যে আবেদন করেছেন ও অর্থ জমা দিয়েছেন তাতেও নানা হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে ব্যবসায়ীদের।

 

ভবন নির্মাণের সাথে যুক্ত ঠিকাদার, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ও সরেজমিন পরিদর্শনে পাওয়া তথ্যে জানা গেছে, ২০০৯ সালে আরডিএ কর্তৃপক্ষ নগরীর সাহেব বাজারে ৭তলা বিশিষ্ট দক্ষিণ ছাউনি মার্কেট নির্মাণের অনুমতি দেয়। মার্কেটটি নির্মাণ হয় ৪তলা। মার্কেটটির নিমার্ণ করেন ঠিকাদার ইফতেখার হাফিজ খান। সর্বমোট আয়তন ১ লক্ষ ১০ হাজার বর্গফুট। তবে নির্মিত ৪তলার আয়তন ৬২ হাজার ৮৫৮ বর্গফুট। বাকি ৩তলার কাজ পরবর্তীতে কর্তৃপক্ষের অবহেলার কারণে বন্ধ হয়ে যায়। এতে আরডিএ মাসিক রাজস্ব হারা”েছ এক লাখ ৮৮ হাজার ৫৭৪ টাকা এবং ১৩ বছরে আরডিএ তথা সরকার রাজস্ব হারাচ্ছে ২ কোটি ৯৪ লাখ ১৭ হাজার ৫৯৪ টাকা। অন্যদিকে ২০০৯ সালে সাহেব বাজার আরডিএ দক্ষিণ ছাউনি ফুটপাতের ওপর নির্মিত হয় ৫তলার একটি বাণিজ্যিক ভবন। মার্কেটটির প্রতি ফ্লোর (তিন দিকে) ৬ হাজার বর্গফুট। সে হিসেবে ৫তলার মার্কেটটির আয়তন দাঁড়ায় সর্বমোট ৩০ হাজার বর্গফুট। দোকান বরাদ্দ না হওয়ায় ও জবরদখল হওয়ায় প্রতি মাসে ৯০ হাজার টাকা রাজস্ব বঞ্চিত হচ্ছে সরকার। সেক্ষেত্রে ২০০৯ সালে নির্মিত এই মার্কেট থেকে সরকার রাজস্ব হারিয়েছে প্রায় ১ কোটি ৮০ লক্ষ টাকা। নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান ছিলেন আরডিএ কর্তৃক নিয়োগকৃত সাধারণ ব্যবসায়ী সমিতির পক্ষে ক্লাইমেক্স ইনডাসট্রি লিমিটেড।

 

২০১২ সালে আরডিএ মার্কেটের ছোট-টিন, বড়-টিন ও ক্রোকারিজ ব্লকের চারতলা ভবনটি নির্মাণ হয়। এর আয়তন ৪২ হাজার বর্গফুট। এই ভবনটির মাসিক ক্ষতি হচ্ছে প্রায় ১ লক্ষ ২৬ হাজার টাকা। সেক্ষেত্রে ১০ বছরে রাজস্ব হারিয়েছে প্রায় ১ কোটি ৯৬ লক্ষ ৫৬ হাজার টাকা। ভবনটির নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান রাশেদুল ইসলাম টুলু। ২০১০ সালে শিরোইল কাঁচাবাজারে নির্মিত ২৭ হাজার স্কয়ার ফুটের ৪তলা বিশিষ্ট গৌধুলী মার্কেট। আরডিএর অযত্ন অবহেলায় ভবনটির ৩ ও ৪তলা পরিত্যাক্ত প্রায়। প্রতি মাসে এ ভবনটির রাজস্ব হারা”েছ ৫৪ হাজার টাকা এবং ১৩ বছরে ৮৪ লক্ষ ২৪ হাজার টাকার রাজস্ব হারিয়েছে সরকার। ভবনটির নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান শফিকুল আওয়াল খান।

 

২০১০ সালে শিরোইল কাঁচাবাজারের আরেকটি নির্মিত ২২ হাজার স্কয়ার ফুটের ৪তলা বিশিষ্ট পূবালী মার্কেট। ৩তলা হয়েছে, বাকি এক তলা হয়নি। এভবন থেকে প্রতি মাসে রাজস্ব হারাচ্ছে ৬৭ হাজার টাকা। ১৩ বছরে সরকার রাজস্ব হারিয়েছে প্রায় ১ কোটি ৪ লাখ ৫২ হাজার টাকা। নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান শফিকুল আওয়াল খান। ২০১২ সালে চন্দ্রিমা থানাধীন নির্মিত চার হাজার স্কয়ার ফুটের ৬তলা বিশিষ্ট মহানন্দা আবাসিক সুপার মার্কেট। ৪তলা পর্যন্ত নির্মাণ হয়। প্রতি মাসে রাজস্ব হারাচ্ছে ৬০ হাজার টাকা। ১০ বছরে রাজস্ব হারিয়েছে প্রায় ৭২ লাখ টাকা। নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান মঞ্জুর রহমান পিটার।

 

 

