সর্বশেষ সংবাদ :

রুপিতে বাণিজ্য শুরু : বড় সূচনার প্রথম পদক্ষেপে বাংলাদেশ ও ভারত

সানশাইন ডেস্ক: ডলার সংকটের দুনিয়ায় লেনদেন নিষ্পত্তির বিকল্প তৈরির চেষ্টায় দীর্ঘ আলোচনা শেষে আনুষ্ঠানিকভাবে রুপিতে লেনদেনের যুগে প্রবেশ করল বাংলাদেশ ও ভারত। মঙ্গলবার ঢাকার একটি হোটেলে এ কার্যক্রমের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে রুপিতে বাণিজ্য নিস্পত্তি শুরুর বিষয়টিকে একটি ‘বড় সূচনার প্রথম পদক্ষেপ’ হিসেবে বর্ণনা করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার।
তিনি বলেন, “বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভের ঝুড়িতে থাকা ডলারের উপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে আনবে রুপির লেনদেন। বড় কোনো যাত্রার প্রথম পদক্ষেপ এটি। সামনের দিকে দুই দেশের বাণিজ্য সম্পর্কে আরো বৈচিত্র্য নিয়ে আসবে আজকের এই উদ্যোগ।” ভারতীয় হাই কমিশনার প্রণয় ভার্মা বলেন, রুপিতে আমদানি-রপ্তানি শুরু হওয়ায় দুই দেশের বন্ধুত্ব ও বাণিজ্যক সম্পর্কে ‘নতুন অধ্যায়ের উন্মোচন’ হল।
তিনি বলেন, “দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ ভারতের পঞ্চম বাণিজ্যিক অংশীদার। রুপিতে বাণিজ্য নিষ্পত্তি দুই দেশের সম্পর্কে নতুন মাত্রা যোগ করল। রুপিতে লেনদেন শুরু আমাদের ‘অংশীদারত্বের ভিত্তিতে উন্নয়ন ও অভিন্ন সংস্কৃতির ঘোষণার’ বিষয়টিই প্রমাণ করে। মঙ্গলবার ঢাকার লো মেরিডিয়ান হোটেলে রুপিতে ভারত থেকে আমদানি ও রপ্তানি কার্যক্রম উদ্বোধন করা হয়। বগুড়ার কোম্পানি তামিম এগ্রো ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের কাছ থেকে ১ কোটি ৬০ লাখ ভারতীয় রুপির পণ্য কেনার জন্য ভারতীয় আমদানিকারকের এলসি খোলার মধ্য দিয়ে হয় প্রথম লেনদেন।
স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়া (এসবিআই) ঢাকা শাখার মাধ্যমে এ রপ্তানি করা হয়। ভারতের আমদানিকারক ঋণপত্র ( এলসি) খোলে দেশটির আইসিআইসিআই ব্যাংকের মাধ্যমে। অন্যদিকে বাংলাদেশ থেকে রুপিতে প্রথম আমদানি করে নিটা কোম্পানি। এসবিআই ঢাকা শাখার মাধ্যমে তারা এক কোটি ২০ লাখ রুপির পণ্য আমদানির আদেশ দেয়। এসবিআই এর মুম্বাই শাখা পণ্য আমদানিতে ভারতে প্রতিনিধি ব্যাংক হিসেবে কাজ করবে।
প্রথম আমদানি-রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের স্বীকৃতি হিসেবে কোম্পানিগুলোর মালিকদের অনুষ্ঠানে দেওয়া হয় স্মারক উপহার। অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সচিব শেখ মোহাম্মদ সলীম উল্লাহ বলেন, “রুপিতে বাণিজ্য নিষ্পত্তি হওয়ায় আমাদের ডলারের সঙ্গে মুদ্রা বিনিময় করলে যে আর্থিক ক্ষতি হয়, তা আর হবে না। এটি শুধু লেনদেন নয়, দুই দেশের বাণিজ্যিক সম্পর্কে আরো বৈচিত্র্য নিয়ে আসবে।”
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব তপন কান্তি ঘোষ বলেন, বাংলাদেশ সব সময় ভারতকে ‘সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু’ হিসেবে বিবেচনা করে। বাংলাদেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বাণিজ্য অংশীদার ভারত। “বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে শত প্রতিকূলতার মধ্যেও। শুধু পণ্য আমদানিতে নয়, সেবা, ভ্রমণ ও অন্যান্য খাতেও রুপি ব্যবহারের সুযোগ রয়েছে। এই সম্ভাবনাকে আমাদের কাজে লাগতে হবে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক উন্নয়নে।”
