সর্বশেষ সংবাদ :

আঞ্চলিক সমুদ্র নিরাপত্তা আরও শক্তিশালী করার আহ্বান প্রধানমন্ত্রীর

সানশাইন ডেস্ক : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশসমূহকে তাদের উন্নয়ন এবং সমৃদ্ধ ভবিষ্যত নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ‘সমুদ্র কূটনীতি’ জোরালো করার উপর গুরুত্বারোপের পাশাপাশি এই অঞ্চলের অনেক দেশ জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রভাবের ঝুঁকিতে থাকার বিষয়টি বিবেচনা করে প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং এর ক্ষয়ক্ষতি কমাতে সহযোগিতা বাড়ানোর তাগিদ দিয়েছেন।
শুক্রবার (১২ মে) সন্ধ্যায় রাজধানীর হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে দু’দিনব্যাপী ৬ষ্ঠ ভারত মহাসাগরীয় (ইন্ডিয়ান ওশান) সম্মেলনে-২০২৩ উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে রাখতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ভৌগলিক অবস্থানের কারণে ভারত মহাসাগর শুধু বাংলাদেশের জন্য নয়, এই অঞ্চলের সকল দেশের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ। সম্প্রতি আমাদের ইন্দো-প্যাসেফিক কৌশল তৈরি করেছি। এই অঞ্চলের শান্তি ও সমৃদ্ধি নিশ্চিতকল্পে লক্ষ্য অর্জনের জন্য অর্থপূর্ণ সহযোগিতা, সংলাপ এবং পারস্পরিক বোঝাপড়ায় আমাদের কার্যকর ‘অংশীদারিত্ব’ প্রয়োজন।
‘টেকসই ভবিষ্যতের জন্য শান্তি, সমৃদ্ধি এবং অংশীদারিত্ব’ থিম শীর্ষক সম্মেলনে মরিশাসের প্রেসিডেন্ট পৃথ্বীরাজ সিং রুপন, মালদ্বীপের ভাইস প্রেসিডেন্ট ফয়সাল নাসিম, ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রী ড. এস জয়শঙ্কর এবং বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন ভার্চুয়ালি সম্মেলনে বক্তব্য রাখেন। স্বাগত বক্তব্য রাখেন ইন্ডিয়ান ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান রাম মাধব।
বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধির্ভূক্ত গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইন্ডিয়ান ফাউন্ডেশন যৌথভাবে এ সম্মেলনের আয়োজন করেছে। সম্মেলনের শুরুতে ভারত মহাসাগরীয় সম্মেলন নিয়ে একটি ভিডিও ডকুমেন্টারি প্রদর্শণ করা হয়। বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশের ৩০ জনেরও বেশি মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী এবং ডেপুটি মিনিস্টাররা অংশ নেন। অনুষ্ঠান শেষে প্রধানমন্ত্রীর আয়োজন সম্মেলনে আসা অতিথিরা নৈশভোজে অংশ নেন।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী ৬ষ্ঠ ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলের জন্য ছয়টি বিষয়ের ওপর আলোকপাত করে বলেন, একটি স্থিতিশীল এবং টেকসই ভবিষ্যতের জন্য ভারত মহাসাগরীয় দেশগুলোর মধ্যে পারস্পরিক বিশ্বাস এবং সমীহের ভিত্তিতে শক্তিশালী অংশীদারিত্ব গড়ে তুলতে হবে। ভারত মহানগরে সামুদ্রিক নিরাপত্তা সংক্রান্ত বিদ্যমান ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করা, যার মধ্যে সমুদ্রে জরুরি পরিস্থিতিতে সাড়া দেখানো অনুসন্ধান ও উদ্ধার কাজে সহায়তা এবং আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে নৌ ও বিমান চলাচল নিশ্চিত করতে হবে।
তিনি বলেন, ‘শান্তির সংস্কৃতি চর্চা’ এবং জনবান্ধব উন্নয়নের প্রসার করতে হবে। একটি শান্তিপূর্ণ, সমতাভিত্তিক এবং অন্তর্ভূক্তিমূলক সমাজ গড়ার উদ্দেশে বিশ্ব জনগোষ্ঠীর অর্ধেক- নারী সম্প্রদায়ককে যথাযথ গুরুত্ব প্রদান করতে হবে। উন্মুক্ত, স্বচ্ছ, নিয়ম-ভিত্তিক বহুপাক্ষিক ব্যবস্থার প্রসার করা, যা অন্তর্ভূক্তিমূলক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মাধ্যমে এই অঞ্চলে এবং তার বাইরেও সমতাভিত্তিক টেকসই উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করবে।
