চারঘাটের ঐতিহাসিক গণহত্যা দিবস আজ

মিজানুর রহমান, চারঘাট: বাংলাদেশ সৃষ্টির ইতিহাসে এক করুন বেদনাবিধুর দিন ১৩ এপ্রিল, চারঘাট গণহত্যা দিবস। ১৯৭১ সালে এই দিনে অস্ত্রে সজ্জিত বর্বর পাকিস্থানী হানাদার বাহিনী অতর্কিত হামলা চালিয়ে চারঘাট উপজেলার থানাপাড়া গ্রামসহ পাশর্^বর্তী গ্রাম কুঠিপাড়া, গৌরশহরপুর, বাবুপাড়ার শত শত নিরস্ত্র বেসামরিক পুরুষ মানুষকে অপারেশন সার্চ লাইট নামে গুলি করে হত্যা করে। ১৩ এপ্রিল প্রতি বছর চারঘাটবাসীকে স্মরণ করিয়ে দেয় ৭১’ সালের ভয়াবহ দিনগুলোর কথা।
জানা যায়, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের ঐতিহাসিক ৭ মার্চের সেই অগ্নিঝরা ভাষন প্রেক্ষাপট বিবেচনায় অনুপ্রাণিত হয়ে আওয়ামীলীগ এর ডাকে ১৩ই মার্চ চারঘাট পাইলট হাই স্কুল মাঠ প্রাঙ্গনে স্বাধীনতার পক্ষে বিশাল জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। সেই জনসভা থেকে রাজশাহীবাসীকে একত্রিত হয়ে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ার আহ্বান জানানো হয়েছিল।
উপস্থিত সবাই হাত তুলে স্বাধীনতা আন্দোলনকে সমর্থন দিয়েছিল। সেই মোতাবেক শুরু হয়েছিল গনসংযোগ, মিটিং ও মিছিল এবং চারঘাটের মাটি থেকেই শুরু হয় রাজশাহী জেলার মুক্তিযুদ্ধ। এরপর দেশকে স্বাধীনতা এনে দিতে উপজেলার কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র, জনতা সবাই মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁিপয়ে পড়ে।
মুক্তিযোদ্ধা মোকাররম হোসেন হেজুর সঙ্গে আলাপ করলে তিনি জানান, ১ এপ্রিল ১৯৭১ এ রাজশাহী ক্যাডেট কলেজের তৎকালীন এডজুটেন্ট ক্যাপ্টেন রশিদের পরামর্শে থানাপাড়া গ্রামের ৩ জন যুবক ময়মনসিংহ কৃষি বিশ^বিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র খুরশীদ আলম শিবলী, মোকাররম হোসেন হেজু ও ওবাইদুর রহমান পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার বহরমপুর গমন করেন যুদ্ধে অংশগ্রহনকারী মুক্তিযোদ্ধা ও যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্তদের সাহায্য নেয়ার জন্য।
মোকাররম হোসেনের ক্লাসমেট সুবহানের সহায়তায় সাক্ষাৎ করেন তৎকালীন বহরমপুরের এমপি ফাহিম উদ্দীনের সঙ্গে। ওই এমপির পরামর্শে কয়েকদিন পরে ক্যাপ্টেন রশীদের লেখা সামরিক কায়দায় লিখিত চিঠি নিয়ে নদী পার হয়ে ভারতে বামনাবাদ গ্রামের ট্রান্সপোর্ট ব্যবসায়ী অসোক সিনহা ও স্থানীয় বাসিন্দা শক্তির মাধ্যমে বহরমপুরের তৎকালীন ডিএম এর কাছে সামরিক কায়দায় লিখিত চিঠিটি হস্তান্তর করেন। ডিএম সাহেব মুর্শিদাবাদ জেলার আর্মি চিফ স্টাফ ও বহররমপুর এর স্থানীয় এমএলএ সিদ্ধার্ত শংকর রায়কে (যার পূর্বপুরুষ রাজশাহী জেলার বাঘা উপজেলার আড়ানীতে বসবাস করতো) বিষয়টি অবগত করেন।
১১ এপ্রিল ক্যাপ্টেন রশিদের অনুপ্রেরনায় গোলাম কবির চৌধুরী গেদা, গৌশহরপুরের জবদুল, মুন্নাফ, ইউসুফ, জবানের নেতৃত্বে ও স্থানীয় জনসাধারনের সহায়তায় পুলিশ একাডেমী সারদার অস্ত্রাগারে থাকা অস্ত্র ও গোলাবারুদ লুট করে নিয়ে যাওয়া হয়। এই অস্ত্র ও গোলাবারুদগুলো পরবর্তীতে মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন অপারেশনে ব্যবহৃত হতো। তবে চারঘাট পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় ছিল চারঘাট উপজেলার মুক্তিযোদ্ধাদের মূল ক্যাম্প।