বৈদেশিক বাণিজ্যে লেনদেন সহজ করতে এবং ব্যয় সাশ্রয়ে বিকল্প মুদ্রা চালুর উদ্যোগ নিতে গত কয়েক মাস ধরে ভারত ও বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের মধ্যে আলোচনা চলে। সেই ধারাবাহিকতায় সীমিত পরিসরে রুপিতে লেনদেন শুরু হল। এর ফলে উভয় দেশের উদ্যোক্তাদের বাণিজ্য খরচ কমে আসার পাশাপাশি ডলার নির্ভরতাও কিছুটা কমে আসবে বলে আশা করছেন ব্যাংকার, অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা।
শুরুতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ও বেসরকারি ইস্টার্ন ব্যাংক লিমিটেড (ইবিএল) এবং ভারতের স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়া (এসবিআই) ও আইসিআইসিআই ব্যাংক রুপিতে বাণিজ্য লেনদেন নিষ্পত্তিতে অংশ নিচ্ছে। প্রতিবেশী দুই দেশের মধ্যে রুপিতে লেনদেনের প্রক্রিয়া চালু করতে দুই দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদনে ভারতের ব্যাংকগুলোতে রুপিতে ‘নস্ট্র অ্যাকাউন্ট’ খুলেছে সোনালী ও ইবিএল। নস্ট্র হিসাব হল- বিদেশের কোনো ব্যাংকে বিদেশি মুদ্রায় লেনদেন করতে খোলা হিসাব।
এর ফলে ডলারের মাধ্যমে এলসি বা ঋণপত্র খোলার প্রচলিত পদ্ধতির পাশাপাশি রুপিতে বাংলাদেশ থেকে পণ্য আমদানির জন্য ভারতের ব্যাংক দুটিতে ঋণপত্র খুলতে পারবেন দেশটির আমদানিকারকরা। একইভাবে ভারত থেকে পণ্য আমদানিতে বাংলাদেশের ব্যাংক দুটিতে ঋণপত্র খুলতে পারবেন আমদানিকারকরা। বাংলাদেশ যে পরিমাণ পণ্য ভারতে রপ্তানি করবে, তার বিপরিতে প্রাপ্ত রপ্তানি আয়ের সমপরিমাণ অর্থের পণ্য আমদানি করা যাবে রুপিতে।
টাকার বিপরীতে রুপিতে বিনিময় হার ব্যাংকগুলোকে সরবরাহ করে থাকে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ হার ধরে পণ্য আমদানি ও রপ্তানি খরচ নির্ধারণ করবে ব্যাংকগুলো। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত ২০২১-২২ অর্থবছরে ভারত থেকে এক হাজার ৩৬৯ কোটি ডলার আমদানি দায় পরিশোধ করা হয়; যা মোট আমদানি ব্যয়ের ১৮ দশমিক ১০ শতাংশ। এর বিপরীতে রপ্তানি করা হয় ১৯৯ কোটি ডলার।
বিদেশি মুদ্রা লেনদেনে আর্থিক পরিষেবা হিসেবে আন্তর্জাতিক লেনদেন মাধ্যম সুইফট সিস্টেমকে ব্যবহার করা হয়। কোনো দেশের সঙ্গে বিদেশি মুদ্রায় বাণিজ্য লেনদেন নিষ্পত্তি করতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) স্বীকৃত মুদ্রায় করতে হয়। সুইফট সিস্টেমে এখনও রুপি অন্তভূক্ত করা হয়নি। ইউএস ডলার, ইউরো, পাউন্ড, চীনের মুদ্রা ইউয়ান ও জাপানের ইয়েন আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের স্বীকৃত মুদ্রা। এর বাইরের কোনো মুদ্রায় লেনেদেন করতে হলে প্রয়োজন হয় দ্বিপক্ষীয় চুক্তি। বাংলাদেশ ও ভারত সেটাই চালু করল।


প্রকাশিত: জুলাই ১২, ২০২৩ | সময়: ৫:৪২ পূর্বাহ্ণ | সুমন শেখ