প্রধানমন্ত্রী সকল বিদেশি অতিথিদের বাংলাদেশে সফরে আসার জন্য ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বলেন, বর্তমানে সাগর-মহাসাগরসমূহের মাধ্যমে বিশ্ব বাণিজ্যের ৯০ শতাংশ ও তেল পরিবহণের ৬০ শতাংশ পরিচালিত হচ্ছে। সমুদ্রপথে প্রকৃত বাণিজ্য বিগত ১৫ বছরে তিনগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশ্বব্যাপী দেশসমূহের টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে সামুদ্রিক যোগাযোগ ও বাণিজ্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। কিন্তু এই বিপুল সম্ভাবনা এখনও অনেকটাই অব্যবহৃত রয়ে গেছে।
তিনি বলেন, এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় এবং আফ্রিকার অঞ্চলসমূহে ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং কৌশলগত উল্লেযোগ্য গুরুত্ব রয়েছে। বর্তমানে বৈশ্বিক জনসংখ্যার ৬৪ শতাংশ এ অঞ্চলে বাস করে এবং জিডিপিতে এ অঞ্চলের অবদান ৬০ শতাংশ। বিপুল সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও এ অঞ্চলটি নানাবিধ প্রতিকূলতার মুখোমুখি হচ্ছে। ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলের শান্তি এবং সমৃদ্ধি নিশ্চিত করার জন্য এ অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে অংশীদারিত্ব এবং সহযোগিতা বৃদ্ধি করা আবশ্যক।
বাংলাদেশের সরকার প্রধান আরও বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের উন্নয়ন, প্রবৃদ্ধি ও স্থিতিশীলতার জন্য সর্বদা সামুদ্রিক সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহারের উপর গুরুত্বারোপ করেছেন। একজন দূরদর্শী নেতা হিসেবে ১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা নির্ধারণ এবং এ সীমার মধ্যে সামুদ্রিক সম্পদ অনুসন্ধানসহ বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ‘টেরোটরিয়াল ওয়াটার্স এ্যান্ড মেরিটাইম জোনস এ্যাক্ট, ১৯৭৪’ প্রণয়ন করেন। উল্লেখ্য, এই আইনটি ‘সমুদ্র আইন সম্পর্কিত জাতিসংঘ কনভেনশন, ১৯৮২’ ঘোষণার আট বছর আগে কার্যকর করা হয়েছিল, যখন বিশ্বসম্প্রদায়ের এ বিষয়ে সীমিত ধারণা ছিল।
শেখ হাসিনা বলেন, এবারের সম্মেলনের প্রতিপাদ্য- ‘টেকসই ভবিষ্যতের জন্য শান্তি, অংশীদারিত্ব এবং সমৃদ্ধি’ অত্যন্ত সময়োপযোগী এবং যথাযথ হয়েছে। টেকসই ভবিষ্যত নিশ্চিতকরণে অংশীদারিত্ব, শান্তি ও সমৃদ্ধির জন্য সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য।
তিনি বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে কোভিড-১৯ মহামারী এবং চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাতের প্রেক্ষিতে আরোপিত নিষেধাজ্ঞা এবং পাল্টা-পাল্টি নিষেধাজ্ঞা বিশ্বব্যাপী অনেক চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে, যার প্রেক্ষাপটে এ সম্মেলনের প্রতিপাদ্য আরও বেশি প্রাসঙ্গিক বলে প্রতীয়মান হচ্ছে।
বাংলাদেশের টানা তিনবারের প্রধানমন্ত্রী বলেন, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা, খাদ্য, জ্বালানি এবং সার সঙ্কটের ফলে বিশ্বজুড়ে মানুষের জীবনযাত্রা অসহনীয় হয়ে পড়েছে। ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলকেও জলবায়ু পরিবর্তন, সামুদ্রিক নিরাপত্তা, সন্ত্রাসবাদ এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের মতো চ্যালেঞ্জসমূহ মোকাবেলা করতে হচ্ছে। এসকল চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় এবং ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে শান্তি ও সমৃদ্ধি প্রতিষ্ঠার জন্য এ অঞ্চলের দেশগুলোকে অংশীদারিত্ব এবং সম্মিলিত প্রচেষ্টার ওপর জোর দিতে হবে।
