চারঘাটের কে এই মুক্তা-সাব্বির-শুভ? যাদের গ্রেপ্তারে লাগবে মন্ত্রীর অনুমতি

স্টাফ রিপোর্টার : থানা কম্পাউন্ডে নিজের বিশ্রামকক্ষে কারাগারে থাকা এক ‘মাদক মামলার আসামীর’ স্ত্রীর সঙ্গে রাজশাহীর চারঘাট মডেল থানার ওসি মাহবুবুল আলমের মুখোমুখি আলাপের একটি অডিও ক্লিপ সমাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। ওই গৃহবধুর কাছে সাত লাখ টাকা ঘুষ দাবি ছাড়াও সেখানে ওসি বলেছেন, নির্বাচন করতে মন্ত্রী (পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী) আমাকে গাইবান্ধা থেকে চারঘাট থানায় নিয়ে এসেছেন।
শুধু তাই নয়, নির্বাচনের আগে মুক্তা, সাব্বির, শুভকে গ্রেপ্তার করা যাবে না। দাবিকৃত ঘুষের টাকা দিলে নির্বাচনের পর মন্ত্রীকে বলে তাদের গ্রেপ্তারের ব্যবস্থা করা হবে বলেও ওই অডিওতে বলতে শুনা গেছে ওসি মাহবুবুলকে। তিনি ওই নারীর সঙ্গে যেসব আলাপ করেন তা গোপন রেকর্ডিং যন্ত্রে রেকর্ড করা হয়। ৬ মিনিট ৫৩ সেকেন্ডের অডিওতে ওসির কথোপকথনে উঠে এসেছে চাঞ্চল্যকর অনেক অজানা তথ্য। বিশেষ করে আগামী নির্বাচন ঘিরেও বেশ কিছু তথ্য শোনা যায় অডিওতে।
ওসি মাহবুবুল আলমের বিরুদ্ধে গত শনিবার বিকেলে রাজশাহীর পুলিশ সুপারের কাছে একটি লিখিত অভিযোগ দেন চারঘাটের শলুয়া ইউনিয়নের চামটা গ্রামের বাসিন্দাসাহারা খাতুন (২৮) নামের এক নারী। এর সঙ্গে ঘুষ চাওয়ার ৬ মিনিট ৫৩ সেকেন্ডের কথোপকথনের একটি রেকর্ডও সংযুক্ত করা হয়। ওই দিন সন্ধ্যার পর থেকে অডিওটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। এরপর ওসি মাহবুবুলকে প্রত্যাহার করে পুলিশ লাইনসে সংযুক্ত করা হয়।
লিখিত অভিযোগে সাহারা খাতুন উল্লেখ করেছেন, তার স্বামী দীর্ঘদিন ধরে পুলিশ ও র‌্যাবের সোর্স হিসেবে কাজ করেন। তার স্বামীর দেওয়া তথ্যে চারঘাট এলাকায় অনেক মাদক কারবারিকে র‌্যাব ও পুলিশ আটক করেছে। এতে তার স্বামী ও পরিবারের ওপর চারঘাটের মাদক ব্যবসায়ীরা ক্ষিপ্ত হন। তার স্বামীকে মাদক ও অস্ত্র দিয়ে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
তার স্বামীকে গ্রেপ্তারের পর মাদক ব্যবসায়ীরা তাদের ওপর অত্যাচার শুরু করেন। বিশেষ করে মুক্তা, সাব্বির, শুভ তার কাছে ওসির নাম করে এক লাখ টাকা চাঁদা দাবি করে। না দিলে স্বামীর মত ছেলেসহ তাকেও মামলা দিয়ে ফাঁসিয়ে দেয়ার হুমকি দেয়।
গত ১২ সেপ্টেম্বর ওসিকে ফোন দিয়ে মুক্তা, সাব্বির, শুভর বিরুদ্ধে অভিযোগ জানান সাহারা। ওসি তাকে পরদিন থানায় আসতে বলেন। থানায় গেলে ওসি তার কোয়ার্টারে ডেকে নেন। এ সময় ছেলেও সঙ্গে ছিল। ওসি তার সঙ্গে যেসব কথা বলেন, তা তিনি কৌশলে রেকর্ড করে রাখেন।
কে এই মুক্তা, সাব্বির ও শুভ : মুক্তার পুরো নাম মুক্তার হোসেন (৪০)। তিনি চারঘাটের শলুয়া ইউনিয়নের চামটা গ্রামের আনজুর রহমান সাইদুরের ছেলে। আর শুভর পুরো নাম আব্দুল ওয়াদুদ শুভ (৩৫)। তিনি শলুয়া গ্রামের সাজেদুর রহমানের ছেলে। অপরজন চারঘাটের শলুয়া ইউনিয়নের শিবপুর গ্রামের ছইমুদ্দিনের ছেলে সাব্বির হোসেন সাব্বির (৩৮)। এদের মধ্যে শুভ শলুয়া ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সভাপতি। আর মুক্তা ও সাব্বির এক সময় বিএনপি নেতা আবু সাঈদ চাঁদের ক্যাডার ছিলেন। কয়েক বছর ধরে তারা আওয়ামী লীগের নেতাদের সঙ্গে ওঠা বসা করে এখন ক্ষমতাশীল দলের নেতা বনে গেছেন।
