সর্বশেষ সংবাদ :

ডেঙ্গু আক্রান্ত হলে ডাবের পানি কতটা খাবেন?

সানশাইন ডেস্ক : ডেঙ্গু আক্রান্তদের শরীরে পানির ঘাটতি পূরণে ডাব উপকারী, তাই রোগীর স্বজনরা ছুটছেন ফুটপাতের ডাবের দোকানে। ফলে ডেঙ্গুর প্রকোপ বেড়ে যাওয়ার পর হাসপাতালগুলোর সামনে ডাবের দোকান বেড়েছে। সুযোগ বুঝে ব্যবসায়ীরা ডাবের দাম দ্বিগুণের বেশি বাড়িয়ে দিয়েছেন।
ডেঙ্গুর চিকিৎসায় ২০২২ সালে তৈরি গাইডলাইনে রোগীদের পর্যাপ্ত পরিমাণ তরল খেতে বলা হয়েছে। এর পরিমাণ দৈনিক ৮ থেকে ১০ গ্লাস। তরল খাবারের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে দুধ, ফলের রস, ওরস্যালাইন, বার্লি, ভাতের মাড় বা ডাবের পানির কথা।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন, ডাবের পানি শরীরের জন্য উপকারী, তবে অতিরিক্ত পান করলে ক্ষতির ঝুঁকি থাকে। আর গাইডলাইনে কখনোই বলা হয়নি বেশি পরিমাণে ডাবের পানি খাওয়াতে হবে। ঘাটতি পূরণে যে কোনো স্বাভাবিক পানীয় বা খাবার খাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তারা।
ডাবের পানিতে ক্যালসিয়াম, পটাসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, ভিটামিন সি, রিবোফ্লেভিন ও কার্বোহাইড্রেট রয়েছে। প্রতি ১০০ গ্রাম ডাবের পানিতে ৯৫.৫ শতাংশ পানি, ০.০৫ শতাংশ নাইট্রোজেন, ০.৫৬ শতাংশ ফসফরিক এসিড, ০.২৫ শতাংশ পটাশিয়াম, ০.৬৯ শতাংশ ক্যালসিয়াম, ০.৫৯ শতাংশ ম্যাগনেশিয়াম অক্সাইড থাকে।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল, মহাখালীর ডিএনসিসি হাসপাতাল ঘুরে দেখা গেছে, প্রতিটি হাসপাতালের ফটকের সামনেই ডাব নিয়ে বসেছেন বিক্রেতারা। রোগীর স্বজনরা এসে কিনে নিয়ে যাচ্ছেন।
শুক্রবার মহাখালীর ডিএনসিসি হাসপাতালের সামনে ডাব কিনতে এসেছিলেন শফিকুল ইসলাম। ডেঙ্গু আক্রান্ত ভাইকে তরল খাবার খাওয়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন চিকিৎসক, তাই কিছুক্ষণ পরপর ডাবের পানি খাওয়াচ্ছেন তিনি।
শফিকুল ইসলাম জানালেন, দিনে তার ভাইকে মোটামুটি ১০টি ডাবের পানি খাওয়াচ্ছেন। ডাবের পানি নাকি অনেক উপকারী, এজন্য খাওয়াইতেছি। একদিনেই ১৬শ টাকা খরচ হয়েছে ডাবের পানি খাওয়াতে। একটা ১৬০ টাকা করে কিনতে হয়। ভাইয়ের অসুখ এখন টাকার চিন্তা করে পারা যাবে না।
চিকিৎসক কয়টা ডাব খাওয়াতে বলেছেন এমন প্রশ্নে শফিকুল ইসলাম বলেন, ডাক্তার বলেছেন ডাবের পানি, তরল খাবার খাওয়াতে, কতটা খাওয়ানো লাগবে সেটা বলেন নাই।
ঢাকার হাসপাতালগুলোর সামনে কোথাও ১৫০ টাকার কমে ডাব পাওয়া যাচ্ছে না। ডাবের এই দাম বাড়ার কারণ জানতে চাইলে ডিএনসিসি হাসপাতালের সামনের ডাব বিক্রেতা হোসেন আলী বলেন, প্রতিটি ডাব তাদের কিনতে হয় গড়ে ১৩৫ টাকা করে।
মুন্সীগঞ্জের সিরাজদীখানের জাকির হোসেনের সাত বছর বয়সী মেয়ে নাজিয়া সুলতানা ডিএনসিসি হাসপাতালে ভর্তি। জাকির তার মেয়েকে প্রতিদিন অন্তত একটি ডাবের পানি খাওয়াচ্ছেন।
জাকির বলেন, ডাবের দাম অনেক বেশি। সামনের তিনটা দোকান ঘুরে মহাখালী কাঁচাবাজারের দিকে গেলাম। কিন্তু কোথাও ১৭০-১৮০ টাকার কমে ডাব কিনতে পারি নাই। একটা ডাব যদি এই দামে কিনতে হয় তাহলে আরও তো পথ্য আছে, ওষুধ আছে। মানুষের বিবেক বলে কিছু নাই।
