ভয়ঙ্কর তেঁতুলতলা, শতবর্ষী তেঁতুল গাছের ডাল ভাঙ্গলেই হয় অমঙ্গল!

স্টাফ রিপোর্টারঃ

এক সময় গাঁ শিউরে ওঠা ভয়ঙ্কর জায়গা ছিল রাজশাহী পবা উপজেলার হরিয়াণের দহপাড়া গ্রামের তেঁতুলতলা বাজার। আষির উর্ধে বয়সী অনেক প্রবীণও বলতে পারেননি জীবন্ত এই তেঁতুল গাছের বয়স। চার পুরুষের সবাই গাছটি একই রকম গঠন দেখেছেন। তবে কালক্রমে জায়গাটি মানুষের পদচারণা ও বসবাস শুরু হলেও এখনো তেঁতুল গাছটির ডাল ভাঙ্গলে, গাছের পাশে প্রশাব করলে কিংবা তেঁতুল নামিয়ে বিক্রি করলে হয় অমঙ্গল বলে দাবি স্থানীয়দের।

 

 

 

তেঁতুল গাছের বিষয়ে হরিয়াণ ইউনিয়নের মেম্বার ও ওয়ার্ড আওয়ামীলীগের সভাপতি আক্কাস আলী বলেন, ‘আমার আব্বার আব্বাও বলতে পারেনি এই তেঁতুল গাছের বয়স কত! আমার দাদারাও শুনেছি এমনি দেখেছি যেমনটা আমরা এখন দেখতে পাচ্ছি।’ অলৌকিকতা ও ভীতিকর বিষয়ের ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘খুব ভয়ঙ্কর জায়গা ছিল তেঁতুলতলা। ওখানে পেশাব-পায়খানা তো দূরের কথা, ওই গাছের শুকনো ডালও পড়ে গেলেও কেউ কুড়িয়ে তা চুলায় দিতে ভয় পায়। দিলেই খবর আছে! এমনকি কেউ ওই গাছের তেঁতুল পেড়ে বিক্রি করলেও তার খবর আছে।’ গাছের আশপাশে প্রশাব করে, গাছের ডাল ভেঙ্গে আমাদের এলাকার অনেকেই বিপদে পড়েছেন। তবে কেউ যদি নিজে খাওয়ার জন্য কিংবা অন্যকে বিলানোর জন্য তেঁতুল পাড়েন তাহলে কিছু হবে না। কিš‘ ওই তেঁতুল পেড়ে বিক্রি করলেই তার খবর হয়ে যাবে বলে জানান মেম্বার আক্কাস আলী।

 

 

 

সরেজমিনে তেঁতুলতলা বাজারে গিয়ে দেখা গেছে, তেঁতুলগাছটি প্রায় দেড় বিঘা এলাকাজুড়ে বিস্তৃত। পুরো গাছটি সবুজ পাতা ও কাঁচাপাকা তেঁতুলে ভরপুর। গাছটির ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ডালগুলোতে ফুটেছে নতুন ফুল ও ছোট ছোট তেঁতুল। মূলত: শতবর্ষী তেঁতুল গাছের নাম ধরেই ‘তেঁতুলতলা’ বাজার নামকরণ হয়েছে। কেউ-ই সুনির্দিষ্টভাবে জানেন না গাছটির বয়স। এখনো গ্রামটির বাচ্চা থেকে বুড়ো বয়সে সবাই জানেন তেঁতুল গাছের গা শিউরে উঠা নানান ঘটনা। স্থানীয়রা জানায়, অনেকেই এই গাছ নিয়ে স্বপ্ন দেখলে করেন মানত। মানত করে গাছের তলায় রেখে যান দুধ, কলা, মিষ্টি, গরু, খাসি ও মুরগি। সেগুলো স্থানীয়দের মধ্যে বিলিয়ে দেওয়া হয়। শতবর্ষী এই তেঁতুল গাছটি তার প্রকান্ড ডাল-পালা ছড়িয়ে ছিটিয়ে রেখেছে চারদিকে। এক সময় এই রাস্তায় ভয়ে কেউ যাতায়াত করত না। তবে কালক্রমে আশপাশে গড়ে উঠেছে ঘরবাড়ি, দোকান-পাট। তেমনি একটি ডাল প্রসারিত হয়ে রাস্তার ওপার চলে গিয়েছে। সেখান দিয়ে নির্মাণ হয়েছে একটি মার্কেট। মার্কেটের একটি দোকান রয়েছে ফাঁকা। সেই ফাঁকা দোকানটিতে ঢুকে রয়েছে তেঁতুল গাছে একটি বড় ডাল।