তাদের বিরুদ্ধে মাদক কারবারসহ চাঁদাবাজি ও লোকজনকে ধরে নিয়ে গিয়ে নির্যাতনের অভিযোগও রয়েছে একাধিক। মুক্তার পরিবার সক্রিয় মাদক কারবারের সাথে র্দীঘদিন যাবত জড়িত। মুক্তার হোসেনের বাবা আনজুর ও মায়ের বিরুদ্ধেও বেশ কয়েকটি মাদক মামলা রয়েছে। এছাড়াও মুক্তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন থানায় হত্যা, মাদক ও অস্ত্রসহ মোট ১৬ টি মামলা রয়েছে এবং সাব্বিরের বিরুদ্ধে মাদক, অস্ত্র, হত্যাসহ ৬টি মামলা রয়েছে। সাব্বির বেশ কিছু দিন আগে অস্ত্র ও হেরোইনসহ ডিবি পুলিশের হাতে একবার গ্রেপ্তার হয়েছিলো।
সর্বশেষ গত ৯ জুলাই রাজশাহীর চারঘাটে টাকা চুরির অপবাদে দুই যুবককে বুক সমান মাটিতে পুঁতে ও পানিতে চুবিয়ে নির্যাতন করে তারা। এ ঘটনার একটি ভিডিও ভাইরালও হয়। এর পর গত ২৮ আগস্ট থানায় মামলা হয়েছে। পানিতে চুবিয়ে নির্যাতনের শিকার মোহন ইসলামের মা নাসিমা বেগম বাদী হয়ে চারঘাট থানায় মামলাটি দায়ের করেছিলেন।
এ মামলার প্রধান আসামী রয়েছেন চারঘাটের চামটা গ্রামের আনজুর রহমান সাইদুরের ছেলে মুক্তার হোসেন মুক্তা (৪০)। মামলার অন্য আসামীরা হলেন, সলুয়া গ্রামের সাজেদুর রহমানের ছেলে আব্দুল ওয়াদুদ শুভ (৩৫), শিবপুর গ্রামের ছইমুদ্দিনের ছেলে সাব্বির হোসেন (৩৮), চামটা গ্রামের ইমান আলীর ছেলে মো. শুভ (২২), দৌলতপুর গ্রামের জিন্নাত আলীর ছেলে ঋত্বিক (২৩), একই গ্রামের গণির ছেলে জিনারুল (৪০), মতিন সরকারের ছেলে সাকলাইন (৩৬), সলুয়া গ্রামের রমজান আলীর ছেলে লালন (৩০) ও একই গ্রামের গমেজ আলীর ছেলে মিজান (৩৫)। তবে আসামীরা এলাকায় অবাধ চলাফেরা করলেও পুলিশ তাদের গ্রেপ্তার করেনি।
তবে কেন তাদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে না সে বিষয়টি ওই অডিওতে ফাস করে দেয় ওসি মাহবুবুল আলম। ফাঁস হওয়া অডিওর ওসিকে বলতে শোনা যায় মুক্তা শুভকে নির্বাচনের আগে ধরা যাবে না। এখানে কিছু বিষয় আছে। সব বলা যাবে না। নির্বাচনের পর মন্ত্রীকে বলে তাদের ধরার ব্যবস্থা করা হবে। এছাড়াও আরেকটি অডিওতে ওসি ওই নারীকে বলছেন, আমার বিরুদ্ধে দরখাস্ত দিয়েন না। আমি মন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিব।
যদিও ফাঁস হওয়া বক্তব্য ‘এডিটেড’ (সম্পাদনা করা) বলে দাবি করেছেন ওসি মাহবুবুল আলম। তিনি গত সোমবার সাংবাদিকদের বলেছেন, তারা উভয়ই মাদক ব্যবসায়ী। তাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব। তিনি কোনো মাদক ব্যবসায়ীকে স্বাধীনভাবে চলতে দেন না। এই কারণে তারা পরিকল্পনা করে এডিট করে অডিও ছেড়ে দিয়েছেন।
এ ঘটনায় গত রোববার একটি তিন সদস্যের তদন্ত কমিটিও করে দিয়েছেন পুলিশ সুপার সাইফুর রহমান। কমিটিকে পাঁচ কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।


প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ২১, ২০২৩ | সময়: ৫:৩০ পূর্বাহ্ণ | সুমন শেখ