‘শেখ হাসিনাকে সরিয়ে ইউনূসকে ক্ষমতায় বসানোর পরিকল্পনা যেভাবে ভেস্তে যায়’

সানশাইন ডেস্ক : ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সম্পর্ক বরাবরই অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ও মধুর ছিল। যার দৃষ্টান্ত নানা সময়ে দেখা গেছে। প্রধানমন্ত্রী নিজেই নানা সময়ে সেই সম্পর্কের কথা স্মৃতিচারণ করেছেন। বলেছেন, প্রণব মুখার্জি ছিলেন তার অভিভাবকের মতো।
শুধু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নয়, বাংলাদেশের অভিভাবকের দায়িত্ব পালন করেছেন প্রণব মুখার্জি। যে দায়িত্বভার মুক্তিযুদ্ধকালে ১৯৭১ সালের ১৫ জুন তার ওপর ন্যস্ত করেছিলেন ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী স্বয়ং। সেদিন মুখার্জিকে তিনি নির্বাসিত মুজিবনগর সরকারকে বাংলাদেশের সার্বভৌম গণতান্ত্রিক সরকার হিসেবে নয়াদিল্লির আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয়ার আহ্বান জানিয়ে রাজ্যসভায় আলোচনা শুরু করার নির্দেশ দিয়েছিলেন।
শুধু তাই নয়, ইন্দিরা গান্ধীর উদ্যোগেই বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠায় কূটনৈতিক দৌড়ঝাপ করেছিলেন প্রণব মুখার্জি। ১৯৭১ সালের ২ সেপ্টেম্বর ফ্রান্সের ভার্সাই-এ ইন্টার-পার্লামেন্টারি ইউনিয়নের সম্মেলন থেকে শুরু করে নানা ফোরামে বাংলাদেশে পাক হানাদার বাহিনীর মানবাধিকার লঙ্ঘনের চিত্র তুলে ধরেন প্রণব। ২০১৩ সালে রাষ্ট্রপতি হিসেবে বাংলাদেশ সফর করেন প্রণব মুখার্জি। সফরকালে বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় তার অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে তাকে বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সম্মাননা ও মুক্তিযুদ্ধ পুরস্কার দেয়া হয়।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করা হয়। এরপর নয়াদিল্লিতে আত্মগোপন করে থাকতে হয়েছিল শেখ হাসিনাকে। সে সময় তিনি নয়াদিল্লির পানডারা রোডে যেখানে থাকতেন তার পাশেই প্রতিবেশী হিসেবে ছিলেন প্রণব মুখার্জি। সেই সময় প্রণবের পরিবারের সঙ্গে সম্পর্ক আরও গভীর হয়। অভিভাবকের মতোই শেখ হাসিনাকে আগলে রেখেছিলেন প্রণব।
এরপর শেখ হাসিনা দেশে ফেরেন। দীর্ঘ লড়াই-সংগ্রামের পর হাল ধরেন দেশের। কিন্তু এরপরও শেখ হাসিনার ব্যাপারে প্রণব মুখার্জির অভিভাবকসূলভ আচরণ শেষ হয়ে যায়নি। যা প্রণব তার স্মৃতিকথায় বিস্তারিত লিখে গিয়েছেন।
টেলিগ্রাফ ইন্ডিয়ার এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, শেখ হাসিনাকে বিভিন্ন সময় বিপদ-আপদে রক্ষা করেছেন প্রণব মুখার্জি। যার মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনের পরিকল্পনায় শেখ হাসিনা সরকারকে উৎখাত চেষ্টা ভেস্তে দেয়ার ঘটনা অন্যতম।
গত দুই দশক ধরে বিশ্বের বহু দেশে সরকার পরিবর্তনের চেষ্টা করেছে যুক্তরাষ্ট্র। এর মধ্যে ইউক্রেন, জর্জিয়া ও মিশরের মতো দেশগুলোতে তারা সফলও হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশে শেখ হাসিনার সরকারকে উৎখাতে পাঁয়তারা শুরু করে তারা।
মূলত সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন ও তার উত্তরসূরি পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি এই অপতৎপরতায় যোগ দেয়। তাদের কোনোভাবে এটা বিশ্বাস করানো হয়েছিল যে, দুর্নীতিবাজ রাজনীতিবিদরা বাংলাদেশের উন্নয়নকে পিছিয়ে দিচ্ছে। সেই জায়গায় সামাজিক উদ্যোক্তা ও ক্ষুদ্রঋণ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বাংলাদেশকে আরও ভালো নেতৃত্ব দিতে পারবেন।
সেই চিন্তা থেকে তারা ড. ইউনূনের প্রতি সমর্থন দেন। যিনি কার্যত ২০০৬ সাল থেকে রাজনীতিতে প্রবেশের চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন। শুধু যুক্তরাষ্ট্রের এ দুই নেতাই নন, আয়ারল্যান্ডের সাবেক প্রেসিডেন্ট ও পরবর্তীতে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক প্রধান মেরি রবিনসনের মতো বেশ কয়েকজন বিশ্বনেতাও ইউনূসের প্রতি খোলাখুলি সমর্থন দেন।
২০১১ সালের মার্চ মাসে শেখ হাসিনা সরকার গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদ থেকে ড. ইউনূসকে অপসারণ করার পর তার পক্ষে বাংলাদেশের অনেক জায়গায় মানববন্ধন করা হয়। এসব মানববন্ধনকে হাসিনাকে উৎখাত করার প্রাথমিক প্রস্তুতিপর্ব হিসেবেই মনে করা হচ্ছিল। কেননা, সে সময় অনেক দেশে নির্বাচিত নেতারা বিদেশ থেকে কলকাঠি নাড়া আন্দোলনের মধ্যদিয়ে ক্ষমতাচ্যুত হয়েছিল।
ইউনূস ইস্যুতে বাংলাদেশে রাজনৈতিক উত্তাপ যখন বেড়েই চলেছে, তখন আবারও অভিভাবকের মতোই এগিয়ে আসেন ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখার্জি।
একদিন হঠাৎ সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনের ফোন পান তিনি। সেই ফোনকলে দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতির বিষয়ে একটু বেশিই আগ্রহ প্রকাশ করেন হিলারি।
ভারতীয় ও মার্কিন উভয় পক্ষের একাধিক সূত্র মতে, প্রণব মুখার্জির কাছে হিলারি ক্লিনটন একটি স্পর্শকাতর আবেদন করেন। আর সে আবেদনটি হচ্ছে, শেখ হাসিনার পরিবর্তে ভারতের দিকে থেকে গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা ইউনূসকে সমর্থন করা উচিত।
সূত্র মতে, হিলারি প্রণবকে এতদূর পর্যন্ত পরামর্শ দিয়েছিলেন যে হাসিনা দীর্ঘমেয়াদে ভারতের জন্য নির্ভরযোগ্য কোনো অংশীদার হবেন না এবং নয়াদিল্লির উচিত তাকে সমর্থন দেয়া থেকে সরে আসা। সেই জায়গায় সম্ভাব্য রাষ্ট্রপ্রধান বা টেকনোক্র্যাট সরকারের প্রধান হিসেবে ড. ইউনূসকে সমর্থন দেয়ার অনুরোধও জানান তিনি। কিন্তু প্রণব মুখার্জি তার কোনো কথায় কান দেননি এবং হাসিনার প্রতি তার বিশ্বাস ও পূর্ণ আস্থার কথা স্পষ্ট জানিয়ে দেন।


প্রকাশিত: মার্চ ১১, ২০২৩ | সময়: ৬:২২ পূর্বাহ্ণ | সুমন শেখ