 

 

 

দোকান ঘরটির এই অবস্থার কারণ জানতে চাইলে ওই এলাকার বাসিন্দা সাবাজ মন্ডল বলেন, ডাল কাটলে খবর আছে। তিনি বলেন, আমারই এক বংশের লোক এই গাছের একটি ডাল কেটেছিলো। কয়েকদিনের পর তার পায়ে পচন ধরে। পরবর্তীতে ধীরে ধীরে তার গোটা পা কেটে ফেলতে হয়েছিল। পরে বেচারা মারায় গেলো তেঁতুল গাছের পাশেই মিলের রয়েছে মাইনুল ইসলামের। ২৫ বছর ধরে চালাচ্ছেন মিলটি। তিনি বলেন, ‘আমার বাপ-দাদা এমনকি বড় আব্বারাও (বাবার দাদা) বলতে পারেনি গাছের বয়স। বহু পুরোনো গাছ এটি। এই গাছে নাড়লেই ক্ষতি, অন্যথায় কিছুই হবে না।’ তিনি প্রতিবেদককে টেনে দেখান একটি কাটা ডাল। সেই ডালটির বিষয়ে তিনি বলেন, ‘সুগারমিলের রহমান ড্রাইভার গাছের ডালটা কেটেছিল। তার এখন মাথার ঠিক নাই, পুরাই পাগল। গাছের বিষয়ে বললে আরও রেগে যায়। তার সাথে আমার মিলের এক নীরা নামের মিস্ত্রি গাছ কাটতে সাহায্য করেছিলো,তারও সমস্যা হয়েছিল। পরে মাফটাফ চেয়ে সে এখন ঠিক আছে।’

 

 

 

 

তেঁতুল গাছ থেকে তেঁতুল নামানো বা বিক্রিয়নের বিষয়ে জানতে চাইলে সাবের আলী বলেন, ‘গাছ থেকে তেঁতুল নামিয়ে খেলে কোনো সমস্যা নাই। যতখুশি পাড়তে পারবেন, খেতে পারবেন, বিলাতে পারবেন কিন্ত এই গাছের তেঁতুল বিক্রি করতে পারবেন না।’ তিনি বলেন, একবার এক লোক এই গাছের একটা মধুর চাক কেটেছিল। দুদিনের মধ্যে সে মুখ দিয়ে রক্ত উঠে মারা যান। এই বক্তব্যের সাই দিয়ে গ্রামের দিনমজুর মুকুল জানান, তেঁতুল পেড়ে বিক্রি করায় একলোক মুখ দিয়ে রক্ত উঠে মারা যেতে লেগেছিলো। পরে ওই গাছের কাছে মাফ-টাফ চাই, আর ভুল স্বীকার করে। তারপর সে ঠিক হয়। আমিও সেদিন তেঁতুল পেড়েছিলাম। কিন্তু আমি বিক্রি করিনি, তাই আমার কিছু হয়নি।’ হরিয়ান ইউনিয়নের সাবেক মেম্বার সাবের আলী মন্ডল। বর্তমানে তেঁতুলতলা বাজারে রয়েছে তার সার ও কীটনাশকের দোকান। তিনি বলেন, ‘আমাদের বাপ দাদারাও এই গাছের বয়স জানে না, আমরা কি করে বলব বলেন! আমার বাপ দাদা ১১০-১২০ বছর বেঁচে ছিল। তারাও বলতে পারেনি গাছের বয়স। আমাদের দাদার দাদারাও বলেছে- এই গাছ আজ যেমন দেখছিস, আমাদের দাদার আমলেও ঠিক তেমনই ছিল।’

