‘দৌড়ের ওপর’ বিএনপির লাখো নেতাকর্মী

সানশাইন ডেস্ক: দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বাকি মাত্র তিন মাস। এ সময় নির্বাচনী আমেজের মধ্যেই থাকার কথা সব রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের। অতীতে নির্বাচনের চার-পাঁচ মাস আগে থেকেই সম্ভাব্য প্রার্থীদের পদচারণায় মুখর থাকত জনপদ। তবে এবারের চিত্র অনেকটাই ভিন্ন। ক্ষমতাসীন দলের সম্ভাব্য প্রার্থীরা নির্বাচনী এলাকায় নানাভাবে গণসংযোগ চালিয়ে গেলেও, প্রধান ‘বিরোধী দল’ বিএনপি নেতাকর্মীরা আছেন অনেকটা ‘দৌড়ের’ মধ্যে।
বিএনপি নেতাকর্মীদের বেশিরভাগেরই প্রতিদিনের রোজনামচা আদালতের বারান্দা, এজলাস কিংবা আইনজীবীর কক্ষ। এদের কর্মদিবসের শুরুটাই হয় আদালতপাড়ায়। দলের শীর্ষ নেতা থেকে তৃণমূল– সবার একই অবস্থা। প্রত্যেকের বিরুদ্ধেই রয়েছে ডজন ডজন মামলা। এমনকি, অনেক নেতার বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে শত শত।
স্বাধীনতার পর দেশের বড় কোনও রাজনৈতিক দলের মহাসচিবের বিরুদ্ধে মামলাতেও ‘রেকর্ড’ হয়েছে। বর্তমানে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বিরুদ্ধেই মামলা রয়েছে ৯৩টি। আর সর্বোচ্চ ৪৫১টি মামলা হয়েছে দলের যুগ্ম মহাসচিব হাবিব-উন-নবী খান সোহেলের বিরুদ্ধে। এসব মামলায় কারও শুনানি শেষ পর্যায়ে, আবার কারও কেবল শুরু হয়েছে। কেউ আসছেন জামিন নিতে, আবার কেউ হাজিরা দিতে। এভাবেই দিনের পুরোটা সময় আদালত প্রাঙ্গণে কাটাতে হয় বিভিন্ন স্তরের বিএনপি নেতাকর্মীদের।
মামলা-আদালত, এসবের পেছনে সময় দিতে গিয়ে নেতাকর্মীরা রাজনৈতিক কর্মসূচিতে অংশ নিতে যেমন পারছেন না, তেমনি এর প্রভাব পড়ছে তাদের ব্যক্তিজীবনেও। সময় দিতে পারছেন না চাকরি-ব্যবসা ও পরিবার-পরিজনকে। সারাদেশে মামলা মাথায় নিয়ে গ্রেপ্তার এড়াতে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মী। আবার অনেকেই ইতোমধ্যে কারাগারে জীবন কাটাচ্ছেন।
সম্প্রতি বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে করা মিথ্যা ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপূর্ণ পুরনো-নতুন অনেক মামলা নিয়ে মাঠে নেমেছে সরকার। আগামী নির্বাচনের আগে কীভাবে এ মামলাগুলো দ্রুত শেষ করে বিএনপি নেতাদের সাজা দিয়ে কারাগারে পাঠানো যায়-সরকার সেই অপকৌশল নিয়েছে।
বিএনপি মহাসচিব বলেন, সরকার অনেক গুরুত্বপূর্ণ মামলার ব্যাপারে নির্বিকার। চাঞ্চল্যকর সাগর-রুনীর মামলার কোনও কূল-কিনারা করতে তাদের আগ্রহ নেই। অথচ রাজনৈতিক প্রতিহিংসামূলক মামলার ব্যাপারে তারা অনেক বেশি উৎসাহী। যার ফলে দেশের আইনসহ সার্বিক পরিস্থিতি দিন দিন জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে। বিচার বিভাগ, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী ও অন্যান্য বাহিনী কেবল সরকারের আজ্ঞাবহ হয়ে কাজ করছে।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুলের এসব অভিযোগ অস্বীকার করে সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, দেশের কোনও নাগরিক আইনের ঊর্ধ্বে নয়। অপরাধ করলে তার বিচার হবেই। আইন তার নিজস্ব গতিতে চলছে। অপরাধ করে পার পাওয়ার কোনও সুযোগ নেই। বিগত দুটি (২০১৪ ও ২০১৮) জাতীয় নির্বাচনের আগে বিএনপি মানুষ হত্যা, অগ্নিসন্ত্রাস, গাড়ি ভাঙচুর করেছিল- বর্তমানে সেসব মামলার বিচার কার্যক্রম চলছে। এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া। এখানে রাজনৈতিক কোনও উদ্দেশ্য নেই।