প্রত্যক্ষদর্শী থানাপাড়া গ্রামের রায়হান আলী জানান, আনুমানিক প্রায় ১০ ঘটিকার সময় অস্ত্রে সজ্জিত পাক হানাদার বাহিনী সায়রন বাজিয়ে সারদায় অবস্থিত তৎকালীন পুলিশ ট্রেনিং সেন্টার লুট করা অস্ত্র উদ্ধার করতে আসে। সারদা আসতে গিয়ে পাক বাহিনী মোক্তারপুর ট্রাফিক মোড় ও সারদা বাজারে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে বাধাগ্রস্ত হয়ে আধাঘন্টা গুলিবিনিময় হয়। শহীদ হন ইউসুফ, দিদারসহ বেশ কয়েকজন। পাক বাহিনী পুলিশ একাডেমীর ভিতর ঢুকে পদ্মা নদীর চরে ভীত সম্ভ্রব নিরস্ত্র কয়েক হাজার নারী-পুরুষ ও শিশু দেখতে পায়। পাক হানাদার বাহিনী পদ্মার চারপাশে জমায়েত লোকজনদের ঘেরাও করে। পুরুষদের অপেক্ষা করতে বলে নারী ও শিশুদের বাড়ি ফিরে যাওয়ার জন্য নির্দেশ দেন। শুরু হয় ব্রাশফায়ার, সারি সারি স্বজনের মৃতদেহ, আকাশে কুন্ডুলি পাকিয়ে উঠছে ধোঁয়া। শুধু গুলি করেও ক্ষান্ত হননি হানাদার পাকবাহিনী, মৃত্যু নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে পেট্রল ঢেলে আগুন জ্বালিয়ে লাশ পুড়িয়ে ফেলার চেষ্টা করেন।
ময়মনসিংহ কৃষি বিশ^বিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র ও মুক্তিযুদ্ধে অকুতভয় সংগঠক খুরশীদ আলম শিবলী থানাপাড়ার একজন সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান। যাকে পাক বাহিনী ধরে পাকিস্থান জিন্দাবাদ বলার জন্য বেয়নেট চার্জ করে।
এমনকি তার শরীরের চামড়া ছিলে লবণ দিয়ে পাকিস্থান জিন্দাবাদ বলানোর চেষ্টা করা হয়। শত নির্যাতন করা সত্বেও পাক হায়েনারা শিবলীর মুখ থেকে জয় বাংলা ছাড়া কোন শব্দ বের করতে পারেনি। এরপর শিবলীকে গায়ের চামড়া তুলে লবন মিশিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে। শিবলী যেন এক জীবন্ত কিংবদন্তি। তার নির্মম ও লোমহর্ষক হত্যাকান্ডের কথা শুনতে ও সমবেদনা জানাতে বিভিন্ন এলাকা থেকে বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষ থানাপাড়ায় তার বাড়িতে ভিড় জমায়।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম এমপির আন্তরিক চেষ্টায় সরকারীভাবে গনহত্যার স্মৃতি স্বরুপ ২০১১ সালে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের উদ্যেগে চারঘাট পল্লী বিদ্যুৎ মোড়ে তৈরি হয়েছে ১৭৪ জন শহীদের নাম সম্বলিত স্মৃতিস্তম্ভ।
চারঘাট উপজেলার সাবেক মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মিজানুর রহমান আলমাস বলেন, থানাপাড়া সংলগ্ন বাংলাদেশ পুলিশ একাডেমীর নিচে পদ্মাতীরবর্তী জায়গায় গণহত্যা ঘটলেও তৈরি হয়নি তাদের স্মৃতিধারক বধ্যভুমি। তিনি মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বর্তমান প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে এসকল শহীদদের স্মৃতি স্বরুপ একটি বধ্যভুমি নির্মাণের দাবি জানান।


প্রকাশিত: এপ্রিল ১৩, ২০২৩ | সময়: ৫:৩৫ পূর্বাহ্ণ | সুমন শেখ

আরও খবর