২০১২ সালে নওদাপাড়ায় নির্মিত হয় ৫৬ হাজার স্কয়ার ফুটের ২তলা বিশিষ্ট আন্তজেলা বাস টার্মিনাল সুপার মার্কেট। প্রতি মাসে রাজস্ব হারা”েছ ১ লাখ ৯৬ হাজার টাকা। সেক্ষেত্রে ১০ বছরে রাজস্ব হারিয়েছে প্রায় ১ কোটি ৯৬ লাখ ৮০ হাজার টাকা। নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান ক্লাইমেক্স ইন্ডাস্ট্রি লিমিটেড। ২০১২ সালে নির্মিত হয় ২২ হাজার স্কয়ার ফুটের ৪তলা বিশিষ্ট আন্তজেলা বাস টার্মিনাল সুপার মার্কেটের ডি ব্লক। ৪তলার মধ্যে মাত্র ১তলা নির্মাণ হয়েছে। প্রতি মাসে রাজস্ব হারাচ্ছে ৬৭ হাজার টাকা। ১০ বছরে রাজস্ব হারিয়েছে প্রায় ৮০ লাখ ৪০ হাজার টাকা। নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান ক্লাইমেক্স ইন্ডাস্ট্রি লিমিটেড। ২০১২ সালে নওদাপাড়ায় আন্তজেলা বাস টার্মিনাল ভিআইপি কাউন্টার মার্কেট। ১১ হাজার স্কয়ার ফিটের ৪তলা বিশিষ্ট মার্কেটের মধ্যে নির্মাণ হয় দুই তলা। প্রতি মাসে রাজস্ব হারা”েছ ৮৮ হাজার টাকা। সেক্ষেত্রে ১০ বছরে রাজস্ব হারিয়েছে প্রায় ১ কোটি ৫ লাখ ৬০ হাজার টাকা। নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান কামাল হোসেন রবি।

 

অভিযোগকারী কয়েকজন ঠিকাদার জানান, নির্মাণ কাজ বন্ধ রাখা, বরাদ্দ না দেওয়া এবং রাজস্ব আদায়ের উদ্যোগ না নেওয়ার নেপথ্যে রয়েছেন সাবেক চেয়ারম্যান আব্দুস সামাদ, আব্দুর রহিম, বীর মুক্তিযোদ্ধা বজলুর রহমান এবং বর্তমান চেয়ারম্যান আনওয়ার হোসেন, প্রকৌশল শাখার তত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আব্দুল্লাহ হিল তারেক, সহকারী প্রকৌশলী শেখ কামরুজ্জামান (তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত), উপসহকারী প্রকৌশলী আবুল কাশেম, উপসহকারী প্রকৌশলী আসাদুজ্জামান। তবে সম্প্রতি অভিযোগ উঠেছে, আরডিএ মার্কেটের দক্ষিণ ছাউনিতে প্রায় ১৭টি দোকান গোপনে যোগসাজসে বরাদ্দের প্রক্রিয়ায় রয়েছেন বর্তমান এক এষ্টেট অফিসার ও সাবেক চেয়ারম্যান আনওয়ার হোসেন।

 

আরডিএ’র ৯টি দোকানে রাজস্ব আদায়ে অবহেলা ও দুর্নীতির বিষয়টি প্রতিবেদকের কাছে স্বীকার করেছিলেন সাবেক চেয়ারম্যান মো. আনওয়ার হোসেন (অতিরিক্ত সচিব)। তবে দোকান বরাদ্দে দুর্নীতির বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি কথা বলতে অস্বীকৃতি জানান।

 

আরডিএ’র ৯টি নির্মাণাধীন বাণিজ্যিক ভবন থেকে এ যাবতকালে মোট কত টাকার রাজস্ব আদায় হয়েছে? তা জানতে চাওয়া হয় প্রতিষ্ঠানটির এষ্টেট অফিসার মো. বরুজ্জামানের কাছে। তিনি তথ্য প্রদানে অস্বীকৃতি জানিয়ে বলেন, ‘এব্যাপারে আমি কিছুই বলতে পারবো না। আমার সাথে কথা বলার এখতিয়ার আপনার নাই। আমার সাথে কথা বলতে হলে আপনাকে চেয়ারম্যান স্যারের অনুমতি নিয়ে কথা বলতে হবে।’ এদিকে আরডিএ’র প্রশাসনিক কর্মকর্তা মো. কামাল উদ্দিনও অপরাগতা প্রকাশ করেন তথ্য দিতে।

 

আরডিএ’র বাণিজ্যিক ভবনগুলোর দূর্নীতি ও অবহেলার কথা স্বীকার করে চেয়ারম্যানের বলেন, ‘আরডিএ-তে যোগদান করা খুব বেশি দিন হয়নি। আর এসব একদিনের সমস্যা না। এগুলো ৫০ বছরের সমস্যা। এগুলো নিয়ে আমরা ইতিমধ্যেই কাজ শুরু করেছি। ধীরে ধীরে এসব সমস্যার সমাধান হবে। তবে রাজস্ব উঠছে না একথা একেবারে সত্য না। কিছু রাজস্ব আদায় হচ্ছে। বাকি সমস্যার সমাধান হয়ে গেলে তা আরও বৃদ্ধি পাবে’।

সানশাইন / শামি

 


প্রকাশিত: মার্চ ২১, ২০২৪ | সময়: ৯:৪৩ অপরাহ্ণ | Daily Sunshine