 

 

 

 

১৯৭১ সালের দিকে অলৌকিক এক ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী হান্নান। তিনি বর্ণনা দেন সেই ঘটনার। তিনি বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের সময় মিলিটারিরা একটা গাড়ি নিয়ে এই রাস্তা দিয়ে যেতে লেগে তেঁতুল গাছটায় তাদের গাড়ি বেধে যায়। এতে কয়েকজনকে এই গাছের ডাল কাটার অর্ডার দেয় তাদের কমান্ডার। গাছের সাতটা ডাল তারা কাটেন। যে চারজন ওই ডাল কেটেছিলেন তাদের মধ্যে তাৎক্ষণিক অসুখ দেখা দেয়। দুজন বুকধরফর করে সঙ্গে সঙ্গেই মারা যায়। বাকি দুজনকে অবস্থাও খারাপ হয়ে মারা পড়েন।’ রাজশাহী সুগারমিলের এসবিএ পদে চাকরী করেন মো. আক্তার হোসেন। ১৯৭৯ সালে তিনি গাছে চড়ে ছিলেন। গাছে চড়ার আগে গাছতলায় থাকা মানতের দুধ আর কলা খেয়েছিলেন। তারপর গাছে চড়ে তেঁতুলসহ পেড়েছিলেন গাছে থাকা দুটি ঘুগু পাখির ডিম। গাছা থাকা অবস্থাতেই দেখেন একটি ঘুগু। পাখিটি হাতের খুব কাছে চলে আসে। সেটিকে বার বার ধরার চেষ্টা করে পড়ে যান গাছ থেকে। তারপর সঙ্গাহীন বিছানায় কাটিয়েছেন দুই বছরের বেশী। নাক দিয়ে তরল খাবারেই কাটাতে হয়েছে তাকে দুটি বছর। মুখে সেলাই পড়েছে, মুখটাও ব্যাকা হয়ে গিয়েছে ওই ঘটনায়।

 

 

 

 

 

