সর্বশেষ সংবাদ :

বড়াইগ্রামে অগ্নিদগ্ধ আরও এক জনের মৃত্যু : ‘আমারে একন কেডা দেকপি কি কইরি বাঁইচপো’

অহিদুল হক, বড়াইগ্রাম: ‘বাপ মরা ছাওয়ালডাক লেখাপড়া শিকাতে না পারলেও খায়া না খায়া মানুষ করনু। সেও দিন রাত খাইটি বউ-ছাওয়ালসহ আমার খাওয়াপড়া দিতো, ওষুধ কিনে দিতো। সেই ছাওয়াল আমার বন্ধুর বাড়িত যায়া পুইড়ি মইরলো। একন আমারে কেডা দেকপি, আমরা কি কইরো বাঁইচপো?’
বুক চাপড়ে কাঁদতে কাঁদতে কথাগুলো বলছিলেন নাটোরের বড়াইগ্রামে আগুনে পুড়ে মারা যাওয়া আনোয়ার হোসেনের বিধবা মা জহুরা বেগম। দগ্ধ হয়ে ছয়দিন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থেকে রোববার রাত পৌণে আটটার দিকে তিনি মারা যান। তাকে সহ এ অগ্নিকান্ডে মৃত্যুর সঙ্গে চারজনে দাঁড়ালো।
উপজেলার খাকসা গ্রামে গত মঙ্গলবার রাতে আনোয়ার হোসেন তার বন্ধু বাস চালক মোহাম্মদ আলীর বাড়িতে বেড়াতে যায়। খেতে বসার আগ মুহুর্তে আকস্মিক অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। আগুন লেগে ঘরে থাকা গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরিত হয়ে আগুনের তীব্রতা বেড়ে গিয়ে ঘটনাস্থলেই পুড়ে মারা যান মোহাম্মদ আলীর স্ত্রী সোমা বেগম (৩২), মেয়ে অমিয়া আফরিন মাহী (১০) ও ছেলে ওমর ফারুক (৪)। আগুন নেভাতে গিয়ে আনোয়ার ও মোহাম্মদ আলী দগ্ধ হন।
ওই দিনই আনোয়ারকে প্রথমে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এবং পরে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ণ ও প্লাস্টিক সার্জারী ইনস্টিটিউটে ভর্তি করা হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রোববার রাতে তিনি মারা যান। সোমবার সকালে তার লাশ কফিনবন্দী অবস্থায় বড়াইগ্রামের নিজ বাড়িতে আনা হয়েছে।
স্থানীয়রা জানান, আনোয়ার মৌখাড়া হাটে কুলির কাজ করে সংসার চালাতেন। প্রথম স্ত্রী মরিয়ম খাতুনের সঙ্গে বিচ্ছেদ হয়ে যায় তার। সে সংসারে আব্দুল্লাহ (১৫) নামে এক ছেলে আছে। বর্তমানে মুর্শিদা বেগম নামে দ্বিতীয় স্ত্রী নিয়ে সংসার করছেন।
এ সংসারে ওবায়দুল্লাহ (৯) ও সাহাব উল্লাহ (৮) নামে দুই ছেলে রয়েছে। নিজে পড়ালেখা করার সুযোগ না পেলেও আনোয়ার তার তিন ছেলেকে শিক্ষিত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। বড় ছেলে হাফেজিয়া মাদ্রাসায় এবং অপর দুই ছেলে খাকসা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে। বসতভিটা ছাড়া তাদের কোনো জমি নেই। এ অবস্থায় সংসারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে সংসার কীভাবে চলবে, তা নিয়ে যেন অথৈ সাগরে পড়েছেন আনোয়ারের মা জহুরা বেগম ও স্ত্রী মুর্শিদা।
দুই শিশু সন্তানকে বুকে জড়িয়ে কাঁদতে কাঁদতে আনোয়ারের স্ত্রী মুর্শিদা বেগম জানান, ‘শবে বরাতের দিন আবদুল্লাহর বাপ বাজার থাইকি চাল-আটা আইনি দিয়া কইলো, হালুয়া-রুটি বানাও, দুপুরে আইসি খাব। কিন্তু সারাদিন আর ফিরেনি। রাইতে শুনি বন্ধুর বাড়িত বেড়াতে যায়া পুইড়ি গেছে। আশা করিছিনু চিকিৎসা কইরলে আল্লাহ মনে হয় ভাল কনরি দিবি। কিন্তু আমারতো সব শেষ, এখন আমি শ^াশুড়ি আর ছাওয়ালগুলা লিয়ে কি কইরি চইলবো, কি খাওয়াবো?’
সোমবার আনোয়ারের লাশ বাড়িতে আনার সঙ্গে সঙ্গে স্বজনদের আহাজারিতে ভারী হয়ে ওঠে আশপাশের পরিবেশ। দুই সন্তানসহ মায়ের নির্মম মৃত্যুর শোককে আরো বাড়িয়ে দিয়েছে যেন আনোয়ারের মৃত্যু। শোকে মূহ্যমান গ্রামের নারী-পুরুষেরা অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা যাওয়া চতুর্থ ব্যক্তির লাশ দেখতে ভীড় জমিয়েছেন। সবাই শোকে কাতর। কারো মুখেই যেন সান্ত্বনা দেবার মত ভাষা মিলছে না। মারা যাওয়া বন্ধুকে শেষ বারের মত দেখতে এসেছেন মোহাম্মদ আলীও। গামছা দিয়ে নিজের কপাল ও দুই হাতের পোড়া অংশ ঢেকে বসে আছেন খাটিয়ায় শোয়ানো বন্ধুর লাশের পাশে।
স্ত্রী-সন্তানের পর একমাত্র বন্ধুকেও হারিয়ে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছেন তিনি। মুখে কোন কথা নেই, দু’চোখ বেয়ে ঝরে পড়া লোনা জলে মিশে সব কষ্টগুলো যেন ফোটায় ফোটায় ঝরে পড়ছে মাটিতে।
মোহাম্মদ আলীর বড় ভাই আব্দুল হান্নান বলেন, ‘ছোটবেলা থেকে তারা ঘনিষ্ঠ বন্ধু। কাজের সময় ছাড়া দু’জন সব সময় একসঙ্গে থাকতো। আনোয়ারের শ্বাসনালিসহ শরীরের ৭৫ শতাংশ পুড়ে গিয়েছিল। অনেক চেষ্টার পরও চিকিৎসকেরা তাকে বাঁচাতে পারেননি।’
বড়াইগ্রাম সার্কেলের সহকারী পুলিশ সুপার শরীফ আল রাজীব জানান, স্বজনদের আবেদনের প্রেক্ষিতে আনোয়ারের লাশের ময়নাতদন্ত ছাড়াই দাফনের অনুমতি দেওয়া হয়েছে।


প্রকাশিত: মার্চ ১৪, ২০২৩ | সময়: ৫:১৩ পূর্বাহ্ণ | সুমন শেখ