ঢাকা মেডিকেলের জরুরি বিভাগের সামনের ফটকের পাশের একটি ভ্যান থেকে ডাব কিনছিলেন আনিসুর রহমান। তিনি বললেন, তার ছোট ভাই মেডিসিন ওয়ার্ডে ভর্তি। এজন্য ১৬০ টাকা দিয়ে একটি ডাব কিনেছেন। ডাক্তার বলেছেন প্রচুর ফ্লুইড দিতে হবে। এজন্য দিনে দুই-তিনটা ডাবের পানি খাওয়ানোর চেষ্টা করতেছি। কিন্তু এখানে ডাবের অনেক দাম রাখছে। যেই ডাব বাজারে ৬০-৭০ টাকা সেইটা ১৬০ টাকা, রীতিমতো ডাকাতি।
শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের ব্লাড ট্রান্সফিউশন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. আশরাফুল হক জানান, শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের ডেঙ্গু ওয়ার্ডে ভর্তি নয় মাস বয়সী এক শিশুর রক্ত পরীক্ষা করে তাতে সোডিয়াম ১২৭ মিলিমোলস পার লিটার, পটাশিয়াম ৫ দশমিক ৪৬ মিলিমোলস পার লিটার এবং ক্লোরাইড পাওয়া গেছে ৯৮ মিলিমোলস পার লিটার।
অথচ রক্তে এসব উপাদানের স্বাভাবিক মাত্রা হল যথাক্রমে ১৩৫-১৪৫ মিলিমোলস পার লিটার, ৩.৫-৫ মিলিমোলস পার লিটার এবং ৯৫ থেকে ১০৫ মিলিমোলস পার লিটার। একটি ডাব কিনে ল্যাবে পরীক্ষা করলে পটাশিয়াম পাওয়া যাবে ৪৭ দশমিক ৭৫ মিলিমোলস পার লিটার। আর সোডিয়াম আছে ১৭ দশমিক ১ মিলিমোলস পার লিটার, ক্লোরাইড ৪২ দশমিক ৮ মিলিমোলস পার লিটার।
ডা. আশরাফুল বলেন, মানুষ প্রতিদিন অন্তত তিন লিটার পানি পান করে। শরীর থেকে ঘামের মাধ্যমে সোডিয়াম বের হয়ে যায়। তাই এত পরিমাণ পানি আর ঘামের মাধ্যমে বের হওয়া সোডিয়ামের মধ্যে ভারসাম্য থাকে। জ্বর হলে এই ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যায়, তাই রোগীকে সাধারণ স্যালাইন দেওয়া হয়, যাতে ০.৯ শতাংশ সোডিয়াম থাকে। কিন্তু পটাশিয়াম শরীর থেকে ঘামের মাধ্যমে বের হয় না, পায়খানার সঙ্গে বের হয়।
সোডিয়াম, পটাশিয়াম, ক্লোরাইড শরীরের স্বাভাবিক মেকানিজম নিয়ন্ত্রণ করে। এসব উপাদান বেশি নেওয়া ভালো না, কমও ভালো না। ডাবের পানিতে পটাশিয়াম বেশি, সোডিয়াম কম থাকে। পটাশিয়াম যতটুকু থাকা দরকার তার চেয়ে বেশি হলেই কিডনিতে চাপ পড়ে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক অধ্যাপক ডা. নাজমুল ইসলাম বলেন, ডাবের পানির দাম অনেক বেশি, তাই এটা অনেকেই কিনে খেতে পারবে না। ডাব খেতে বলার উদ্দেশ্য হচ্ছে, যাদের বাড়িতে ডাব সহজলভ্য, তারা যেন পান করেন।
তিনি বলেন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের গাইডলাইনে অনেকগুলো খাবারের কথা বলা হয়েছে, একেক এলাকায় একেকটা, যে যেখানে যা পাবে অন্য তরলের সঙ্গে সেটাও খাবে। ডাবের পানিতে পটাশিয়াম আছে। জ্বরের সময় প্রচণ্ড ঘাম হয়। এতে মাংসপেশিতে খিঁচুনি হয়, ক্রাম্প হয়, রোগী কষ্ট পায়। রোগী যদি সামান্য কলা, ডাব খেতে পারে, তাহলে ওই ঘাটতিটা পূরণ হয়। কিন্তু পরিমিত খেতে হবে। অতিরিক্ত খেলে শরীরে অতিরিক্ত পটাশিয়াম যোগ হবে, অতিরিক্ত কিছুই তো শরীরের জন্য ভালো না।
ডা. নাজমুল ইসলাম বলেন, ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী স্যুপ, রং চা, বার্লি, সুজি, সেমাই বা যদি ভাতসহ স্বাভাবিক খাবার খেতে পারে, সেটাই খাবে। রোগী যেন খেতে পারে খাবারটা, সেরকম উপযোগী করে দিতে হবে।
উদ্দেশ্য একটাই, রোগী যেন পানিশূন্যতায় না ভোগে। সহজ উপায় হল, ঘরে যা আছে তার মাঝখান থেকে রোগীর উপযোগী করে দেওয়া। যদি আমের শরবত খায় ভালো, সবচেয়ে সহজ উপায় লেবুর শরবত। শুধু ডাবের পানি না খাইয়ে অন্যান্য পুষ্টিকর খাবারও দিতে হবে।


প্রকাশিত: আগস্ট ১৪, ২০২৩ | সময়: ৬:১৭ পূর্বাহ্ণ | সুমন শেখ