তিনি আরও জানান, ‘হ্যাঁ দেখেছিলাম। বিছানা অজ্ঞাত অবস্থা ও কিছুটা সুস্থ হওয়ার পরও নারী কন্ঠে আমাকে ডাকতো। আমিও ঘোরের মধ্যে ছুটে চলে যেতাম নাকি। আমাকে বাড়ির লোক বা স্থানীয়রা অনেক বার ফিরিয়ে নিয়ে এসেছিলো। ঠিকভাবে ঘুমাতে পারতাম না। বাধ্য হয়ে ঢাকায় চলে গিয়েছিলাম আমার দাদার বাড়ি। সেখানেও একই সমস্যা হতো। পরে ক্ষমা চাই এসব বিষয় নিয়ে আর দুটি কালো খাসি মানত দেয়। এখন আল্লাহর রহমতে ভালো আছি।’ নুরুল ইসলাম নামের এক যুবক বলেন, ‘আমার মামা একবার ওই গাছের আশপাশে বসে পেশাব করেছিলো। তারপর সেখানেই জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন তিনি। তারপর কয়েকদিনের মধ্যেই তিনি মারা যান।’ মেম্বার মো. আক্কাস আলী ৭৫ সালের দিকের আরও একটি অদ্ভুত ঘটনার গল্প বলেন, গাছটা প্রায় শুকিয়ে মরে যাওয়ার মতন অবস্থা। পাশেই একটি ভাটা ছিল। তখন ওই ভাটার মালিক স্বপ্নে দেখে এখান থেকে ভাটা না সরিয়ে নিয়ে তার ক্ষতি হয়ে যাবে। স্বপ্নপ্রাপ্ত আদেশে ভাটামালিকে চলে যান এলাকা ছেড়ে। তখন আবার গাছটি প্রাণ ফিরে পায়, আবার ডালপালা সবুজ হয়ে উঠে।’ ‘গাছের তলায় অনেকেই এখন বসে থাকেন। তাই চেয়ারম্যানের পরামর্শে গাছের পাড়টি টাইলস দিয়ে বাঁধানোর কাজে হাত দেয়। বালু আর সিমেন্ট মিশিয়ে স্যালোমেশিন দিয়ে পানি দেয়, কিন্তু পানি আর ভেজে না। প্রায় দেড় ঘন্টা ধরে পানি যায় হরহর করে, তারপর বালু ভেজে না। উপস্থিত আমরা সবাই অবাক হয়ে যায়। পরে ওই বালু আর সিমেন্টে পানি ছিটিয়ে তা ভেজানো হয়। অথচ, যে পানি গেছে তাতে দু’তিনটা বিল্ডিং এর কাজ করা যেতো।’ হান্নানের সেই মিলিটারি গায়েব হওয়ার ঘটনাটির পুন:বৃত্তি করে তিনি বলেন, ‘যুদ্ধের সময় আমি তখন হাফপ্যান্ট পড়া ছেলে। মিলিটারিরা এদিক দিয়ে ৩-৪ টা বড় ট্রাকগাড়ি নিয়ে যাচ্ছিল। পথে তেঁতুল গাছের ডাল থাকা তারা সেটা কেটে ফেলেন। এতে ঘটনাস্থলে অনেকেই অসুস্থ হয়ে যান। পরে এই তেঁতুলতলার পথ দিয়ে শুধু  ড্রাইভার খালি গাড়ী নিয়ে যায়। তারাও বলতে পারেননি ওই মেলেটারিদের হদিস। কেউ বলে মুক্তিযোদ্ধারা মেরেছে, কেউ বলে গায়েব হয়ে গেছে।’

 

 

 

 

তিনি বলেন, ‘কয়েক বছর আগেই সুগারমিলের ড্রাইভার আব্দুর রহমান আমার মামা তেঁতুলতলার পাশে একটি সরার গাছ বেঁচেছিলেন। গাছ বিক্রির কারণে তিনি পা কাটা পড়ে কস্টে মারা যান। আবার যে এই গাছটি কিনেছেন তারও শুনেছি ক্ষতি হয়েছে। সেও মারা গেছে।’ শতবর্ষী গাছটির উপর দিয়ে চলে গেছে বিদ্যুতের তার। তারপরও বিদ্যুত বিভাগ থেকে এই গাছের ডালপালা কাটেন না। তারাও জানেন এই গাছের ভয়ঙ্কর সব কল্পকথা। তবে মেম্বার আক্কাস আলী জানান, একবার পবার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এলাকায় এসে এই গাছ কাটার কথা বলেন রাস্তা বড় করার জন্য। তিনি তাতে পরিষ্কার জানিয়ে দেন- ‘স্যার আমি মেম্বারশিপ ছেড়ে দিবো তাও এই কাজ আমি করতে পারব না। আপনি করতে যেয়েন না। আমার কথা বিশ্বাস নাহলে সবার কাছে থেকে এই গাছের ঘটনা শুনে নিয়েন। অতপর পবা ইউএনও আর গাছটি কাটেননি। মেম্বার আক্কাস আলী বলেন, তেঁতুলগাছ ততক্ষণ না কাউকে কিছু বলে, যতক্ষণ কেউ তার ক্ষতি করে। এমনিতেই সেই গাছ নিয়ে কোনো সমস্যা হয় নাই। তবে তার সিস্টেমের বাইরে গেলে খবর আছে।

 

 

 

 

 

সানশাইন/টিএ


প্রকাশিত: জানুয়ারি ২৬, ২০২৩ | সময়: ৯:১৭ অপরাহ্ণ | Daily Sunshine