রোহিঙ্গা ইস্যুতে প্রধানমন্ত্রী বলেন, নানা প্রতিকূলতা সত্ত্বেও আমরা এক দশমিক এক মিলিয়নেরও বেশি জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত মায়ানমারের নাগরিকদের বাংলাদেশে অস্থায়ীভাবে আশ্রয় দিয়েছি, যার ফলে এ অঞ্চরে বড় ধরনের মানবিক বিপর্যয় প্রতিরোধ করা সম্ভব হয়েছে। এখন আমরা রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে নিরাপদ ও শান্তিপূর্ণ উপায়ে তাদের মাতৃভূমিতে প্রত্যাবাসন নিশ্চিতকরণে বিশ্বসম্প্রদায়ের সক্রিয় সমর্থন কামনা করি।
২০৪১ সালের মধ্যে আধুনিক স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় পুনর্ব্যক্ত করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, গত এক দশকে বাংলাদেশ আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে এবং সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধন করেছে। বাংলাদেশ এখন বিশ্বের ৩৫তম বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আমাদের চরম দারিদ্র্যের হার ৫ দশমিক ৬ শতাংশ নেমে এসেছে এবং আমাদের মাথাপিছু আয় গত এক দশকে তিনগুণ বৃদ্ধি পেয়ে ২ হাজার ৮২৪ ডলার হয়েছে। উপরন্তু বাংলাদেশ ২০২৬ সালে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের জন্য প্রয়োজনীয় সকল মানদন্ড পূরণ করেছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ বিনির্মাণের স্বপ্ন দেখি যেখানে শক্তিশালী ভৌত অবকাঠামো আমাদের ক্রমবর্ধমান অর্থনীতির সহায়ক হবে। গত বছর আমরা নিজস্ব অর্থায়ণে পদ্মাসেতু উদ্বোধন করেছি। সম্প্রতি আমরা রাজধানীতে মেট্টোরেল উদ্বোধন করেছি। আমরা চট্টগ্রামে ৩ দশমিক ২ কিলোমিটার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ট্যানেলের নির্মাণ কাজ শীঘ্রই শেষ করব। নদীর তলদেশ দিয়ে এ ধরনের স্থাপনা, দক্ষিণ এশিয়ায় এটিই হবে সর্বপ্রথম। আমাদের স্বপ্ন হলো ২০৪১ সালের মধ্যে একটি জ্ঞান-ভিত্তিক, আধুনিক, উন্নত-সমৃদ্ধ সোনার বাংলাদেশ নির্মাণ করা এবং ২১০০ সালের মধ্যে একটি সমৃদ্ধ ও জলবায়ু সহনশীল ব-দ্বীপ হিসেবে গড়ে তোলা। এই লক্ষ্যসমূহ অর্জনের জন্য কৌশল হিসেবে আমরা টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং সবার জন্য সুযোগ তৈরি করার উপর গুরত্বারোপ করেছি।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এস জয়শঙ্কর বলেন, সম্প্রতি বাংলাদেশ ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল ঘোষণা করেছে। কৌশলে ৪টি মূলনীতি ও ১৫টি বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে। বাংলাদেশের কৌশলটি জাতিসংঘসহ অন্যদেশের চাওয়ার সঙ্গে মিল রয়েছে। ভারতও বাংলাদেশের কৌশলটিকে জানাচ্ছে। সামগ্রিকভাবে ইন্দো-প্যাসিফিক রাষ্ট্রগুলোর নিজেদের মধ্যে জোটটি ভবিষ্যতে এই অঞ্চলের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা ও সমৃদ্ধি বয়ে আনবে।
তিনি আরও বলেন, বর্তমান ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলের গুরুত্ব রয়েছে। তেমনি ভারত মহাসাগরীয় দেশগুলোর আলাদাভাবে নিজেদের মধ্যে সহযোগিতার প্রয়োজন রয়েছে। ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল আর ভারত মহাসাগরীয় জোট একসঙ্গে কাজ করবে। একটি আরেকটির বিকল্প নয়। জয়শঙ্কর বলেন, ভারত-বাংলাদেশসহ সদস্য দেশগুলো আগামীতে নিজেদের মধ্যে নিরাপত্তা, সমুদ্রকেন্দ্রিক যোগাযোগ বাড়াবে।
অসুস্থতায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী সম্মেলনে স্বশরীরে নেই ॥ পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন অসুস্থতার জন্য ইন্ডিয়ান ওশান কনফারেন্সে সরাসরি যোগ দিতে পারেননি। তিনি ভার্চ্যুয়ালি এই কনফারেন্সে যোগ দিয়েছেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে শুক্রবার সন্ধ্যায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ড. এ কে আব্দুল মোমেন সর্দি জ্বরে আক্রান্ত হয়েছেন। সে কারণে তিনি কনফারেন্সে যোগ দিতে পারেননি। তবে ভার্চুয়ালি যোগ দিয়েছেন।


প্রকাশিত: মে ১৩, ২০২৩ | সময়: ৫:৪৭ পূর্বাহ্ণ | সুমন শেখ