বিএনপির বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মীরা অভিযোগ করে বলেন, সরকার বিরোধী দলের আন্দোলন দমন করতে এবং একতরফা নির্বাচন করে আবারও ক্ষমতায় আসতে সরকার প্রতিবারের মতো এবারও রাজনৈতিক মিথ্যা মামলাকে বেছে নিয়েছে। বিএনপি রাজপথের সরকার পতনের যে শক্ত আন্দোলন গড়ে তুলেছে, তা ব্যাহত করতে নেতাকর্মীদের বিভিন্ন রকমের মামলা দিয়ে আদালতপাড়ায় ব্যস্ত রাখা হচ্ছে। অনেক মামলায় মৃত, প্রবাসী, অসুস্থ আর বয়োবৃদ্ধদেরও আসামি করা হয়েছে। বেছে বেছে দলের সক্রিয় নেতাদের টার্গেট করে তাদের বিরুদ্ধে প্রতিদিনই বেশি করে মামলা দেওয়া হচ্ছে। আবার পুরনো মামলাগুলোকেও সক্রিয় করা হয়েছে। অনেক মামলার কার্যক্রম দ্রুত এগিয়ে আনা হয়েছে। সরকারের এ পরিকল্পনা ঠিক থাকলে এক-দুই মাসের মধ্যে বেশ কিছু মামলায় নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে ফরমায়েশি সাজার রায় দেওয়া হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন এসব নেতাকর্মীরা।
অপরদিকে, বিএনপির মিডিয়া উইং ও দলটির দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকে সারাদেশে দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে ১ লাখ ৪১ হাজার ৯৩৪ মামলা করা হয়েছে। যেসব মামলায় ৪৯ লাখ ৪০ হাজার ৪৯২ জন নেতাকর্মীকে আসামি করা হয়েছে।
বিএনপির হিসাব বলছে, চলতি বছরের ২৮ ও ২৯ জুলাই ঢাকায় মহাসমাবেশ ও রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ পাঁচ প্রবেশমুখে অবস্থান কর্মসূচিসহ বিভিন্ন সময়ের কর্মসূচি ঘিরে সারাদেশে ৩৩১টি মামলা হয়েছে। এতে আসামি করা হয়েছে ১৩ হাজার ৯৩০ জনকে। আর গ্রেপ্তার করা হয়েছে ১ হাজার ৬৫০ জনকে।
মামলা বিষয়ে বিএনপির আইনবিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার কায়সার কামাল বলেন, গত ছয় মাসে ৫০ হাজার নেতাকর্মী হাইকোর্ট থেকে আগাম জামিন নিয়েছেন। তবে এর মধ্যে যেসব নেতাকর্মী কারাগারে রয়েছেন, জামিন নেওয়ার পরও এসব নেতাকর্মীদের মুক্তি মিলছে না। উপরন্তু প্রতিদিনই মামলার সংখ্যা বাড়ছে। সারাদেশে আমাদের দলের যেসব নেতাকর্মীরা রাজপথে আন্দোলনে সক্রিয়, বেছে বেছে তাদেরই গ্রেপ্তার করা হচ্ছে।
বিএনপির একাধিক কেন্দ্রীয় নেতা অভিযোগ করে বলেছেন, আমাদের নেতাকর্মীদের বেকায়দায় ফেলতে, নির্বাচনের আগে তাদের ইনঅ্যাকটিভ করতে, ভয় দেখাতে এবং আপসরফায় বাধ্য করতেই পুরনো এসব মামলাকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে সরকার। তাদের একতরফা নির্বাচনে অংশ না নিলে আমাদের দলের অনেক নেতাকেই কারাগারে যেতে হতে পারে।
বিএনপির দলীয় সূত্র মতে, দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফের বিরুদ্ধে ৭টি, ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকারের বিরুদ্ধে ৪টি, মির্জা আব্বাসের বিরুদ্ধে ৪৮টি, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়ের বিরুদ্ধে ৩৬টি, নজরুল ইসলাম খানের বিরুদ্ধে ৬টি, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীর বিরুদ্ধে ৬টি, ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকুর বিরুদ্ধে ৯টি, সেলিমা রহমানের বিরুদ্ধে ৪টি ও সালাহউদ্দিন আহমেদের বিরুদ্ধে ৬টি মামলা রয়েছে।
যুবদল সভাপতি সুলতান সালাহউদ্দিন টুকুর বিরুদ্ধে ৩১৩টি, যুবদলের সাবেক সভাপতি সাইফুল আলম নিরবের নামে ৩০৫টি, বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলালের বিরুদ্ধে ২৫৪টি, ভাইস চেয়ারম্যান বরকত উল্লাহ বুলুর বিরুদ্ধে ২০৪টি, সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীর বিরুদ্ধে ১৮০টি, নির্বাহী কমিটির সদস্য শেখ রবিউল আলম রবির বিরুদ্ধে ১৮৪টি, স্বেচ্ছাসেবক দলের সাধারণ সম্পাদক রাজিব আহসানের বিরুদ্ধে ১৪৭টি, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আমান উল্লাহ আমানের বিরুদ্ধে ১০৬টি, নির্বাহী কমিটির সদস্য আকরামুল হাসানের বিরুদ্ধে ১০৩টি মামলা রয়েছে। এসব মামলার পাশাপাশি এখনও প্রতিদিনই নতুন করে অনেকের বিরুদ্ধে মামলা হচ্ছে।
এ ছাড়াও, জেলা পর্যায়ে বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে হাজার হাজার মামলা রয়েছে। যাদের বিরুদ্ধে এসব মামলা রয়েছে তারা হলেন- ময়মনসিংহ উত্তর জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক মোতাহার হোসেন তালুকদার। যার বিরুদ্ধে ২১টি মামলা ছিল আগেই। গত কয়েক দিনে আরও নতুন ৩টি মামলা হয়েছে তার নামে। ময়মনসিংহ মহানগর বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক ও কৃষক দলের সভাপতি এনামুল হক আকন্দ লিটনের বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে ৫০টির অধিক। এর মধ্যে ২০টির মতো মামলায় জামিনে থাকলেও আবার তার বিরুদ্ধে নতুন মামলা করা হয়েছে।
এলাকা ভিত্তিক মামলার সংখ্যার দিকে সবচেয়ে বেশি মামলা ঢাকা মহানগরে। ১৭ হাজার ৫৮৩টি মামলায় আসামি ২ লাখ ৯১ হাজার ৯৩৫ জন। সিরাজগঞ্জে ২ হাজার ২৭০টি, নোয়াখালীতে ২ হাজার ৫৮৩টি, চট্টগ্রামে ২ হাজার ৩০১টি, ফেনীতে ২ হাজার ১৯৯টি, নারায়ণগঞ্জে ২ হাজার ৯১৩টি, ঢাকা জেলায় ২ হাজার ৩২৫টি, সাতক্ষীরায় ২ হাজার ৫৭৭টি, রাজশাহী মহানগরে ২ হাজার ৫৯৬টি, খুলনা মহানগরে ২ হাজার ৯১০টি, চট্টগ্রাম মহানগরে ৪ হাজার ৫৭টি, বরিশাল মহানগরে ২ হাজার ৪৮৪টি, সিলেট মহানগরে ২ হাজার ৪৬৭টি মামলা রয়েছে।
সর্বশেষ, পুরনো দুটি নাশকতার মামলায় মির্জা ফখরুল, রুহুল কবীর রিজভী, শিমুল বিশ্বাস, শামা ওবায়েদসহ ৬৮ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেছেন ঢাকার আদালত। মির্জা ফখরুলের বিরুদ্ধে মামলাটি ১১ বছর আগের। এটি ২০১২ সালের ডিসেম্বরে রাজধানীর পল্টন থানায় নাশকতার মামলা। অন্যটি আট বছর আগে রাজধানীর বাড্ডা থানা এলাকায় নাশকতার অভিযোগে।
এসব মামলা বিষয়ে বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, সরকার আবারও পুরনো খেলা শুরু করেছে। নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসছে, ততই বিএনপি নেতাকর্মীদের নামে গায়েবি, মিথ্যা, রাজনৈতিক হয়রানিমূলক মামলার সংখ্যা বাড়ছে। গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ছাড়াই শত শত নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। জামিন আদেশে কারাগার থেকে বের হবার সঙ্গে সঙ্গে গেট থেকে অন্য মামলায় গ্রেপ্তার করছে। এভাবে কত মামলা করবে, গ্রেপ্তার করবে? সারাদেশের মানুষ তাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। এসব মামলা-হামলা করে সরকার আর পার পাবে না।


প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ২২, ২০২৩ | সময়: ৫:০২ পূর্বাহ্ণ | সুমন শেখ